সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘আমি বেঁচে থাকলে নেতাজি কেন নয়?’ হইচই ফেলে দেওয়া এই মন্তব্য করে যিনি ১৩০ কোটি ভারতবাসীর মনে নতুন করে আশার ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই ২০২২ সালে পদ্মশ্রী পেয়েছেন যোগ ও সেবার জন্যে।
স্বামী শিবানন্দের কথা হচ্ছে। বারাণসীর কবীর নগরের ১২৬ বছরের বাঙালি মহাপুরুষকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে চর্চা। প্রধানমন্ত্রী নিজে মন কি বাত-এ স্বীকার করেছেন, দেশ তথা বিশ্বের সবার কৌতূহল প্রবীণতম এই মহাপুরুষকে নিয়ে। সবাই স্বামীজির দীর্ঘায়ু লাভের রহস্য জানতে চান।
শুধুই কি যোগ, প্রাণায়াম? না কি আরও বেশি কিছু? খাওয়া-দাওয়া? ঘুম?
স্বামীজি নিজে জানিয়েছেন, জিহ্বাকে সংযত রাখাই দীর্ঘায়ু লাভের অন্যতম শর্ত। মেপে খেতে হবে, মেপে কথা বলতে হবে। নেশা এবং টেনশন, দুটো থেকেই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আসলে দীর্ঘায়ু লাভের জন্য সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজন। আর সুস্বাস্থ্যের জন্য দেহ-মন আনন্দে স্পন্দিত হওয়া প্রয়োজন। যার সমস্ত উপকরণ মজুত এই দেহভাণ্ডের মধ্যেই। তবে প্রাথমিক শর্ত হল, প্রকৃতির সঙ্গে চলতে হবে। সকলকে ভালবাসুন এবং নিষ্কাম কর্ম করে যান।
প্রণামী নেন না
বারাণসীর একচিলতে ঘরেই এখন কাটিয়ে দিচ্ছেন তিন দশকের সাক্ষী থাকা এই যোগী। যিনি ‘গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর, গুরুরেব পরম ব্রহ্ম’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। গুরুর কৃপাতেই তাঁর সব কিছু হচ্ছে, সবসময় এই কথা বলেন স্বামীজি। কারও কাছ থেকে এক পয়সা প্রণামী বা ডোনেশন নেন না। কিন্তু ঈশ্বর তাঁর স্বল্প প্রয়োজনীয় সামগ্রী জুটিয়ে দেন। কেউ কিছু দিতে চাইলে, শুধু নেন হরীতকী। সংক্ষেপে এটাই স্বামীজির দীর্ঘায়ু লাভের ফর্মুলা।
স্বামীজির জীবনধারা
রাত ন’টায় ঘুম। ভোর তিনটেয় শয্যাত্যাগ। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে দিন শুরু। তারপর স্নান সেরে এক ঘণ্টার প্রাতঃভ্রমণ। হাঁটতে হাঁটতেই চলে জপ ও ধ্যান। আগে আটটা নাগাদ সামান্য কিছু খাদ্য গ্রহণ করতেন। এখন অবশ্য প্রাতরাশ করেন না। তবে ভক্তদের ভালভাবে প্রাতরাশ করতে বলেন। আর বলেন ‘মিরাকল অফ ফাস্টিং’—এর কথা। স্বামীজির পর্যবেক্ষণ, মাসে অন্তত দু’বার উপোস করা উচিত। এর ফলে শরীরে তৈরি হওয়া ‘টক্সিন’ নিষ্কাশিত হয়। স্বামীজি দিনভর ভক্তসঙ্গ করেন। হরেক কাজে ব্যস্ত থাকেন। ১.৩০ নাগাদ সারেন মধ্যাহ্নভোজ। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ নৈশভোজ সেরে বজ্রাসন করে ঘণ্টাখানেক পর ঘুমোতে যান স্বামীজি।
নো অয়েল, ওনলি বয়েল। নিরামিষ আহার স্বামীজির। রান্নায় তেল ব্যবহার হয় না। পুরো সেদ্ধ। আর কিছু মেনুতে থাক বা না থাক আলু থাকবেই। জীবনে একবারই মিষ্টি খেয়েছিলেন। এক ভক্ত পিএইচডি শেষ করার আনন্দে প্রায় জোর করে স্বামীজির মুখে দুটো রসগোল্লা পুরে দিয়েছিলেন। ওই প্রথম, ওই শেষ। জীবনে আর কখনও মিষ্টি খাননি। দুধ বা দুগ্ধজাত কোনও খাবারও (দই, ঘি, মাখন) গ্রহণ করেন না। কারণ, গরিব বা সাধারণ মানুষ সাধারণত দামি ফল বা দুধ খান না। তাঁর নিজের জীবনে অবশ্য একটা করুণ কাহিনি রয়েছে। স্বামীজির বৈষ্ণব বাবা-মা দুজনেই মাধুকরী করে দিন গুজরান করতেন। ছোটবেলায় ভাত জোটেনি, ভাতের মাড় খেয়ে ছেলেবেলায় পেট ভরাতে হয়েছে বালক শিবানন্দকে (শিবু)। অনাহারে মৃত্যু হয়েছে একমাত্র দিদির। ভক্তদের অবশ্য দুধ, ফল খেতে কখনও বারণ করেননি। কম দামি মরশুমি ফল খাওয়া নিয়েও প্রচুর উৎসাহ দেন।
