দিল্লি বেশি দূর নয়, কলকাতার দূষণের মাত্রার সূচক রাজধানীর প্রায় কাছাকাছি। ভোররাতে এই শহর গ্যাস চেম্বারের আকার নিচ্ছে। আসছে শীত, আরও বাড়বে ধোঁয়াশা। ক্ষতিগ্রস্ত শ্বাসনালি, ধুকপুক ফুসফুস। অসুখের গভীরতা বুঝিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট পালমোনোলজিস্ট
ডা. ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন গৌতম ব্রহ্ম।
বিপজ্জনক সীমা তো আগেই অতিক্রম করেছে, কলকাতার দূষণ এখন সহ্যসীমারও অনেক ওপরে ঘোরাফেরা করছে। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকের মতো গ্রিন জোনেও দূষণের মাত্রা কখনও কখনও অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
কলকাতা বিশ্বের সব থেকে দূষিত শহর বললেও অত্যুক্তি হবে না। সম্প্রতি কলকাতার মার্কিন দূতাবাসে থাকা দূষণ পরিমাপক যন্ত্র জানায়, পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে দূষণের পরিমাণ স্বাভাবিক সহ্যসীমার অনেক উপরে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ, শহর জুড়ে ফ্লাই ওভার এবং মেট্রো রেলের পথ নির্মাণের কাজ চলছে, যার দরুন বাড়ছে দূষণ৷ দ্বিতীয়ত, আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ডিজেল চালিত ট্রাক অবাধে যাতায়াত করছে শহরের রাস্তায়৷ প্রায় সব বড় মাপের বাণিজ্যিক যান ডিজেলে চলে। কয়লার উনুনের ব্যবহার, জঞ্জাল পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষতিকর অভ্যাসও রয়েছে। আসলে, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে এলে, হাওয়ার গতি কমে গেলেই এই দূষণ জমির পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার মধ্যে আটকে পড়ে, যা প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস বিপজ্জনক করে তোলে৷
গ্রীষ্ম ও বর্ষায় হাওয়া বেশি থাকে বলে ধূলিকণা কম। দেওয়ালির সময় হাওয়া সাধারণত খুব খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ায় এবার বেঁচে গিয়েছে কলকাতা। আবার ধুলো বাড়তে শুরু করেছিল। বুলবুল কমিয়েছে।
ধোঁয়াশার গল্প
বাংলায় ধোঁয়াশা বলে একটা শব্দ আছে। এর পিছনে একটা গল্প আছে। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে চার-পাঁচদিন একাটানা ঘন কুয়াশা হয়। ওই ক’দিন মৃত্যু সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই পরিবেশ সচেতনতা ও ধোঁয়াশা নিয়ে নড়েচডে় বসে গোটা বিশ্ব। আসলে আগে ব্রিটেনে কয়লা জ্বালিয়ে সবাই ঘর গরম করত। সবসময় বাড়ি থেকে উনুনের মতো ধোঁয়া বেরত। কুয়াশার সঙ্গে সেই ধোঁয়া মিশে তৈরি করত ধোঁয়াশা। যা ফুসফুসের দফারফা করত। শ্বাসকষ্ট বাড়ত ফুসফুসের অসুখে ভোগা রোগীদের।
বাহান্নর ঘটনার পর ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’ পাস করে কয়লা ব্যবহার কমিয়ে ফেলে রানির দেশ। গ্যাস ও ইলেকট্রিক হিটারের ব্যবহার বাড়ে। আর আমরা?
