Advertisement
Advertisement
Chia Seeds

সুপারফুড চিয়া চাষে হোন লাখপতি, জেনে নিন পদ্ধতি

চিয়া কীটনাশক ছাড়াই নিরাপদে চাষের জন্য উপযুক্ত।

Here are the process of Chia Seeds cultivation
Published by: Sayani Sen
  • Posted:March 27, 2024 1:56 pm
  • Updated:March 27, 2024 1:56 pm

‘চিয়া’ শব্দের অর্থ ‘শক্তি’। এর বীজের পুষ্টিমানের কারণে এমন নাম হয়েছে বলাই যেতে পারে। চিয়া বীজে ১৫-২৫% প্রোটিন, ৩০-৩৩% ফ্যাট, ৩১-৩৫% লিপিড, ১৮-৩০% ডায়েটারি ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও নানান খনিজ উপাদান রয়েছে। এ দেশীয় কৃষি আবহাওয়ায় চিয়া রবিশস্য হিসেবে চাষ করা যেতে পারে। চিয়া চাষ করে প্রতি হেক্টর জমিতে কয়েক লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি আবহাওয়া ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের গবেষক দোলগোবিন্দ পাল ও অধ্যাপক শাওন বন্দ্যোপাধ্যায়।

সুবুজবিপ্লবের সুবাদে পর্যাপ্ত কৃষি উৎপাদন, গণবন্টন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, খাদ্য সুরক্ষা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অগ্রগতি ও উন্নয়নের মান চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশের পুষ্টির মান এখনও বেশ হতাশাজনক। বিশেষত মহিলা ও শিশুদের মধ্যে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সংস্থার সদ্য প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ধান, গম হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ। আয়রন এবং জিঙ্ক এই দুটি পুষ্টি উপাদান খাদ্যশস্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গিয়েছে। গত ৫০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা আরও বলেছে, ধানে আয়রন ও জিঙ্কের পরিমাণ কমেছে যথাক্রমে ৩৩ ও ২৭ শতাংশ‌। আর গমের ক্ষেত্রে এই দুই পুষ্টি উপাদানের হ্রাসের পরিমাণ যথাক্রমে ৩০ ও ১৯ শতাংশ। কৃষি বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন আগামী দিনে ধান, গমের মত প্রধান শস্যগুলিতে অ্যালুমিনিয়াম, বেরিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত মৌলের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এরকম এক সংকটকালে সুপারফুড চিয়া বীজ চাষ ও চিয়া বীজ বিষয়ক গবেষণা ভারতীয়দের সুষম পুষ্টি আহরণে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। বর্তমানে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, জাপান, আমেরিকা, চিলি, অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর অনেক দেশে চিয়া খাদ্য হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

Advertisement

চিয়ার বিজ্ঞানসম্মত নাম স্যালভিয়া হিসপানিকা। এটি মিন্ট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, স্বপরাগী এবং সিউডো সিরিয়াল। ‘চিয়া’ শব্দের অর্থ ‘শক্তি’। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৫০০ থেকে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশে খাদ্যশস্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে চিয়া। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম মেক্সিকোর অ্যাজটেক ও মধ্য আমেরিকায় চিয়াকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করা হতো। চিয়া বীজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য যা ঔষধি গুণ ও পুষ্টিতে ভরপুর। ক্ষুদ্র এই বীজে রয়েছে উচ্চমাত্রার পুষ্টি সম্পন্ন ১৫-২৫% প্রোটিন, ৩০-৩৩% ফ্যাট, ৩১-৩৫% লিপিড, ১৮-৩০% ডায়েটারি ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও নানা খনিজ উপাদান।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কৃষি বিপ্লব! বাংলায় তৈরি করা বীজে ৪২ টন আলু উৎপাদন করে নজির]

চিয়া বীজের বিশেষত্ব হল এর পুষ্টিমান। এই বীজ প্রক্রিয়াজাত না করলেও সরাসরি শরীরে শোষিত হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া বীজে রয়েছে ৬৩১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪০৭ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৩৩৫ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ৮৬০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৭ মিলিগ্রাম আয়রন ও ৪.৪ মিলিগ্রাম জিঙ্ক। সার্বিকভাবে চিয়া বীজে ৬০% ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা এলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারিন বাড়ায় এবং এইচডিএল কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। সর্বোপরি চিয়া সিডে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। আমরা জানি ফাইবার আমাদের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে, ওজন কমাতে সহায়তা করে এবং আমাদের গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল যে কোনও সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। ক্যালসিয়াম থাকার কারণে আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও চিয়া সিডের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চিয়া সিডের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার আমাদের শরীরের টক্সিক পদার্থ শরীর থেকে বের করে আনতে সহায়তা করে।

