মৌশাখী বোস: এতদিন ভিলেন বলেই নামডাক ছিল৷ কিন্তু এখন নিজেই দুশমনকে প্রতিরোধ করছে৷ শিরদাঁড়ায় আঘাত কিংবা হাঁটুতে সমস্যা– অপারেশনের বিকল্প স্টেরয়েড৷ জটিল অস্ত্রোপচার না করে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন নিয়ে দিব্যি ভাল থাকছেন রোগী৷
কী ভাবে? জানতে হলে স্টেরয়েড কী, সেই দিকে একটু তাকানো দরকার।
স্টেরয়েড কী:
স্টেরয়েড হল প্রাণীদেহে স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন একপ্রকার জৈব যৌগ৷ যা মূলত স্ট্রেস দূর করতে এবং বয়ঃসন্ধির সময় শারীরিক গঠন তৈরিতে কাজে লাগে৷ একই সঙ্গে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সাধারণত অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ হিসাবে ব্যবহৃত হয় নানা ব্যথা নিরাময়ে৷ একবার স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন নিলে ৩-৬ মাস দিব্যি ভাল থাকা যায়৷
স্থায়িত্ব অনুযায়ী স্টেরয়েড মূলত তিনভাগে বিভক্ত–
• শর্ট অ্যাকটিং স্টেরয়েড: এই ওষুধগুলো মূলত ৫-৭ দিনের কোর্সে দেওয়া হয়৷ যেমন Hydrocortisone৷
• ইন্টারমিডিয়েট অ্যাকটিং স্টেরয়েড: এই স্টেরয়েডগুলো ২-৪ সপ্তাহ দেওয়া হয়৷ যেমন Prednisone এবং Methylprednisolone৷
• লং অ্যাকটিং স্টেরয়েড: এই স্টেরয়েডগুলো দীর্ঘদিন ধরে দেওয়া যায়। তবে খুবই অল্প পরিমাণে! যেমন Dexamethasoneþ৷
ব্যবহারের প্রকার:
স্টেরয়েডকে ব্যবহারের দিক থেকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়–
• ওরাল মেডিসিন অর্থাৎ ওষুধটি খাওয়া হয়৷ এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে দেওয়া হয়৷
• ইনজেকটেবল অর্থাৎ ইনজেকশন হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়৷ এক্ষেত্রে ট্রপিকাল মানে চামড়ায় ইনজেকশন, ইন্ট্রা-আর্টিকুলার মানে জয়েন্টে ইনজেকশন এবং ইন্ট্রা-ভাসকুলার অর্থাৎ ভেইনে ইনজেকশন দেওয়া হয়৷ জয়েন্ট পেইন ও স্পাইনালের সমস্যায় এই প্রকার ওষুধ চিকিৎসকেরা দিয়ে থাকেন৷
স্টেরয়েডের সুবিধা:
• দ্রুত ব্যথা নিরাময় করে।
• দৈনন্দিন কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।
• পেন কিলার খেতে হয় না।
• মাংসপেশির দৃঢ়তা বাড়িয়ে তোলে।
• প্যারালাইসিস হওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
• ইনফ্লেমেশন দূর করে।
সতর্কতা:
হার্বাল ক্লিনিকগুলোও এখন যথেচ্ছ পরিমাণে স্টেরয়েড ব্যবহার করছে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন৷
• স্টেরয়েড সব সময় স্বল্প মাত্রায় স্বল্প দিনের ব্যবধানে দেওয়া উচিৎ৷
• ওরাল স্টেরয়েড খাওয়ার পর অ্যান্টাসিড খাওয়া জরুরি৷
• রাতে স্টেরয়েড নিলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়৷
• চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধের দোকান থেকে স্টেরয়েড কিনবেন না৷
• চিকিৎসককে স্টেরয়েড লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ কখনই নয়!