শীতকালে বায়ূদূষণ বাড়ে
এখনও বাতাসে ধোঁয়া কমাতে পারিনি। কালীপুজোর সময় এখনও সারি সারি মোমবাতি জ্বলে জানালার গ্রিলে, ছাদের রেলিংয়ে। সবাই দূষণের জন্য শব্দবাজিকে কাঠগড়ায় তোলে। কিন্তু আতশবাজি কম দায়ী নয়। আতশবাজিতে প্রচুর ধোঁয়া হয়। অনেক রকমের দূষিত গ্যাস বাতাসে মেশে। অর্থাৎ শীতে বাতাসের গুণগত মান খুবই খারাপ হয়ে যায়। অক্সিজেনের ঘনত্ব কমে। ফলে, ফুসফুসের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন তাঁদের কষ্ট বাড়ে এই সময়। অসুখের প্রকোপ বাড়ে। তবে, বাকিদেরও সমস্যা কম হয় না। কারণ, বাতাসে দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায়।
মিউকাসের দারোয়ানি
শ্বাসগ্রহণের সময় আমাদের শরীরে প্রচুর ধুলোবালি ঢোকে। সমস্যা হয় না। কারণ, শ্বাসনালির নিজস্ব একটা সাফাই ব্যবস্থা আছে। একটু-আধটু নোংরা ঢুকলে পরিষ্কার করে ফেলতে পারে। কিন্তু তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। আসলে, আমাদের শ্বাসনালিতে স্বাভাবিক অবস্থাতেও প্রতিদিন মিউকাস তৈরি হয়। সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ৩০ মিলিলিটার। দারোয়ানের ভূমিকায় থাকা এই মিউকাস কিন্তু কাশি বা শারীরিক অসুবিধা তৈরি করে না। কিন্তু সালফার-ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনো-অক্সাইডের মতো গ্যাস শ্বাসনালিকে উত্তেজিত করে। এগুলি বেশি ঢুকলে মিউকাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই শরীর বিদ্রোহ করে। সংক্রমণ হয়।
নগরায়ন হাঁপানি বাড়িয়েছে
ধুলোবালি শ্বাসতন্ত্রের সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে হাঁপানির উদ্রেক করে। শহরে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেশি। শিল্পায়ন, নগরায়ণের ফলে ঝুঁকি বাড়ছে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেরও। এটি দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ।
ধূমপায়ীদের বিপদ বেশি
ধূমপায়ীদের ঝুঁকি বেশি। ধূমপায়ীদের শরীরে কার্বন মনো-অক্সাইড বেশি থাকে। তাই ধূমপান-তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যা-ই হোক না কেন-অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এছাড়া কলকারখানার রাসায়নিক ফুসফুসের স্বাভাবিক কলাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে এবং শক্ত ও দানাদার করে তুলতে পারে। একে বলে ফাইব্রোসিস বা আইএলডি। নালা দিয়ে যদি জল মুক্তভাবে বইতে পারে তবে সেখানে দুর্গন্ধ হয় না। ময়লা জমতে পারে না। কিন্তু জল আটকে গেলেই মশা-মাছি, পোকা মাকড়ের উপদ্রব হয়। তেমনই আমাদের শ্বাসনালি।
মুখঢাকা হেলমেট
দূষণ ফুসফুসের সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। রোগীরা সমস্যায় পড়েন। এই কারণেই শীতে বাড়তি সাবধানতা দরকার। যেদিন রাস্তাঘাটে ধোঁয়া-ধুলোর পরিমাণ বেশি মনে হবে, সেদিন যত সম্ভব ‘ইন্ডোর অ্যাক্টিভিটি’ করতে হবে। যাঁরা মোটরসাইকেল চালান, তাঁদের উচিত কাচ দিয়ে মুখ ঢাকার ব্যবস্থা থাকা হেলমেট ব্যবহার।
বাচ্চাদের সামলে রাখুন
উচ্চতা কম হওয়ায় বাচ্চারা বেশি ভোগে। মাটির কাছাকাছি ধুলোর পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে ধুলো শ্বাসনালিতে বেশি ঢোকে। তাই বাচ্চা নিয়ে বাড়তি সাবধানতা প্রয়োজন শীতকালে।
স্টিম ইনহিলেশন, নাসাপান
কয়েকটা জিনিস মেনে চলতে পারলে ভাল। যেমন ‘স্টিম ইনহিলেশন’। জল গরম করে তার বাষ্প নাক-মুখ দিয়ে নেওয়া। বাজারে এখন খুব ভাল ইনহিলেশন সরঞ্জাম পাওয়া যায়। তবে অত কিছুর দরকার নেই। একটি বড় মুখওয়ালা পাত্রে (যেমন হাঁড়ি) জল ফুটিয়ে গ্যাস নিভিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে শ্বাস নেওয়া যেতে পারে। নাক দিয়ে জল টানা যেতে পারে। এগুলি ন্যাচারোপ্যাথি। ভাল উপকার মেলে। বাজারে অনেক রকম ন্যাসাল স্প্রে পাওয়া যায়। নাক বন্ধ হয়ে গেলে এগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। ভাল ফল মেলে।
প্রতিষেধক
ইদানীং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঠেকাতে নিউমোনিয়া-সহ হরেক রোগের প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়। এগুলি যে একশো শতাংশ রোগ প্রতিরোধ করতে পারে তা নয়। তবে সংক্রমণের উপদ্রব অনেকটাই কমায়।
মাস্ক পরবে কী?
ভাল মানের মাস্ক পরা যেতেই পারে। তবে তা খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। ফোনে কথা বলতে অসুবিধা হয়। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে মাস্ক কিনতে হবে। তবে, মনে রাখত হবে, মাস্ক ব্যবহার করলেও মাইক্রো প্লাস্টিকের মতো ক্ষুদ্র কণা ঢোকে। যাঁরা ধূলিময় এলাকায় কাজ করেন, যেমন রাস্তা বা দালানের শ্রমিক, তাঁরা বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।