ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ছ: কী রে রাজু, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? পোড়োবাড়ির ঘর থেকে বেরনোর সময় দলনেতার এই প্রশ্ন শুনেও রাজু কোনও উত্তর দেয়নি। খটকা লাগায় অন্যরা থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজুকে দেখে তাঁদেরও বুক শুকিয়ে যায়। দরদর করে ঘামছে বছর ত্রিশের যুবকটি। চোখ স্থির। শরীর যেন ভারী পাথর। হাজারও ঠেলাঠেলিতেও নড়ানো যাচ্ছে না। গা হিম ঠান্ডা। মিনিট তিনেক। তার পরে যেন এক মস্ত ঝাঁকুনিতে রাজুর সম্বিৎ ফিরে এসেছিল। দলনেতা সকলকে বলেছিলেন, “এখানকার ব্যাপার-স্যাপার সুবিধার ঠেকছে না। এখন ফিরে যাওয়াই ভাল।”
রাজুর কী হয়েছিল? ভূতে ধরেছিল?
ভূত চতুর্দশীর সঙ্গে এমন একটা গা ছমছমে প্রশ্ন যথেষ্ট মানানসই। সৌমেনবাবুরাও ‘না’ বলছেন না। যদিও ভূত শব্দটা তাঁরা উচ্চারণ করতে নারাজ। তাঁদের ব্যাখ্যা, “এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান। ডাক্তারি পরিভাষায় ‘সাইকিক অ্যাটাক’। আত্মার উপস্থিতিতেই এমনটা হয়েছিল। হন্টিং-এর একটা রূপ। এ সময় মগজ স্থির হয়ে যায়। বুঝতে পারে না, কী করবে। অন্য কেউ দেহ-মন নিয়ন্ত্রণ করে।” কখনও বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবে রাজুর সাইকিক অ্যাটাকই হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন সৌমেন রায়। অশরীরীদের অবস্থান ও তাদের কার্যকলাপ নিয়ে গবেষণা করে তাঁর টিম। ভূতের বদলে স্পিরিট বা আত্মা শব্দটিকে বেশি পরিচিত করতে তাঁদের সংস্থারও নাম রাখা হয়েছে সিস্টেমেটিক প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন রিসার্চ অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট টিম। সংক্ষেপে স্পিরিট।
[ ইসলাম গ্রহণ করেও কেন সাধনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ? ]
দেশ জুড়ে এমন অসংখ্য সংস্থা কাজ করছে। সেই গবেষণার কথা বলতে গিয়েই সামনে এসে পড়ে ব্যাখ্যাতীত বিবিধ ঘটনা। বিশ্বময় যার নাম ‘হন্টিং’। আত্মার উপস্থিতি খুঁজতে গিয়ে যার পাল্লায় পড়েছিলেন খোদ সৌমেনেরই সঙ্গী। স্পষ্ট বাংলায় বলতে গেলে, জীবিত জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়াই হল হন্টিং। সৌমেনবাবুরা জানাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত পাঁচ রকমের হন্টিংয়ের সন্ধান মিলেছে।
[ মা যে জীবন্ত! জানেন কীভাবে প্রমাণ করেছিলেন সাধক কমলাকান্ত? ]
যেমন, ডেমনিকং হন্টিং। সবচেয়ে ক্ষতিকর। গায়ে আঁচড় পড়তে পারে। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আচমকা ধাক্কা খেতে পারেন। সৌমেনবাবুদের টিমের কেউ কেউ আঁচড় খেয়েছেন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, চাবির গোছা বিছানায় রাখা ছিল। আচমকা সেটি গায়েব। পাওয়া গেল দেরাজে। অথবা কোনও ঘরের আলো বা টিভির সুইচ বন্ধ হয়ে গেল। বা দেখা গেল, বাল্বের ভোল্টেজ আচমকা উঠছে-নামছে। একে বলে ইন্টেলিজেন্ট হন্টিং। আত্মা এক্ষেত্রে শিশুর মতো বুদ্ধির পরিচয় দেয়। এমনকী, আত্মহত্যা করার পর সেই আত্মাও ফিরে এসে আক্ষেপ করতে পারে। সংস্থাটি জানাচ্ছে, এটি সচেতন মৃত্যুর ঘটনা। আত্মা সচেতন। তাই বুদ্ধিদীপ্তও। পোল্টারজাইস্ট হন্টিংয়ের ক্ষেত্রে ভূতেরা সাধারণত শব্দ করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। যেমন, চেয়ার টেনে ফেলে দেওয়া, হ্যাঁচকা টানে পর্দা খুলে যাওয়া, দেওয়ালে টাঙানো ছবি ছুড়ে ফেলে দেওয়া, দরজা খুলে সজোরে বন্ধ হওয়া। আচমকা গায়ে আগুনও লেগে যেতে পারে। বিদেশে একাধিকবার এমন ‘স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কম্ব্যাশন’ ঘটে গিয়েছে।
