সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বছরে শুধু একবার! তাও রাতের বেলায়! সবার চোখের আড়ালে একটু একটু করে বিকশিত হয় তার কোরক। মুখ তুলে, অনির্বচনীয় শোভা আর প্রশান্তি নিয়ে হিমালয়ের বুকে আত্মপ্রকাশ করে দেবতাদের বহু প্রতীক্ষিত এই ফুল। ব্রহ্মকমল।
লোকবিশ্বাস, স্বয়ং ভগবান ব্রহ্মা অধিষ্ঠান করেন এই শ্বেতপদ্মে। তাই এর নাম ব্রহ্মকমল। যার দর্শনমাত্রে মনের সর্ব কামনা পূরণ হয়।
না কি তিরোহিত হয় কামনা? হিমালয়ের উদার নীল আর ফুলের বর্ণিলে ধুয়ে-মুছে যায় সব কলুষতা?
উত্তর দেওয়া শক্ত। তবে, শুধু ব্রহ্মকমলের দর্শনের আশেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ যাত্রী ভিড় করে আসেন হিমালয়ের কোলে। হৃষীকেশ, বদ্রীনাথ ছুঁয়ে, অলকানন্দাকে সাক্ষী মেনে হাজির হন ফুলেল এই উপত্যকায়। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এ। নন্দন কাননে।
আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, রোজকার জীবনে তো ক্লান্তি কিছু কম নেই! তার পরেও কেন এত পথ পেরিয়ে, পায়ে হেঁটে, চড়াই-উতরাই ভেঙে শুধু ফুল দেখতে যাওয়া? তার চেয়ে বিলাসবহুল কোনও জায়গায়, সুন্দরী সাহচর্যেই কি জীবন ধন্য হয় না?
ছবিগুলো দেখুন তো একটু মন দিয়ে। এই যাত্রা তীর্থযাত্রার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সে যাত্রাপথ বছরে শুধু একবারই খোলা থাকে বলে নয়! ব্রহ্মকমলের দর্শনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা জড়িয়ে রয়েছে বলেও নয়!
তবে প্রাপ্তি বলতে কী?
প্রকৃতি! এই মোহময়ী পৃথিবী আপনার জন্য যে অপরিসীম রহস্যের গান বুনে রেখেছে, তা না শুনেই কাটিয়ে দেবেন জীবনের বছরের পর বছর? সারা পৃথিবীর ফুলের বাহার এক জায়গায় জড়ো হলে ছবিটা কীরকম হয়, তার থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকবেন?
আসলে, ফুলের শোভাও বোধহয় ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যাত্রার সবটুকু কারণ নয়। আসল কারণ প্রকৃতির রহস্য। ১২ হাজার ফুট উচ্চতায়, সাড়ে ৮৭ বর্গফুট বিস্তৃত, কনকনে ঠান্ডা আর বর্ষার মরশুমে কী করে এত ফুল ফোটে, সেই রহস্য! বছরে স্রেফ একবার ব্রহ্মকমল ফোটার রহস্য। রহস্য মরশুমে একবার নীল আফিমের দেখা দেওয়া। সেই রূপে যেমন রয়েছে স্নিগ্ধতা, তেমনই রয়েছে নেশাও!
তা, আপনি কি ফুল ভালবাসেন না?
রং ভালবাসেন তো? দেখতেই তো পাচ্ছেন ছবিগুলো! এমন রঙের রায়ট আর কোথায় পাবেন বলুন তো? শুধু অজানা ফুলই নয়, অজানা রঙের খোঁজ পেতে হলেও আপনাকে আসতে হবে হিমালয়ের এই উপত্যকায়।
আর যদি রঙেও অনিচ্ছা থাকে?
তাহলে রয়েছে উদার নীলের কোলে জেগে থাকা হিমালয়ের স্নিগ্ধ গভীর রূপ। হিমালয় কিন্তু তার উপত্যকার দ্বার বড় একটা অবারিত করে রাখে না। এখানে সেই সুযোগ মেলে বছরে মাত্র একবার।
তার পরেও আপনি আসবেন না?
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে হরিদ্বার বা হৃষীকেশ ট্রেনে। সেখান থেকে বদ্রীনাথের বাসে গোবিন্দঘাট। গোবিন্দঘাট থেকে ঘোড়া কিংবা ডান্ডিতে ঘাংঘারিয়া। ঘাংঘারিয়া থেকে ১ কিমি ট্রেক করে গেলে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এর প্রবেশফটক। এখানে মাথাপিছু ১৫০ টাকার (বিদেশি হলে ৬৫০ টাকা) টিকিট কেটে উপত্যকায় ঢুকতে হয়। সারা দিন সেখানে কাটিয়ে সূর্যাস্তের আগেই ফিরে আসতে হয় ঘাংঘারিয়ায়। ওই পথেই ফেরা।
ঘাংঘারিয়া থেকে কিছুটা এগিয়ে লক্ষ্মণগঙ্গার উপর সেতু পেরিয়ে পথ দু’ দিকে বেঁকে গিয়েছে- বাঁ দিকের পথ গিয়েছে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স বা নন্দনকাননে আর ডান দিকের পথ শিখতীর্থ হেমকুণ্ড সাহিবে। দু’ পথেই ৬ কিমি করে হাঁটা। ঘাংঘারিয়ায় দু’-তিন রাত কাটিয়ে দু’টি জায়গা ঘুরে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন: ঘাংঘারিয়াতে থাকার জন্য আছে জিএমভিএন-এর গেস্ট হাউস, বেসরকারি হোটেল। এখানকার গুরুদোয়ারা কর্তৃপক্ষও রাতে থাকার ব্যবস্থা রেখেছেন। গোবিন্দঘাটে পৌঁছে সে দিন যদি ঘাংঘারিয়া না আসা যায়, তা হলে গোবিন্দঘাটে রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে।
যা খেয়াল না রাখলেই নয়: ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এ ৫২১ রকম প্রজাতির লতা, গুল্ম ও বৃক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। ৩০০ প্রজাতির ফুল ফোটে এখানে। ঘাংঘারিয়ার বন অফিস বা ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এর কনজার্ভেশন প্রোজেক্ট অফিস থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় যা একটু জেনে গেলে ফুল চিনতে সুবিধা হয়। সঙ্গে একজন গাইড নিলে লাভ বই ক্ষতি নেই। তিনিই ফুল চিনিয়ে দেবেন। আর হ্যাঁ, সাধারণত ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এ ব্রহ্মকমল দেখতে পাওয়া যায় না। এই পুষ্প উপত্যকায় ব্রহ্মকমল দর্শন বিরল অভিজ্ঞতা। তবে হেমকুণ্ড সাহিবে গেলেই দেখা যায় ব্রহ্মকমল।