সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বহতা সময়ের স্রোতে অন্তঃসলিলা হয়ে থাকে একটি নদী৷ গঙ্গা-যমুনার স্রোতের তলায় ত্রিবেণী সঙ্গমে যেমন বয়ে চলে সরস্বতীর স্রোত৷ সময় তো থেমে থাকে না৷ তা যত এগোয় বদলের নিয়মে পরির্বতনের পৃথিবী রং বদলায়৷ সামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুতেই লাগে পাল্টাহাওয়া৷ কৈশোরের খেলাধুলো, যৌবনের বোহেমিয়ানা সব বন্দি হয়ে পড়ে সাংসারিক চৌহদ্দিতে, চাহিদাপূরণের অঙ্কে৷ তারপর হঠাৎ একদিন অফিস অঞ্চলে চমকে দিয়ে কেউ প্রশ্ন করে, বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি৷ আর অমনি আমরা টের পাই কতদিন দেখা হয়নি সেই গোপনে বয়ে চলা নদীটির সঙ্গে৷ সময়, জীবনের স্রোতের নীচ দিয়েই বয়ে চলে যে স্রোত, তা বন্ধুতারই৷ সব বদলালেও যার রং বদলায় না৷
বন্ধুতার কত স্মৃতিই বন্ধুদের বুকে বুকে জমা হয়ে আছে৷ সে সবই ব্যক্তিগত৷ তবে কিছু সার্বজনীন বন্ধুতার নমুনাও সকলের কাছেই তোলা আছে বলা যায়৷ যেমন বন্ধুত্বের অমর জুটি বলতেই যেমন মনে আসে আইকনিক ‘শোলে’ সিনেমার জয়-বীরুর কথা৷ দু’জনের পাগলামো থেকে সাহসিকতা কবে যেন হিন্দি ছবির চিত্রনাট্য ছাপিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় সমাজের মঙ্গলকাব্যেও৷ সত্তরের দশক যখন বন্ধুতা বিষয়টি নানা বাঁক নিচ্ছে, রাজনৈতিক পরিবেশ যখন বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে দিচ্ছে, শত্রুর শত্রুকে বন্ধু করে তুলছে, তখন রমেশ সিপ্পি এনেছিলেন এমন এক জুটিকে, যারা দাবিহীন নিপাট বন্ধুত্বের কথাই শুধু বলে৷ রাজদ্বার থেকে শ্মশানে- পাশে থাকার যে অহংকার বন্ধুতার অলংকার, বন্ধুত্বের যে সংজ্ঞা চিরন্তন ভারতীয় সমাজের মজ্জাগত, তার আধুনিক রূপটি কেমন হতে পারে, তাই দেখিয়ে দিলেন চিত্রনাট্যকার৷ ফলত ছবির বাস্তবতা পেরিয়ে বাস্তবের ছবি হয়ে উঠতে দেরি হয়নি এ জোড়ির৷
আর একটু পিছিয়ে গেলে সেলুলয়েডেই পেয়ে যাওয়া যায় এরকম দুই অমর বন্ধুকে- গুপি ও বাঘা৷ ঠাকুরদার কাহিনী থেকে তাদের তুলে এনে পর্দায় জীবন দেন সত্যজিৎ রায়৷ প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে সমাজদর্শন- কতকিছুই না তারা বহন করেছে, আর সে সবই করেছে যৌথপ্রয়াসে৷ এই যূথবদ্ধতা নজরকাড়া৷ গুপি গান না ধরলে বাঘা বাঘের মুখ থেকে সিন্দুকের চাবিটা আনবেই বা কেমন করে! পূর্বপরিচয়হীন দুই ভাগ্যবিড়ম্বিত যুবক পরবর্তীকালে যতই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুক না কেন, বাংলা সংস্কৃতি মহল তাদের স্মরণে রেখেছে দুই ভালোমানুষ বন্ধু হিসেবেই৷