রেসিডিউয়াল হন্টিং। একেবারে নিরীহ। জীবদ্দশার অবশিষ্ট কাজ করতে বারবার ফিরে আসে আত্মারা। যেমন কোনও চেয়ারের দুলুনি, দরজায় টোকা, ছাদের বা পাশের ঘরে অথবা সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ধরা যাক, অফিস যাওয়ার পথে গাড়ি চাপা পড়ে কেউ মারা গিয়েছেন। আচমকা দুর্দৈবের কোনও ব্যাখ্যা আত্মার কাছে থাকে না। মৃত্যুর পর তার মগজও নেই। তার কী হয়েছিল, মনে করতে পারে না। শুধু শেষ অবস্থানটুকুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। বারবার তাই সেই জায়গাতেই সে ফিরে আসবে। বারবার একই কাজ করবে।
[ যিশুর ভজনা ছেড়ে শক্তির সাধনা, সাহেবের পুজোয় মাতোয়ারা হ্যামিলটনগঞ্জ ]
হন্টিং বা ভূতের অবস্থান টের পাওয়ার এমন একাধিক ঘটনার কথা শোনালেন ‘স্পিরিটের’ সদস্যরা। শুরুরটি হাওড়ার এক প্রত্যন্ত এলাকা নাজিরগঞ্জের বাণীপুরের। বছর তিনেক আগে তারা একটি পোড়ো বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠিক হয়, রাতের অন্ধকারে একেবারে শেষের ফাঁকা ঘরে পরীক্ষা হবে। সেই মতো একটি ভিডিও ক্যামেরা চালু করে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়। আত্মার উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া হয় কিছু প্রশ্ন। “আমরা সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার কথা। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই রাজুর ওই দশা।”– বলছেন সৌমেনবাবু। যদিও রাজুর মনে নেই, তাঁর কী হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। এর কিছুক্ষণ পর কন্ট্রোল রুমে ফিরে আসেন তাঁরা। ১৫ মিনিট পর আবার সেই ঘরে যান। দেখা যায়, ক্যামেরার ভিডিও মোড অফ। সুইচ বন্ধ। ক্যামেরার গা ঠান্ডা। সৌমেনবাবুর দাবি, সুইচ অন করে রিওয়াইন্ড করে ওই ১৫ মিনিটের কোনও রেকর্ড মেলেনি। ভিডিও রেসকিউয়ার সফটওয়্যারও তা উদ্ধার করতে পারেনি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্যামেরায় যখন ব্যাটারি ভরা হয়েছিল সেটিতে চার্জ ছিল ৯৪ শতাংশ। কিন্তু ওই ১৫ মিনিটে সেই চার্জ নেমে এসেছিল ১৪ শতাংশে!
[ অন্যদের আলোর খোঁজ দিয়ে জীবনের আঁধার ঘোচাচ্ছে এই পড়ুয়ারা ]
‘স্পিরিটের’ দাবি, এটাই হন্টিংয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অশরীরীরা শরীর ধারণ করতে পারে না। বদলে হাওয়া বা কোনও বিদু্যৎ পরিবাহী জায়গা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নেয়। দু’-তিন মিনিটেই সে চেষ্টা করে কাজটুকু সেরে নেওয়ার। কিন্তু তা কখনও সম্পূর্ণ হয় না। শুধু উপস্থিতিটুকু জানাতে জানান দিতে পারে। টেনেটুনে আবার শক্তি সঞ্চয় করতে কম করে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে তার। কখনও ৭ দিন, ২১ দিন বা ৬ মাস পরও আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
সব শেষে পোর্টাল হন্টিং। এমন ক্ষেত্রে আত্মারা বড় অসহায়। প্ল্যানচেট বা অন্য যে কোনও কারণে কোনও আত্মা জীবিত জগতে চলে এসে আটকে পড়লে তার সেই অবস্থা হয়। সে আর নিজের জগতে ফিরে যেতে পারে না। তখন অসহায়ের মতো চেষ্টা করে কোনও জীবিত শরীরের কাছাকাছি থাকার। হাওড়ার মন্দিরতলায় এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির উপরের ঘরের জানলায় আচমকাই এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েছেন স্থানীয়রা। মনে করা হচ্ছে, সেও কোনও এক জগত এসে আটকে পড়েছে।
সকলকে ভূত চতুর্দশীর শুভেচ্ছা: