অর্ণব আইচ: ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই রক্তাক্ত দৃশ্য! বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন এক বোর্ডার। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ধবধবে সাদা বিছানার চাদর রাঙিয়ে দিয়েছে। গোয়েন্দাদের অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলে, শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু ঘরে এমন কোনও সূত্র নেই যে, যা ধরিয়ে দিতে পারে ঘাতককে। হঠাৎই এক পুলিশ আধিকারিকের চোখে পড়ে রয়েছে আগের দিনের একটি দৈনিক সংবাদপত্র, ‘সংবাদ প্রতিদিন’। কাগজটি খুলে দেখেন, ভিতরে একটি পাতা গায়েব। কোথায় গেল? খুনিই কি নিয়ে গেল?
শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছিল খুনি। আর তার কাছেই মিলেছিল খোয়া যাওয়া পাতাটি। বস্তুত তদন্তের কিনারা করতে প্রধান সূত্র জুগিয়েছিল সংবাদ প্রতিদিন। কারণ হোটেলের ঘরে পড়ে থাকা কাগজ ও খুনির কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পাতাটি পরীক্ষা করে ফরেনসিক রায় দেয়,দু’টি একই সঙ্গে ছিল। অর্থাৎ, হোটেলের ওই ঘরে উপস্থিত ছিল ওই ব্যক্তি। কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজের ধারাবাহিক ‘রহস্য রবিবার’-এ প্রকাশিত হল এই কাহিনী, যা অনেক গোয়েন্দা গল্পকেও হার মানায়। ঘটনার মূলে ছিল একটি ‘বিলিয়ন ডলার নোট’। তাই পুলিশের কাছে এই মামলাটির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বিলিয়ন ডলার কেস’।
[সীমান্তে উড়ল সবথেকে বড় পতাকা, তেরঙ্গা আলোর সাজ হাওড়া স্টেশনেও]
ঘটনার সূত্রপাত ২০০৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। বউবাজারের যদুনাথ দে রোডের এক হোটেলের ১০২ নম্বর ঘরে উদ্ধার হয় আবাসিক সুমনবিহারীর দেহ। রেজিস্টার ঘেঁটে জানা যায়, সুমনবিহারী ও মতিলাল সাউ আগের দিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি চেক-ইন করেছিলেন। এক সময় মতিলাল ঘর লক করে বেরিয়ে যায়। দিনভর কেউ না আসায় ম্যানেজারের সন্দেহ হয়।
তারপর ঘর থেকে উদ্ধার হয় একটি ‘সংবাদ প্রতিদিন’ কাগজ। সেটিই একমাত্র ক্লু। পাশাপাশি নিহতের কাছে একটি ডায়েরি মেলে, যার সূত্র ধরে জানা যায় যে, তাঁর আসল নাম সুমন নয়, তপন দাস। তপসিয়ার রাইচরণ পাল লেনে পেয়িং গেস্ট থাকতেন। বাড়িওয়ালা পূর্ণচন্দ্র সাহা শুধু জানাতে পারেন, অবিবাহিত ওই ব্যক্তি ব্যবসা করতেন। হোটেল কর্মীদের কাছে মতিলালের বিবরণ নেওয়ার সময় গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন যে, সে বাঙালি। দু’জনেই নাম ভাঁড়িয়ে এসেছিল। পুলিশ শিল্পী মতিলালের ছবি আঁকেন। তপনের ডায়েরি থেকে পাওয়া উত্তর ২৪ পরগনার বহু মানুষের নাম ও ঠিকানা খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে যে, বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতিই ছিল তপনের পেশা। গোয়েন্দারা ধরে নেন, মতিলালও নির্ঘাত জালিয়াত।
[হুইলচেয়ারে বসে প্রবেশ নিষেধ, প্রশ্নের মুখে বেলুড় মঠ]
এক হোটেলকর্মীর জানান, ১০২ নম্বর ঘরে চিকেন পকোড়া দিয়ে আসার সময় তিনি তর্কাতর্কি শুনেছিলেন। একাধিকবার ‘সার্কাস’ কথাটি তাঁর কানে আসে। তদন্তের কাজে নৈহাটি পেরিয়ে জগদ্দলের দিকে যেতে গিয়ে গোয়েন্দারা যে জায়গায় চা খেতে নেমেছিলেন, তার নাম ‘সার্কাসের মোড়’। সেখান থেকেই মেলে খুনির সন্ধা। যার আসল নাম বাপি মুখোপাধ্যায়। জেরার মুখে বাপি জানায়, তপন একটি ‘বিলিয়ন ডলার’-এর জাল নোট পেয়েছিল, কিন্তু জানত না, নোটটি জাল। নোটটি মোটা দামে তপন বিক্রির চেষ্টা করছিল। নোটটি চুরি করার তাল খুঁজছিল বাপি। তাই বউবাজারের হোটেলে তপনকে নিয়ে আসে সে। বিয়ার খাওয়ার পর তপনকে গলা টিপে খুন করে নোট হাতিয়ে বাপি চম্পট দেয়। ঘর লক করে চাবিটি মুড়ে নেয় সংবাদ প্রতিদিনের একটি পাতা দিয়ে। কাগজের ফরেনসিক পরীক্ষা করে প্রমাণ করে যে, হোটেলের ঘরে ছিল বাপি।