শিমুলতলা আজও মন টানে। বসন্তের হাওয়ায় এক অন্যরকম ভ্রমণ। লিখছেন মানসী দাস মণ্ডল।
বাঙালি ভ্রমণপিপাসু। এ শুধু আজকের কথা নয়। সেকালের কলকেতে বাবুরাও অতি যত্নে পালন করতেন সে কথা- তবে সেকেলের বাবুরা এক ঢিলে মারতেন দুই পাখি। উদ্দেশ্য ছিল দুই- ভ্রমণ ও ভেঙে পড়া শরীর খানিক যুতসই করার প্রচেষ্টা। আর এই প্রচেষ্টায় বেছে নিতেন পশ্চিমকে। এখানকার জল হাওয়ার কদর করতেন অনেক নাম জানা মানুষও। যার দৃষ্টান্ত পাই বহু সাহিত্যপ্রেমীর লেখা থেকে। তেমনি এক জায়গা ঝাড়খণ্ডের গিরিডি। চলুন বেড়িয়ে আসা যাক।
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে মেন লাইনের ট্রেনে মধুপুর স্টেশন। মধুপুরে নেমে সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে গিরিডি। আবার হাওড়া দানাপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন সরাসরি মধুপুর হয়েও গিরিডি যাওয়া যায়।
গিরিডির আকর্ষণ
সারা পশ্চিমের মতো গিরিডিতেও চেঞ্জার বাবুদের আনন্দ নিকেতন গড়ে উঠেছিল এক সময়। স্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বারগান্ডায়। এখানে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে ও উশ্রী নদী। অদূরে খানডলি পাহাড়। বহু নামজাদা মানুষের পদধূলি ধন্য এই শহর। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের গোলকুঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নলিনীরঞ্জন সরকার, সুনির্মল বসুর স্মৃতিধন্য জেলা জজ অমৃতনাথ মিত্রর শান্তি নিবাস দেখে আসতে পারেন। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু হাওয়া বদল করতে আসতেন এই শান্তিনিবাসেই। এমনকী তিনি মারাও যান এই বাড়িতেই। গিরিডির জল ও মধুর বাতাস আজও যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে। তাই আজও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এখানে।
উশ্রী ফলস
গিরিডির সদর শহর থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার দূরে এই উশ্রী ফলস- এখানকার প্রধান আকর্ষণ। শান্তশিষ্ট নদীর জল পাহাড়ি ঢালে, পাথর খণ্ডের ঘাত-প্রতিঘাতে নেমেছে তিনটি ধারায়। বর্ষায় এর গতি বাড়ে আর শীতে বাড়ি এখানকার যাত্রী। এর মনোরম পরিবেশ মন ছুঁয়ে যায় অনায়াসেই। তাই পিকনিক স্পট হিসেবেও স্থানীয় যাত্রীরা ভিড় জমান এখানেই। এখান থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে কারমাটার- যেখানে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার শেষ জীবনটা কাটিয়েছিলেন শুধুমাত্র জলবায়ুর গুণেই। তাই এর নতুন নামকরণ বিদ্যাসাগর। গুণী মানুষটির স্মৃতি বিজড়িত স্থানীয় নেহাতই ফেলনা নয়।
[ পর্যটকদের জন্য সুখবর, পঞ্চবটি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বভারতী ]
পরেশনাথ মন্দির
পর্যটকদের গিরিডি ছুটে আসার এক অন্যতম কারণ এই পরেশনাথ মন্দির। গিরিডি থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে এই মন্দির। পাহাড়ের ওপরের জৈন মন্দিরের আকর্ষণেই ভক্তের সমাগম। সবুজে ঘেরা পাহাড়ের উপরের এই মন্দির জৈনধর্মীর কাছে পরম পবিত্র। শুধু তাই নয়, ট্রেকিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। উৎসাহীদের মনের সাধ মেটানোর জন্য অন্যতম সুযোগ।