ইতিমধ্যেই ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গে চিয়া চাষ স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও, আরও চিয়া সম্পর্কিত কৃষি গবেষণা ও চাষের এলাকা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের চিয়া বীজ রয়েছে। প্রধানত ধূসর, কালো, বাদামী এবং সাদা রঙের চিয়া বীজ দেখা যায়। চিয়া বীজ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। চিয়া-র বৃদ্ধির জন্য সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বোচ্চ ৩৬ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং গড় তাপমাত্রা ১৬ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রয়োজন হয়। চিয়া ফসলের জীবন চক্রের সময়কাল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অক্ষাংশ বা অবস্থান এবং উচ্চতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে বাস্তুসংস্থান ভেদে চিয়া বীজের জীবন চক্রের সময়কাল ১০০-১৫০দিনের মধ্যে বলে উল্লেখিত রয়েছে।
এ দেশীয় কৃষি আবহাওয়ায় চিয়া রবিশস্য হিসেবে চাষ করা যেতে পারে। শীতকাল হল চিয়া বীজ রোপন ও বৃদ্ধির আদর্শ সময়। ফসলটি সব রকম মাটিতে চাষ করা যায়। তবে হাল্কা থেকে মাঝারি বেলে এবং বেলে দোআঁশ মাটিতে ভাল হয়। এটি অম্ল মৃত্তিকায়ও চাষ সম্ভব।

আবার খরা প্রতিরোধেও সক্ষম। চিয়া বীজ বপন এবং চারা স্থাপনের জন্য আর্দ্র মাটির প্রয়োজন। কিন্তু পরিপক্ক চিয়া গাছ বৃদ্ধির সময় ভেজা মাটি সহ্য করতে পারে না। চিয়া চাষের জমি তৈরির জন্য সাধারণত এক থেকে দুইটি চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করে নিতে হয়। মাটি আগাছা মুক্ত হওয়া চাই। চিয়া মূলত বীজ এবং চারা উভয় থেকেই বংশবিস্তার করতে পারে। চিয়া বীজ খুবই ক্ষুদ্র তাই চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৫-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

এই ফসল চাষে জমি তৈরির সময় রাসায়নিক সার হেক্টর প্রতি ৬০ কেজি নাইট্রোজেন, ৩০ কেজি ফসফেট ও ৩০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করা হয়। ভাল ফলনের জন্য নাইট্রোজেনের সম্পূর্ণ ডোজ বীজ বপনের সময় ব্যবহার না করে, দুটি কিস্তিতে ভাগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম অর্ধাংশ বীজ বোনার সময় এবং বাকি অর্ধাংশ বীজ বপনের ৩০ দিন পর প্রয়োগ করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। আবহওয়া ও বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে ১-২টি সেচের প্রয়োজন। চিয়া ফসলের তেমন কোনও কীটপতঙ্গ ও রোগ বালাই দেখা যায় না বললেই চলে। চিয়া গাছের পাতায় অপরিহার্য এমন কিছু তৈলাক্ত পদার্থ এবং গন্ধ রয়েছে যা পোকামাকড়ের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই চিয়া কীটনাশক ছাড়াই নিরাপদে চাষের জন্য উপযুক্ত। কখনও কখনও সাদামাছি দ্বারা সংগঠিত ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। ফসলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখার সাথে সাথে আক্রান্ত গাছ জমি থেকে উপড়ে নষ্ট করে দিতে হবে। এছাড়া সাদামাছি নিয়ন্ত্রণে ইমিডাক্লোপ্রিড বা ডাইফেনথাইউরোন (Diafenthiuron) স্প্রে কার্যকরী।

চিয়া গাছের ফুলগুলি যখন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাদামী এবং হলদে-বাদামী রঙের পরিণত হয় তখন ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত হয়। মাটির উপরে থাকা গাছগুলি কেটে নেওয়ার পর ত্রিপল বা পরিষ্কার মেঝেতে রেখে রৌদ্রে শুকাতে দেওয়া হয়। ১২-১৫ দিন রোদ শুকানোর পর বাঁশ বা কাঠের লাঠি দিয়ে আলতো ভাবে আঘাত করলেই গাছ থেকে বীজ আলাদা হয়ে যাবে। তারপর বীজ ছেড়ে এবং পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে। চাষের পদ্ধতি ও ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে চিয়ার ফলন হেক্টর প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি এই ফসল চাষে খরচ পরে প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৬৪,০০০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি চিয়া বীজের বাজার মূল্য প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা বলে জানা গিয়েছে। পরিশেষে বলা যেতে পারে চিয়া একটি উচ্চ মূল্যের ফসল হিসেবে গণ্য হওয়ায় এই ফসলের চাষ অনেক লাভজনক। ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কৃষির বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে চিয়া বীজের চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই ফসল পুষ্টি নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাই উদ্যোগী ছোট-বড় কৃষকভাইদের কাছে
চিয়া বীজের চাষ হয়ে উঠতে পারে এক সম্ভাবনাময় বিকল্প।

[আরও পড়ুন: খাবারের প্লেটে বাড়ছে কাঁকড়ার চাহিদা, সঠিক পদ্ধতিতে চাষের পথ দেখালেন বিশেষজ্ঞ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