গৌতম ব্রহ্ম: ল্যাবরেটরিতে তৈরি কৃত্রিম হাড় প্রতিস্থাপিত হল মানবদেহে। নতুন ইতিহাস রচনা করল কলকাতার একদল বঙ্গতনয়। ফের চিকিৎসাবিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখল বাংলা। যাদবপুরের ‘সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (সিজিসিআরআই)এর পৃষ্ঠপোষকতায় এল এই সাফল্য। প্রথম সারির এই সরকারি গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন পরীক্ষা চালিয়ে এই হাড় তৈরি করেছেন। যা ব্যবহার করে ‘বোন-গ্রাফটিং’ করছেন আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এখনও পর্যন্ত দু’শো রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে এই অস্থি। জানাল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি বাণিজ্যকভাবে কৃত্রিম অস্থি তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে ওড়িশার একটি সংস্থা। আরজি করের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রূপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘নিজস্ব প্রযুক্তিতে সিজিসিআরআই-এর বিজ্ঞানী ড. বিশ্বনাথ কুণ্ডু এই কৃত্রিম বোনগ্রাফট তৈরি করেছেন। প্রথমে অ্যানিমাল ট্রায়াল হয়েছে। সফল হওয়ার পর আমরা আরজি করের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের দু’শোর বেশি রোগীর শরীরে এটা বসিয়েছি। খুব ভাল ফল পেয়েছি।’ রূপবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘এই সেরামিকের হাড় শরীরের ভিতর প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর নতুন হাড় তৈরি করে, যার নাম বায়ো অ্যাক্টিভ সেরামিক বোন। এর গুণগত মান খুবই ভাল। আমরা সিটি স্ক্যান করেও দেখেছি। রোগীরাও সন্তুষ্ট।’ রোগীদের শরীরে বসানোর আগে অবশ্য বেলগাছিয়ার প্রাণী ও মৎস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অ্যানিমাল ট্রায়াল’ হয়েছে। নেতৃত্বে ছিলেন ভেটেরেনারি সার্জন ডা. সমিত নন্দী। তিনি জানান, “শরীরে অস্থি এবং তরুণাস্থি কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই অংশের কাঠামো বিকৃত হয়। তখন রোগীর শরীর থেকে অস্থি, তরুণাস্থি নিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। একে বলে অটোগ্রাফট। কিন্তু এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। ব্যথা ও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি ‘ইমপ্লান্ট’ অনেক সময় তাই মানুষের শরীরে বসানো হয়। একে বলে অ্যালোগ্রাফট। দেশীয় প্রযুক্তিতে অনেক দিন ধরেই এগুলি তৈরির চেষ্টা হচ্ছিল। অবশেষে সফল হয়েছে সিজিসিআরআই। আমরা অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের পর আরজি কর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেছে।” সমিতবাবু আরও জানালেন, “শুরুর দিকে বিশ্বনাথবাবুদের তৈরি ক্যালসিয়াম ফসফেটের স্ক্যাফোল্ড ব্যবহার করা হত। তারপর তাতে যোগ করা হল মেটালিক আয়ন। ‘অস্টিও মাইলাইটিস’-এর মতো হাড়ের সংক্রমণে এই সেরামিক স্ক্যাফোল্ড দারুণ কার্যকর। স্ক্যাফোল্ডে অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকিয়ে চিকিৎসা হয়েছে। ৩০ টির মতো পাবলিকেশন হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার দারুণ পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক পূর্ণেন্দু বিশ্বাস। তাই কাজ করে আনন্দ পাচ্ছি।”
[নিজের পছন্দ সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না, অভিভাবকদের পরামর্শ হাই কোর্টের]
সিজিসিআরআই-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ২০০৫ সালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কাজ শুরু করে। সাফল্য পেয়ে খুশি আরজি করের অধ্যক্ষ ডা. শুদ্ধোদন বটব্যাল। জানালেন, এই উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে সত্যি ভাল লাগছে। তরুণাস্থি নিয়েও গবেষণা চলছে। জানা গিয়েছে, বায়ো সেরামিক বোন তৈরি করতে ‘হাইড্রক্সি অ্যাপিটাইট’ নামে একটি পদার্থ ব্যবহার করে
ক্যালসিয়াম ফসফেটের কিউব তৈরি করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের জন্য বা বা দুর্ঘটনার জন্য ‘বোন লস’ হলে, এই ‘অস্টিও কন্ডাক্টিভ’ ও ‘অস্টিও ইন্ডাক্টিভ’ পদার্থ ব্যবহার করা হয়। দাঁত তোলার সময় ‘বোন লস’ হলে দানাকৃতি সেরামিক ব্যবহার করা হয়। আরজি করের পাশাপাশি ন্যাশনাল মেডিক্যাল, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেও ট্রায়াল হয়েছে। এইমসেও হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২ হাজার থেকে ৩ হাজার রোগীর শরীরে ব্যবহার করা হয়েছে। কর্টিকাল বোনের প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে সেরামিক বোন দিয়ে।