স্টাফ রিপোর্টার, বিধাননগর: মুখ তাক করে ছুড়ে দেওয়া অ্যাসিডে মুখটাতো ক্ষতবিক্ষত হয়েই ছিল, এই আকস্মিক বিশ্বাসঘাতকতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল হৃদয়টাও। পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা ছাপিয়ে মানসিক আঘাত নুইয়ে দিয়েছিল মেয়েটিকে। সেই ক্ষতকে খুঁচিয়ে ঘা করে দিয়েছিল পুলিশের অসহযোগিতা। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের লড়াইয়ে যে ক্ষত ক্রমশ দগদগে হয়ে উঠছিল, আদালতের একটি নির্দেশ তাতে প্রলেপ দিল। অ্যাসিড-আক্রমণকারী প্রেমিককে গ্রেপ্তার করতে কার্যত বাধ্য হল দমদম থানা। একটানা যুদ্ধের পর এখন কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার কথা মেয়েটির। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, “লড়াই তো সবে শুরু। ভারতবর্ষের হাজার হাজার অ্যাসিড আক্রান্তের হয়ে আমি রাস্তায় নামব।”
অ্যাসিড আক্রমণকারীর নাম সৌমেন সাহা। পেশায় নিরাপত্তা কর্মী। শিক্ষিত যুবক। দিনকয়েক প্রাইভেট টিউশনি করেছে বলে দাবি। রবিবার সোনারপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে দমদম থানার পুলিশ। সাধারণত যেমনটা দেখা যায়। এরকম একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর একটি নিভৃত স্থান খুঁজে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেন অনেকে। সম্ভবত এটাই রেওয়াজ। এ ক্ষেত্রে উলটো পথেই হেঁটেছেন তরুণী। সামাজিক চোরকাঁটাগুলোকে উপেক্ষা করে আদালতের দরজায় কড়া নেড়েছেন। সুবিচারের দাবিতে পারিপার্শ্বিক ট্যাবুগুলোকে তছনছ করে দিয়ে একলা পথ হেঁটেছেন। নিজের নাম প্রকাশে তাই দ্বিধা করেন না। মুখটাকেও ওড়নার আড়ালে রাখতে চান না।
[মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে ঢুকে পড়ল বাইক, চালককে ধরতে গিয়ে আহত ৩]
মেয়েটির নাম সঞ্চয়িতা যাদব। অ্যাসিড আক্রমণে তাঁর মুখের ডানদিকটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। অপারেশনের পর ডান দিকের চোখটি বাদ পড়ে। সেখানে পাথরের চোখ লাগানো। সেই চোখেই পড়াশোনো শেষ করে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। এখন টিউশনি করেন। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারে। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল? এই ঘটনার সূত্রপাত তারও পাঁচ বছর আগে। ২০০৯ সালে সৌমেনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় সঞ্চয়িতার। ঘনিষ্ঠতাও হয়। অভিযোগ, ছেলেটি সন্দেহবাতিক। পজেসিভ। তাই সম্পর্ক ভাঙতে এক প্রকার বাধ্যই হন সঞ্চয়িতা। তবে তাতে রেহাই মেলেনি। কারণে অকারণে তাঁর বাড়ি চলে যাওয়া। রাস্তায় বিরক্ত করা শুরু করে যুবকটি। তিন বছর বাদে অনেক অনুরোধ উপরোধের পর পুনরায় সে সম্পর্ক জোড়া লাগে। তবে তার আগে থেকেই অন্য একটি মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল যুবকটির। সে কথা গোপন রেখে সমান্তরালভাবে দু’টি সম্পর্কই চালিয়ে যেতে থাকে। এ কথা হঠাৎ একদিন জানতে পারেন সঞ্চয়িতা। তারপর মেলামেশা ছেড়ে দেন। তখন তাঁদের কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি প্রকাশ্যে আনার হুমকি দেয় সৌমেন।
এর কিছুদিন পর সেই ছবি ফেরত দেবে বলে সঞ্চয়িতাকে ডেকে পাঠায় সে। দিনটা ছিল ২২ সেপ্টেম্বর। পুলিশের জেরার মুখে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছে ধৃত। সে জানিয়েছে, দমদমের একটি দোকান থেকে কার্বলিক অ্যাসিড কেনে সে। তারপর সঞ্চয়িতাকে ডাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয় দু’জনের। তারপর পকেট থেকে অ্যাসিড বের করে বান্ধবীর মুখ তাক করে ছুড়ে দেয়। যন্ত্রণায় রাস্তায় বসে পড়েন সঞ্চয়িতা। তখন সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তারপর দমদম ছেড়ে প্রথমে বারুইপুর ও পরে সোনারপুরে থাকা শুরু করে। সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে দমদম থানা।
[চূড়ান্ত সতর্কতায় শুরু উচ্চমাধ্যমিক, স্পর্শকাতর কেন্দ্র ১৫০]
অ্যাসিডে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয় সঞ্চয়িতার। চিকিৎসাধীন থাকার সময়ই প্রবল যন্ত্রণা সহ্য করে পুলিশের কাছে বয়ান রেকর্ড করান। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, আক্রমণকারীকে ধরার জন্য কোনও উদ্যোগই নেয়নি দমদম থানার পুলিশ। এরপর আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। সেখানে সুরাহা না হওয়ায় হাই কোর্টে যান। চলতি মাসে হাই কোর্টের একটি নির্দেশে তৎপর হয় পুলিশ। যার ফলশ্রুতিতে সোনারপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অ্যাসিড আক্রমণকারী সৌমেনকে।
এদিন গ্রেপ্তারের পর অ্যাসিড আক্রান্ত জানিয়েছেন, “অ্যাসিডে শুধুমাত্র মুখের বিকৃতি হয় না। এই আক্রমণের ফলে বিশ্বাসের মৃত্যু হয়। এর পিছনে ক্ষমতাবানদের স্পর্ধা লুকিয়ে থাকে। জড়িয়ে থাকে বিশ্বাসঘাতকতা। আমি এই মানসিকতার শেষ দেখতে চাই। দেশে যে হাজার হাজার অ্যাসিড আক্রান্ত লড়াই চালাচ্ছেন তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জোগাতে চাই।”
[মদ খেলে ফরওয়ার্ড ব্লক করা যাবে না, পার্টিকে প্রস্তাব যুব নেতাদের]