সরোজ দরবার: অনুগতজনে কি এভাবে প্রবঞ্চনা করতে হয়, লিও মেসি! এতটা রক্তক্ষরণ, এতটা বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস কি কারও জন্য তুলে রাখতে আছে ফুটবলের বরপুত্র! তুমি তো অন্তত রাখতে না। রাখো না কোনওদিন। যে তুমি নরম মনের, যে তুমি কামিনী ফুলের সুবাস, সেই তুমি, সেই মেসি, দশের জার্সি গায়ে এতখানি অপমান ফিরিয়ে দিতে পারলে তুমি! বাগানের সব ফুল উজাড় করে তুলে এনে শুধু তোমার জন্যই তো কোটি কোটি ভক্ত রাত জেগেছিল। তুমি তাদের একটু প্রসাদী ফুল তুলে দিতে পারলে না! কী করে তুমি ফুটবলের ভগবান হবে লিও!
[ কোস্টারিকার বিরুদ্ধে নামার আগে ব্রাজিলের চিন্তা নেইমারের ফিটনেস ]
না, তোমার ভক্তরা তো কোনওদিন চায়নি ইস্পাতকঠিন পেশির বিস্ফার। চায়নি বিতর্কের বর্ণমালা। চায়নি ঔদ্ধত্যের উষ্ণতা। তারা শুধু ম্যাজিক চেয়েছিল। সেই ইন্দ্রজাল, যা জালে জড়িয়ে দেয় স্বপ্ন। যে পোড়া দেশ ফিফার নজরেও পড়ে না, সেখানেও ভক্তরা চেয়েছিল, বেজে উঠুক তোমার সেতার। বলো, কী অপরাধ তার, এ কামনা যে করেছিল! সবুজ গালিচায় তুমি কি ফুল ফোটাওনি? লোকে যাকে ম্যাজিক বলে, তুমিই কি মগ্ন বিশ্বাসে তাকে সত্যি বলে তুলে ধরোনি! তুমিই কি গড়ে দাওনি সেই মায়াপৃথিবী যেখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই! তাহলে আজ আবার কেন বুঝিয়ে দিলে, সত্যি আর রূপকথার মধ্যে থেকে যায় আরও একটা দুনিয়া, যেখানে ঘাম ঝরে অকাতরে। স্বপ্নভঙ্গ হয়, আর ঈশ্বরের মাথায় ওঠে কাঁটার মুকুট।
অথবা এটাই মহাকাব্যের নায়কদের দর্শন। লিও মেসি, তুমি তো শুধু ফুটবল খেলো না। তোমার অসুখ অতিক্রম করে ফিনিক্স হয়ে জীবনে ফিরে আসা, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে উন্নীত করা আসলে কোটি মানুষকে দিয়েছে রূপকথা। বুঝিয়েছে, যে পৃথিবীতে লিও মেসি আছে, সেখানে হেরে যাওয়া বলে কিছু নেই। ঔদ্ধত্যের বিপরীতে এ পৃথিবীতে আছে এক সমাহিত তটভূমি যেখানে কনে দেখা আলোয় আজও কেউ প্রেমে পড়ে। চাঁদের নরম হাসি আজও যেখানে সমস্ত পরাজিতদের চুলে বিলি কেটে যায়। সেই পৃথিবীর চাবি হাতে তুলে দেওয়া লিও, কেন আজ দেখালে এই নরক? নাকি আজ তুমি বলে দিলে, রূপকথাকে সত্যি ভাবলে আখেরে কষ্ট শুধু গিলে ফেলতে হয়। গ্রীক ট্র্যাজেডির এই চরম ক্ষণে ম্যাজিক বলে কিছু নেমে আসবে না। এ পৃথিবীতে মন ও তো ভাঙে!
তোমার চোখের দিকে আর তাকাইনি লিও। তুমিও কি তোমার ঈশ্বরকে বলছ আজ, ‘অনুগত জনে কেন, করো এত প্রবঞ্চনা’! কী জানি কী উত্তর পাচ্ছ তুমি। তবে দৃষ্টির ওই খাঁ খাঁ শূন্যতার তো কোনও অনুবাদ হয় না লিও। আমরাও তাই জানি না, গোপন রক্তক্ষরণ বুকে ঠিক কেমন মোচড় দেয়। আমরা ফুল তুলতে জানি। কিন্তু রাশি ফুল প্রসাদী করে না দিতে পারার ব্যর্থতা আমরা জানি না। আমরা কাঁদতে পারি সমক্ষেই। লুকিয়ে চোখের জল ফেলার বেদনা, আমরা জানি না লিও মেসি। তুমি জানো। জানো বলেই তুমি মেসি। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা অভ্যাস করে ফেলে, এখন ঠেকে যাওয়ার পৃথিবীতে হাঁটতে পারো বলেই তুমি মেসি। জিততে শেখানোর মতো, মহাকাব্যের নায়ক তুমি, হয়তো শিখিয়ে যাচ্ছ হারকে মেনে নেওয়ার সহন-শিক্ষা। এই তো জীবন লিও। তুমিই পারো এভাবে দুদিক মেলে ধরতে। উপন্যাসের চরিত্র না হয়ে, তুমিই পারো উপন্যাস হয়ে উঠতে। অথচ ফুটবিল বিশ্বে তুমি নিজেই তো একটা গোলার্ধ। অপরদিকে আছেন রোনাল্ডো। প্রতি ম্যাচে তিনি নিজেকে প্রমাণ করছেন। শেষ বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখছেন। একদিকে আলো থাকলে অন্যদিকে তো অন্ধকার নেমেই আসবে। সে অন্ধকার গায়ে মেখেই ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরে যাচ্ছ লিও। সকলে সরে জায়গা করে দিচ্ছে। হ্যাঁ, সকলেই হয়তো জানে এই কাঁটার মুকুট, এতটা নিষ্ঠুর প্রস্থান তোমার প্রাপ্য নয়। তবু মেসি শুধু তুমিই বোধহয় জানো, আলোর মতো অন্ধকারও গায়ে মাখতে হয় সেই নায়ককেই। তোমার প্রতি ব্যর্থতায় লক্ষ সমর্থককেও যে কত কটাক্ষ সহ্য করতে হচ্ছে, তা তুমি জানো মেসি। তাই হয়তো সমক্ষেও কাঁদতেও পারো না তুমি।
তবু আমরা একটা অভিসন্ধি করেছি লিও। এই নরকদর্শন আমাদের নিয়তি। আমরা তা খন্ডাতে পারিনি। তুমিও পারোনি। তবু আমরা তো পারি, এই নরক অতিক্রম করতে। আমরা তো পারি, রক্তক্ষরণের প্রান্তে রূপকথাটিকে রাখতে। কত প্রেম ভাঙে, কত মন ফকির হয়, তবু প্রেম কি মিলিয়ে যায়! নাকি বর্ষা আসে না! আমরা সেই অপেক্ষায় থাকি। বলি, এ নরক সত্য, তবু রূপকথা নয়।
লিও মেসি, কামিনী ফুলের সুবাস তুমি, অন্য কোথাও তাই, কোনও একদিন আবার তোমার সেই রূপকথার গল্পখানা শুনিও।