• ব্লাড প্রেশার ও সুগার নিয়ন্ত্রণে রেখে স্টেরয়েড নেওয়া উচিৎ৷
• স্টেরয়েডের ডোজ ও কোর্স একমাত্র চিকিৎসকই নির্বাচন করবেন৷
• স্টেরয়েড চলাকালীন কোনও প্রকার উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসককে জানান৷
স্টেরয়েডের ব্যবহার:
• স্লিপ ডিস্ক: দীর্ঘ সময় বাইক চালালে বা কোনও দুর্ঘটনা হলে স্লিপ ডিস্ক হয়৷ এক্ষেত্রে মূলত কোমরে ব্যথা হয়৷ চিকিৎসক ফিজিওথেরাপির সঙ্গে অসহ্য ব্যথা কমানোর জন্য ৫-৭ দিনের একটি শর্ট কোর্স স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন৷
• স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি: দুর্ঘটনার ফলে এখন হামেশাই স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি দেখা যায়৷ এক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্ট্রা-ভাসকুলার স্টেরয়েড ইনজেকশন না দিলে রোগীর প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে৷ তাই এক্ষেত্রে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার হাত থেকে স্টেরয়েড রক্ষা করে৷
• সারভাইকাল স্পনডিলোসিস: বয়স্কদের মধ্যে মূলত এই প্রকার সমস্যা দেখা যায়৷ এক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রথমে ফিজিওথেরাপি ও কিছু মেডিসিন দেন৷ তাতে যদি ভাল কাজ না হয়, তখন ডিপোমেডরল স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে লোকাল অ্যানাস্থেসিয়ার দ্বারা ফেমেট জয়েন্ট ব্লক করা হয়৷
• টেনিস এলবো: দীর্ঘদিন ভারী কাজ করার জন্য বা অত্যধিক কনুইয়ের মুভমেন্টের কারণে (বিশেষ করে খেলোয়াড়দের) এই রোগটি হয়৷ কনুইয়ে অসহ্য যন্ত্রণার পাশাপাশি এর চারপাশের টেনডন ড্যামেজ হয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে চিকিৎসক ব্যথা কমানোর জন্য শর্ট অ্যাকটিং স্টেরয়েড দেন৷
• প্লান্টার ফ্যাসাইটিস বা হিল স্পার: এটি একটি ক্রনিক ডিজিজ৷ এক্ষেত্রে গোড়ালির হাড় বেড়ে যায়, ফলে হাঁটাচলা করলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়৷ ওষুধ, ডক্টর-শ্যু প্রভৃতি দিয়ে চিকিৎসা করে কোনও ফল না পাওয়া গেলে গোড়ালিতে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ইনজেকশন দেওয়া হয়৷
• টেনডন নি: হাঁটুর অতি পরিচিত ইনজুরি হল টেনডোনাইটিস৷ কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক স্টেরয়েড দেন৷ মূলত লোকাল স্টেরয়েড দেওয়া হয়৷
• রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি অটো ইমিউন ডিজিজ৷ এক্ষেত্রে রোগীর জয়েন্টগুলিতে প্রদাহের কারণে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভূত হয়৷ প্রয়োজন বিশেষে চিকিৎসক শর্ট অ্যাকটিং ওরাল স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন৷
• ফ্রোজেন সোলডার: এক্ষেত্রে কাঁধের রেঞ্জ ওফমোশান একেবারেই কমে গিয়ে প্রায় স্টিফ হয়ে যায়৷ প্রয়োজন হলে চিকিৎসক স্টেরয়েড ইনজেকশন দিয়ে থাকেন৷
• আর্থ্রাইটিস: কিছু ক্ষেত্রে আর্থ্রাইটিসের জন্য সিঙ্গল জয়েন্ট ডয়েলিং হয়, তখন অসহ্য যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসক ইন্ট্রা-আর্টিকুলার ইনজেকশন দিয়ে থাকেন৷
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
স্টেরয়েড হল এমনই এক ওযুধ যা যন্ত্রণা নির্মূল করতে বিশেষ কার্যকরী৷ কিন্তু চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া যথেচ্ছ ব্যবহার করা হলে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়৷
• ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেড়ে যায়।
• ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়।
• দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে হাড় ভঙ্গুর (অস্টিওপোরোসিস) হয়।
• দীর্ঘদিন ব্যবহারের দরুণ সাইকোলজিক্যাল সমস্যা (সাইকোসিস) হতে পারে।
• শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) হ্রাস পায়।
• গ্যাসট্রিক আলসার হয়।
• চামড়ার ঘনত্ব কমে আসে।
• স্পাইনাল ইনজুরি বা ফ্র্যাকচার হয়।
• দেহে লোমের আধিক্য হয়।
• মহিলাদের গলার স্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়।
আরও জানতে কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় ও অ্যাপোলো হাসপাতালের বিশিষ্ট অর্থোপেডিক ডা. আব্রার আহমেদকে ফোন করুন। ডা. পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন 9831024067 নম্বরে। ডা. আব্রার আহমেদের যোগাযোগ নম্বর 8697179440। এছাড়া ক্লিক করে দেখে নিন epaper.sangbadpratidin.in