সূর্যোদয়ের ব্রাহ্ম-মুহূর্তে শয্যাত্যাগ। দিনে অন্তত তিন লিটার জল পান । সকালে উঠে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিলে চোখ ভাল থাকে। প্রাতঃভ্রমণ সেরে নিয়মিত যোগ-প্রাণায়াম করুন। তেল-ঝাল-মশলাদার খাবার এড়িয়ে যান। নো অয়েল, ওনলি বয়েল নিরামিষ খান। সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করা ভাল। খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর জল পান। অতি লোভ খারাপ। ঈশ্বরচিন্তায় মনকে এমনভাবে ভরিয়ে রাখতে হবে, যাতে খারাপ চিন্তা মনে জায়গা না পায়। রাত্রে সময়মতো তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়া । সৎ চিন্তা, সৎ ভাবনা ও সৎ কর্ম।
সুস্থ থাকার চাবিকাঠির হদিশ দিলেন ডা. অরবিন্দ রায়চৌধুরী ও ডা. মণি ছেত্রী।
ডা. অরবিন্দ রায়চৌধুরী জানান, ৯৬ বছর বয়সেও রোজ সকালে হাঁটতে যাচ্ছি, এক্সারসাইজ করছি, ফুল তুলে আনছি পুজোর জন্য। শরীরকে চালনা করি। দীর্ঘ বছর চিকিৎসক জীবন কাটিয়েছি। অসংখ্য অভিজ্ঞতা, তবুও রোজ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করার। ক্রনিক ডিসেন্ট্রি আর উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া আর কিছুই আমাকে কাবু করতে পারেনি এখনও।
ভোর চারটে-তে ঘুম ভাঙে। তারপর মেডিটেশন করার মাধ্যমেই আমার দিন শুরু। এটাই আজীবন আমাকে শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে। সকাল-সন্ধে নিয়ম করে মেডিটেশন করার অভ্যাস রয়েছে সেই কর্মজীবন থেকেই। এতে মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, শান্ত রাখা যায়। যা বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়, কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন থাকি এখন বেশি। চিরকালই সাত্ত্বিক জীবনযাপন। আধ্যাত্মিকতায় মননিবেশ করলে মন শুদ্ধ থাকে। এটাই নীরোগ থাকার মূলে।
আমি মনে করি, ডিসিপ্লিন আর সততাও ভাল থাকতে খুব জরুরি। একটি শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে আর অন্যটি মানসিকভাবে শান্তি দেয়। মন ফুরফুরে রাখতে সততার বিকল্প কিছু হতেই পারে না। আজকের দিনে গাদা গাদা অসুখ আর মুঠো-মুঠো ওষুধ ছাড়া চলে না, এটা ভুল ধারণা। এব্যাপারে আমার সহজ কথা, ওষুধ কম খান, বরং নিয়মমেনে, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রতিই ঝোঁক বেশি থাকুক। ওষুধের জোরে কখনওই বেশি দিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
গত দু’বছরে করোনার প্রকোপে বয়স্কদের পাশাপাশি কত তরুণ ছেলে-মেয়ের প্রাণ গিয়েছে। তবে এই বয়সে আমাকে করোনাও ছুঁতে পারেনি। সময়মতো সস্ত্রীক ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে গিয়ে আমজনতার সঙ্গে টিকাও নিয়েছি। সবই সম্ভব হয়েছে মনের জোরে ও ডিসিপ্লিনড জীবনযাপনের জন্য।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একটাই জিনিস মানি, হালকা খাই, কম খাই। মাছ-ভাতে বাঙালি আমি। সকালে পুজো সেরে চা-বিস্কুট খেয়ে তারপর জলখাবারে হালকা খাবারের সঙ্গে মরশুমি ফল নিত্য থাকে। তারপর দুপুরে অল্প আহার। সন্ধেবেলায় চা, সঙ্গে হালকা কিছু খেয়ে রাতের খাবার মোটামুটি ১০টার মধ্যেই খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। রাতে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বই পড়ে তারপর শুতে যাই। অবসরে বই-ই সম্বল। যখন বয়স অল্প ছিল, তখন ঘুরতে যেতাম খুবই। বিশেষত তীর্থক্ষেত্রে যেতেই বেশি মন চাইত। গঙ্গোত্রী, গোমুখ, কাশ্মীর, কেদার-বদ্রী, কিন্নর—— সব ঘুরেছি। ডাক্তারির পাশাপাশি সময় পেলেই প্রচুর বেড়াতে গিয়েছি। মন থেকে চিরকাল চেষ্টা করেছি উৎফুল্ল থাকতে।