রানি সতী মন্দির
উশ্রী ফলস এর কাছে আর এক ধর্মীয় স্থান রানি সতী মন্দির। জৈন মন্দির দেখার সাথে সাথে এটিও দেখে নিতে পারেন। সারা বছর ধরে ভক্ত ও পর্যটকের সমাগম তো হয়েই থাকে, এমনকী এই মন্দিরে বার্ষিক উৎসবও হয়ে থাকে। যাতে স্থানীয় মানুষ থেকে পর্যটক সবাই অংশগ্রহণ করতে পারেন।
জৈন মিউজিয়াম
হাতে সময় থাকলে, গিরিডি থেকে খুব কাছেই মধুবন গ্রামের জৈন মিউজিয়াম ঘুরে আসতে পারেন। বিভিন্ন ধর্মীয় বই ও মূর্তির সম্ভার রয়েছে সেখানে। যেটা সবথেকে ইন্টারেস্টিং তা হল মিউজিয়ামের ব্যালকনিতে বসানো টেলিস্কোপ- তাতে চোখ রেখে পরেশনাথ পাহাড় কে পুরোপুরি দেখে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আর হলফ করে বলা যেতে পারে, এই সুযোগ হাতছাড়া করা হবে চূড়ান্ত বোকামি। সবকিছু মিলিয়ে গিরিডি সকাল থেকে একাল নিজ মহিমায় অমলিন। যদিও নগরায়ন এই শহরকে গ্রাস করছে খুব দ্রুত, তবুও গিরিডির জলবায়ু অত্যাশ্চর্য জাদুবলে আজও হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে।
শিমুলতলা
সেকাল তথা একালের অবকাশযাপনের এককথায় মনোরম জায়গা বিহারের শিমুলতলা। প্রহরীর মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এখানে পাহাড়শ্রেণি। প্রকৃতি এখানে রূপকথা, জলবায়ু এখানে স্বাস্থ্যপ্রদ। তাই শহর থেকে দূরে প্রকৃতির ডাকে আজও মানুষ ছুটে যায় শিমুলতলায়।
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে সরাসরি যাওয়ার ট্রেন প্রচুর। তুফান এক্সপ্রেস, অমৃতসর এক্সপ্রেস, জনতা এক্সপ্রেস, কাঠগোদাম ছাড়াও আছে আরো অনেক ট্রেন। নামতে হবে শিমুলতলা স্টেশনেই।
লাল মোরামের পথে
পাহাড়, টিলা, শাল, মহুয়ায় ঘেরা লালমাটির পথে রূপকথার গল্প শোনায় শিমুলতলা। দিনের শেষে স্টেশন চত্বরে বাড়ে পর্যটকদের ব্যস্ততা। অনেকটা ঠিক পাহাড়ি ম্যালের মতো। এখানেই খাদ্য রসিকদের জানিয়ে রাখি একটি গোপন কথা- শিমুলতলা গেলে স্টেশনে গুপ্তর মিঠাইয়ের দোকানের ল্যাংচার স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেন।
লাট্টু পাহাড়
স্টেশন থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে এখানকার প্রধান আকর্ষণ লাট্টু পাহাড়। এই পথে পড়বে পাটনা লজ, নলডাঙা রাজবাড়ি, সেন সাহেবদের লন টেনিস কোর্ট। শুধুমাত্র পায়ে হেঁটেই অভিযান করে ফেলা যায় প্রায় হাজার ফুট উঁচু এই পাহাড়। পাহাড়ের ওপরে রয়েছে আদিবাসীদের দেবতার থান। দিনের শেষে এই পাহাড়ের সূর্যাস্তই হবে আপনার অভিযানের পরম পাওয়া।
হলদি ফলস
স্টেশন থেকে প্রায় ছ’ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ও অরণ্যের সহাবস্থানে রয়েছে হলদি ফলস। নিজস্ব ছন্দে এখানেও মনোরম। এখান থেকে আরও দু’কিলোমিটার দূরে রয়েছে লীলা বরণ ফলস। এক কথায় যা অপূর্ব। পথেই পড়বে সিকোটিয়া আশ্রম। এখানকার শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ চঞ্চল মন কে আনে খুব সহজেই। সব মিলিয়ে শিমুলতলা অল্প দিনের জন্য একদম পারফেক্ট।
পুরনোকে নিয়ে কমবেশি আমরা সকলেই উৎসাহী। সে যুগের বাঙালি কেনই বা ছুটে যেতেন এসব জায়গায়? তার হদিশ পেতে গেলে, পড়েই বেরিয়ে পড়তে হবে সে জায়গার উদ্দেশে। যথাযথ উত্তর মিলবে সে দেশেই।
[ রংয়ের উৎসবে ঘুরে আসুন পলাশে রাঙানো পুরুলিয়ায় ]