সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: পশ্চিমের সাঁওতাল পরগণা নিয়ে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, “বিশেষ করে আমার বলবার বিষয়, এই সাঁওতাল পরগনা, দক্ষিণ বিহার, সিংভূম ও মধ্যপ্রদেশের অরণ্য প্রদেশ মানুষের প্রতি ভয়ানক নিষ্ঠুর…খাওয়ার পর্যন্ত বিশেষ কোনও ফল নেই। মুনি-ঋষিরা আর যে কোনো বনেই বাস করুন, এই সব স্থানের বনে নিশ্চয়ই বাস করতেন না, করলে অনাহারে মারা পড়তেন”।
যে পশ্চিম নিয়ে বিভূতিভূষণ এরকম কথা লিখেছিলেন, আজ আমরা সেই পশ্চিমেই বাঙালির ভ্রমণ নিয়ে কথা বলব।
বাঙালির পশ্চিম মানে কিন্ত মূলত শিমুলতলা, মধুপুর, গিরিডি এবং দেওঘর। আর আদি অনন্তকাল ধরে বাঙালি এইসব জায়গায় বেড়াতে যায় না, বরং বাঙালি পশ্চিমে যায় চেঞ্জে। তাই মধুপুর কিংবা শিমুলতলায় পর্যটক নয়। যারা যায়, তাঁরা মূলত চেঞ্জার বাবু।
[সিনেমা নয়, খাস বাংলাতেই আমাজন অভিযানের স্বাদ সিকিয়াঝোরায়]
আর বাঙালি তো ভ্রমণপিপাসু, তাঁরা সারা বছরই ছুটির ফাঁদে পা গলিয়ে আছে। তাদের মন সবসময়ই বেড়াই বেড়াই করে, আর বেড়াতে যাওয়ার জায়গাটা যদি হয় কাছেপিঠে তবে তো কথাই নেই।
সামনেই রয়েছে বেশ কয়েকদিনের ছুটি, তাই টুক করে ঘুরে আসুন থুরি চেঞ্জে যান, পশ্চিমের শিমুলতলায়! হয়ত আগের মতো সারি সারি শিমুল গাছ আর নেই। তবে ছোটখাটো জঙ্গল, ইউক্যালিপ্টাসের সারি, চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড় আর সবুজের সমারোহ এখনও একইরকম আছে। আর সঙ্গে রয়েছে অজস্র কুঠি বাড়ি বা ভিলা। যেগুলির বেশিরভাগেরই মালিক ছিলেন বাঙালি। তবে মালিকানা এখন বদল হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘মহাপুরুষ’ ছবির মনোরম সূর্যাস্তের দৃশ্যের সাক্ষীও কিন্ত এই জায়গাই। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়তেই ডাইনে বাঁয়ে স্টেশন রোডে অতীতে গড়ে উঠেছিল স্বাস্থ্য গড়ার আনন্দ নিকেতন। টিলা টিলা শিমুলতলায়, ভিলা ভিলা বাড়ি। যদিও ঐতিহ্য থাকলেও ভেঙে পড়েছে বেশিরভাগ ভিলাই। কারণ বাড়ির দেখাশুনা করবে কে? নতুন প্রজন্মের সকলেই যে দেশের বাইরে। আর যে কয়েকটা ভিলা বা কুঠিবাড়ি অবশিষ্ট। তা সারিয়েই চলছে ‘হোম স্টে’। সাহস থাকলে ভূতুড়ে কুঠিতে রাত কাটাতেও পারেন পাঠক। তবে তা নিজের দায়িত্বে। অবশ্য এখন থাকার জন্য অনেক রিসর্টও হয়েছে ওখানে।
[অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে আগ্রহী? জঙ্গলমহলে চালু হচ্ছে নতুন আটটি ট্রেকিং রুট]
বাঁদিকে সে কালের হাউজ অফ লর্ডস আর ডানদিকে হাউজ অফ কমন্স। চারপাশ ঘিরে দিকচক্রবাল রেখা ঢেকে প্রহরী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়শ্রেণি। খুবই শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্জন পরিবেশে স্বাস্থ্যকর স্থান শিমুলতলা। নিসর্গের রূপকথা, মনোরম প্রকৃতি, আবহাওয়া স্বাস্থ্যপ্রদ। স্বাস্থ্যান্বেষীদের অবকাশ যাপনের মনোরম জায়গা অধুনা মুঙ্গের জেলার এই শিমুলতলা।
যদিও শিমুলতলা বিহারে তবু ‘বাঙালির পশ্চিম’ থেকে একে বাদ দেওয়া যায় না। পাহাড়, টিলা, শাল, মহুয়ার অরণ্যে ঘেরা গ্রাম দেখতে দেখতে হারিয়ে যান ভোরের শিশির ভেজা লাল মোরামের পথে পথে। ওখানে ট্রেন থেকে নামলেই দেখতে পাবেন পাহাড়ি ম্যালের মতো ওখানকার রেল স্টেশন। আর রেল স্টেশনের মুখোমুখি মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে শিমুলতলার মূল আকর্ষণ লাট্টু পাহাড়। দুর্গের মতো পাটনা লজ, নলডাঙার রাজবাড়ি, সেন সাহেবদের লন টেনিস কোর্টকে পাশে রেখে মাঠ পেরিয়ে উঠে পড়ুন হাজারখানেক ফুট উঁচু লাট্টু পাহাড়ে। গাছগাছালিতে ছাওয়া লাট্টুর শীর্ষে চড়ে দেখে নেওয়া যায় আদিবাসী দেবতাদের স্থান।
রেললাইন পেরিয়ে ৬ কিমি দূরে পাহাড় ও অরণ্যের মাঝে মনোরম পরিবেশে হলদি ঝোরাও দেখে আসতে পারেন। চলার পথে টেলবা নদীর ধারে সিকেটিয়া আশ্রম, ধীরহারা ঝোরা দেখেও মনকেমন করতেই পারে। মনে পড়ে যেতে পারে ‘দাদার কীর্তি’ ছবির কোনও দৃশ্যের কথাও। ‘ভালবাসা ভালবাসা’-র শুটিং—এর কথাও বলবেনই স্থানীয় দু’ এক ঘর বাঙালিরা।
শিমুলতলা থেকে একদিনের জন্য ঝাঁঝা ঘুরে আসা যায়। শিমুলতলা থেকে মেমু ট্রেন (লোকাল ট্রেন) ধরে ঝাঁঝা স্টেশনে নেমে বিশ্রাম নিয়ে ফিরতি ট্রেন ধরে আবার শিমুলতলায় চলে আসা যায় শুধুমাত্র পথের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই।
ভাবছেন যাবেন কি ভাবে?
হাওড়া থেকে ১৩০০৭ আপ উদ্যান আভা এক্সপ্রেস, ১৩০৩৯ আপ হাওড়া-দিল্লি জনতা এক্সপ্রেস মধুপুর এবং শিমুলতলায় যায়। উদ্যান আভা এক্সপ্রেস পৌঁছয় দিনের বেলা, কিন্ত জনতা এক্সপ্রেস পৌঁছয় মাঝরাতে।
এছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে প্রতিদিন রাত্রি ১১.১০ মিনিটে ছাড়ে মোকামা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। পরদিন সকাল ৭.৩০ মিনিটে ওটা আপনাকে পৌঁছে দেবে শিমুলতলা স্টেশনে। এছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে যশিডি পর্যন্ত ট্রেনে এসে (ঘণ্টাচারেকের ব্যাপার), সেখান থেকে ট্রেন বদল করেও শিমুলতলা যেতে পারেন।