আমি মনে করি দীর্ঘায়ু হওয়ার পিছনে বংশগত একটা ফ্যাক্টরও কাজ করে। তাছাড়াও কিছু জিনিস জীবন থেকে বাদ দেওয়া উচিত। আমি এই দীর্ঘ জীবনে কখনও মদ-সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি।
সব শেষে একটা কথাই বলব, যখন কোনও ব্যাপারে বেশি চিন্তিত হবেন মেডিটেশন
করুন। খারাপ সময়ে, বিপদে ভগবানই একমাত্র আস্থা-ভরসার জায়গা। বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাওয়াই জীবন।
ডা. মণি ছেত্রী জানান, ১৯২০ সালের ২৩ মে আমার জন্ম। ২০২২ সালে ১০২ তে পড়লাম। ১০২! ভাবছেন এত বয়সে কি আদৌ সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায়? আমি বলব নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করলে কোনও ব্যাপারই নয়। আমার চেয়ে বেশি বয়সি মানুষজনও গটমট করে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
এখন প্রশ্নটা হল, সুস্থ থাকবেন কোন উপায়ে? যেখানে সদ্য করোনার মতো ভাইরাস নাকানি—চোবানি খাইয়েছে গোটা বিশ্বকে। করোনা ভাইরাস ক্রমশ স্তিমিত। আগামী দিনে কিন্তু আরও নতুন ভাইরাস আসতে পারে। ঋতু পরিবর্তনের সময় ভাইরাস ব্যাকটিরিয়ার বাড়বাড়ন্ত তো আছেই।
শরীরের দরজা টেকসই হলে তা পেরিয়ে কোনও ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে না। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চাঙ্গা রাখতে নিয়ম করে গল্প করুন।
মন ভাল রাখুন। দুশ্চিন্তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। মন যদি সতেজ থাকে, অনেক খারাপ শরীরও তরতাজা হয়ে ওঠে। আমার দীর্ঘ ৭৫ বছরের চিকিৎসা জীবনে আমি এমন উদাহরণ অনেক দেখেছি। শহরে অনেক প্রবীণ একা থাকেন। ছেলেমেয়েরা বাইরে।
প্রবীণদের মন ভাল রাখতে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
সকলকে বলব একটু পরিশ্রম করুন। শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে চর্বি জমে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে ওজন ঠিক রাখতে কোনও জিমে যেতে হবে না। শুধু নিয়মিত হাঁটুন। আমি এই ১০২ বয়সেও প্রতিদিন আধ ঘণ্টা হাঁটি। ঘাম ঝরাই। নবীন প্রজন্মকে বলব, বৃদ্ধ মা-বাবাকে রোজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও খোলা জায়গায় আনুন। কোনও হাঁটাহাঁটি না করলে কিন্তু প্রবীণ ব্যক্তিদের পেশিতে সমস্যা হয়।
আমার হাত ধরেই এসএসকেএম হাসপাতালে তৈরি হয় ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট তথা আইটিইউ সেটআপ। এনডোক্রিনোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, ডায়াবিটিস, রিউম্যাটোলজির মতো আলাদা আলাদা বিভাগ চালু হয়। যা রাজ্যের কোনও হাসপাতালে প্রথম। সেখানে আমি লক্ষ করেছি আম বাঙালির রোগের কারণ দুটো। অ্যালকোহল আর সিগারেট।
করোনায় তো রাজ্যে অগুনতি মানুষ মারা গিয়েছেন। খবরের কাগজেও বেরিয়েছে। সেই মৃত্যুর খতিয়ান খতিয়ে দেখুন। যাঁদের কোমর্বিডিটি রয়েছে তাঁরাই মারা গিয়েছেন। সুগার, উচ্চরক্তচাপ, সিওপিডির মতো ফুসফুসের অসুখগুলোই তো ভয়ের কারণ। এই অসুখগুলোর জন্যও আমরাই দায়ী। কই আমার তো কোনও কোমর্বিডিটি নেই। কারণ জীবনে অ্যালকোহল, সিগারেটে হাত দিইনি। অ্যালকোহল, সিগারেট বাদ দিয়ে দিন। যাঁরা এখনও সিগারেট ছাড়তে পারেননি, ছুড়ে ফেলে দিন ওই জঞ্জাল।
ধূমপানের কারণে চোখে কমবয়সেই ছানি পড়তে পারে। নিয়মিত ধূমপান চোখে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়। শতায়ু চিকিৎসক হিসাবে আর একটা পরামর্শ দেব। মারাত্মক সমস্যা না হলে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.