গৌতম ব্রহ্ম: আলোর বেণু বেজে ওঠার আগেই অন্ধকার নেমে এল দুর্গার চোখে। এই দুর্গার হাতে ত্রিশূল নেই। নেই অন্য কোনও অস্ত্র। হাসপাতালের বিছানায় মায়ের কোলে শুয়ে নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে ছ’মাসের ‘দুর্গা’।
বাবার সঙ্গে শত্রুতার জেরে এক ‘অসুর’ তার দু’চোখে সিরিঞ্জ ফুঁড়ে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন মা-ও। শিশুটির নাম স্বপ্না চক্রবর্তী। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর থানা এলাকার বনহুগলির সূর্য সেন কলোনিতে। মাত্র ছ’মাস পৃথিবীর আলো দেখেছে। আধো আধো বুলি ফুটেছে মুখে। ফুটে ওঠার এই সময়েই ভয়ংকর দুর্দৈব নেমে এল তার জীবনে। পারিবারিক হিংসার শিকার হল একরত্তি মেয়েটা। চিরতরে হারিয়ে ফেলল চোখ।
[রোজ ২০ জনের সঙ্গিনী, বোনকে উদ্ধার করল দিদি]
পোড়া চোখ নিয়ে স্বপ্না এখন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডা. কুমারেশ সরকারের অধীনে ভর্তি। সোমবারই ন্যাশনালের চক্ষু বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। বিভাগীয় প্রধান ডা. কেতকী বাগচী জানিয়েছেন, শিশুটির দু’টি চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি চোখ থেকে সংক্রমণ যাতে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়ে।” জানা গিয়েছে, রেটিনা—সহ সবটাই অ্যাসিডে গলে গিয়েছে। খালি চোখে সে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। এমন ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে দুধের শিশুটির মুখাবয়ব। ঘটনার কথা শুনে শিউরে উঠেছেন রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়াপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী। তিনি জানিয়েছেন, “ভয়ংকর ঘটনা। আমি পুরুলিয়ায় আছি। কলকাতায় ফিরেই শিশুটিকে দেখতে যাব।”
স্বপ্নার বাবার নাম জয়ন্ত চক্রবর্তী। মা টুম্পা চক্রবর্তী। জয়ন্ত পুজোপাঠ করেন। কিন্তু পারিবারিক বিবাদের জেরে বেশ কয়েকমাস ঘরছাড়া। জয়ন্তর এটি দ্বিতীয় বিবাহ। প্রথম পক্ষের দু’টি ছেলে রয়েছে। অভিযোগ, জয়ন্তর অনুপস্থিতির সুযোগে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের উপর নিয়মিত অত্যাচার চালাত পরিবারের বাকি সদস্যরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর তা চরম আকার নেয়। কী রকম? টুম্পার অভিযোগ, রাত আড়াইটে নাগাদ দেওর বিপ্লব চক্রবর্তী তাঁর ঘরে ঢোকে। তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তিনি বাধা দেন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বিপ্লব। গায়ে অ্যাসিড ছুড়ে দেয়। তাতেও রাগ মেটেনি। মায়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নার চোখে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয় বিপ্লব।
সোনারপুর থানা অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। এক আধিকারিক জানিয়েছেন, জয়ন্ত চক্রবর্তী খুব একটা সুবিধার মানুষ নন। একাধিক বিবাহের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কয়েকমাস আগে জেলও খেটেছেন। এমনকী টুম্পা মেয়ে স্বপ্নাকে নিয়ে ইদানীং শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে সেনারপুর থানা। তাদের মত, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জয়ন্ত দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
[ব্যাঙ্ককর্মীকে চড় মারার হুমকি রাজ্যের মন্ত্রীর, ভাইরাল ভিডিও]
এদিন অবশ্য ন্যাশনালে মেয়ের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণই ছিলেন জয়ন্ত। জানালেন, বাড়ির কাছেই একটি ক্লাবে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই সকালে মেয়েকে নিয়ে হাজির হন টুম্পা। টুম্পার নিজের শরীরের অনেকটাই অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছে। তিনিও যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। এরপরই স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে জয়ন্ত হাসপাতালে ছোটেন। প্রথমে ন্যাশনাল মেডিক্যাল, সেখান থেকে এনআরএস হাসপাতালে যান। অভিযোগ, কেউ ভর্তি নেয়নি স্বপ্নাকে। অবশেষে অনেক টালবাহানার পর এসএসকেএম হাসপাতাল ভর্তি নেয় স্বপ্নাকে। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘ছুটি’ হয়। এরপর অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে পথে পথেই ঘুরে বেরিয়েছেন টুম্পা-জয়ন্ত।
রবিবার বিষয়টি কেন্দুয়া শান্তি সংঘের কিছু সদস্যের নজরে আসে। তারাই অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে এদিন ন্যাশনালে স্বপ্নাকে নিয়ে আসেন। সহকারী সুপার অভিষেক দে, রবিউল হাসনাতের সাহায্যে শিশুটিকে চক্ষু বিভাগে ভর্তি করা হয়। ক্লাবের তরফে সৌরভ ঘোষ জানিয়েছেন, “বাচ্চাটির ওই অবস্থা দেখে সারারাত ঘুমোতে পারিনি। মানুষ এত নৃশংস হতে পারে? আমরা চাই যারা ওর এই হাল করেছে তাদের কঠিন শাস্তি হোক।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.