একজন বেজায় রোগা৷ অন্যজন বেশ মোটা৷ আর তাঁরা আসা মানেই সাদাকালো পর্দা হাসিতে রঙিন৷ এরপর আর বলে দিতে হবে না, কাদের কথা হচ্ছে৷ হ্যাঁ লরেল এবং হার্ডি৷ হাস্যরসকে তাঁরা কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন সে তো আলাদা প্রসঙ্গ, কিন্তু এই বন্ধু জুড়িটি ছাড়া হাস্যরসের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনই খালি বন্ধুতার ইতিহাসও৷
এ তো গেল দুই হুজুরের গপ্পো৷ তবে মানুষ না হয়েও যে বন্ধুত্বের মাইলস্টোন হয়ে ওঠা যায়, যে নমুনা রেখেছে টম অ্যান্ড জেরি৷ যদিও খুনসুটি, শয়তানির মোড়কে তাদের সম্পর্ক মোড়া৷ কিন্তু এমনই বন্ধুতার তারে বাঁধা এ দুই কার্টুন চরিত্র যে, একটিকে ছাড়া আর একটি অসহায় প্রায়, বলা ভাল অস্তিত্বহীন৷ আর তাই যত বিবাদই থাক না কেন, শেষমেশ এদের নাম একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়৷ কে না জানে বন্ধুত্বের গোপন কথাই এটাই- যত অম্লতাই থাক না কেন, সম্পর্ক শেষমেশ মধুর৷
আবার টিনটিন আর কুট্টুশ থুড়ি স্নোয়ির কথাটা ভাবুন৷ দু’জন দুই প্রজাতির, কিন্তু তাতে কী! এদের দু’জন ছাড়া কোন অ্যাডভেঞ্চারই বা জমবে!
যদি বন্ধু মানে হয় সমস্ত চড়াই-উতরাইয়ে পাশে থাকা, তবে জীবন্তের সীমানা টপকেও বন্ধুতার দাবি তুলবে কিছু জিনিস৷ যেমন ধরা যাক, পেনসিল ও রবার৷ হাতে পেনসিল থাকলেও হিসেব যদি না মেলে তবে তো কেলোর কীর্তি৷ কেঁচে গণ্ডূষ করতে তাই পাশে রবার মাস্ট৷ বলা যায় একটা ছাড়া আর একটার দিব্যি অস্তিত্ব আছে৷ তবে লেখালেখির পুরো প্রক্রিয়ায় এরা একে অন্যের পরিপূরক৷ ঠিক যেরকম এক বন্ধু টিফিন বক্স এগিয়ে দেয় আর এক বন্ধুকে৷
এই পরিপূরক হয়ে ওঠার তালিকায় অবশ্যই নাম লেখাবে মোবাইল ফোন ও চার্জার৷ একটির পাশে আর একটি না থাকলে আধুনিক সময়ের কমিউনিকেশন বিপ্লবটাই লাটে উঠত৷ যেমন শক্তিশেলাহত লক্ষণকে নিয়ে বিপাকে পড়া রামের পাশে হনুমান না থাকলে বদলে যেতে পারত মহাকাব্যের বয়ান৷
এরকম কত বন্ধুই যে আমাদের চোখের সামনে পাশপাশি থাকে৷ বাঁয়া-তবলার মধ্যে গোপনে কোনও ছন্দ বিনিময় হয় কি না কে জানে! সে নয় তালজ্ঞান বিবেচনার অধীন, কিন্তু খুলে রাখা দু’পাটি চটি যে একে অন্যের জন্য কতটা পরিপূরক, একটি ছাড়া অপরটি যে অকেজো প্রায়, সে তো সহজেই অনুমেয়৷ এমন অমরসঙ্গী আর কোথায় মিলবে! নিশুত রাতে ফাঁকা ব়্যাকে এরাও কোনও বন্ধুতার আলাপে মাতে কি না, মানুষের পৃথিবী অবশ্য কোনওদিন তার খোঁজও পায় না৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.