গৌতম সরকার: সেই ধমক জীবনে ভুলব না। এখনও দেখা হলে মাঠের সেই কড়া অনুশাসনের কথা মনে পড়ে যায়। ঘটনাটা খুলেই বলি। ইস্টার্ন রেল স্টাইপেন্ডে ফুটবলার নিত। আমি ঢুকলাম সেই দলে। তখন আন্তঃরেল প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে সিনিয়ররা চলে যেতেন। ঘরোয়া লিগে তখন খেলত জুনিয়র ফুটবলাররা। বেশ মনে আছে রাজস্থানের সঙ্গে খেলা। খেলছেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তথা পিকে স্যার। প্রদীপদা খেলবেন জানলে প্রচুর লোক মাঠে খেলা দেখতে আসতো। বল ধরে প্রথম পাসটাই বাড়ালাম ভুল। প্রদীপদা তেড়ে এলেন। কী ধমক দিলেন আমাকে।
মনে হল, মাঠে যেন মেরেই ফেলবেন। পরের বলটা ধরে আবার সাহস নিয়ে পাস বাড়ালাম। এবার আর ভুল হল না। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, সেই রাজস্থানের বিরুদ্ধে শেষ ঘরোয়া লিগের ম্যাচ খেলেছিলেন প্রদীপদা। তারপর তিনি আর ঘরোয়া লিগে নামেননি। এখনও মনে পড়ে মিলন বাগচিকে বসিয়ে আমাকে খেলানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে প্রদীপদাকে কোচ হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু প্রদীপদার সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা এখনও আমার কাছে বড় পাওনা।
[আরও পড়ুন: ভারতীয় ফুটবলের একটি যুগের অবসান, প্রয়াত কিংবদন্তি পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়]
কিছুদিন আগেও গিয়েছিলাম হাসপাতালে দেখতে। তারপর থেকে আর যাইনি। ভাল লাগে না। প্রদীপদাকে কাটা-ছেঁড়া অবস্থায় দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। প্রদীপদা মানে ফাইটার। যুদ্ধক্ষেত্রের মূর্ত প্রতীক। তিনি কিনা বিছানায় শুয়ে এতদিন কষ্ট পেলেন, এটা কী করে দেখা সম্ভব? আজ আমরা যেটুকু খেলেছি, যেটুকু সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, সবই কিন্তু প্রদীপদার সৌজন্যে। তিনি না থাকলে এই জায়গায় আসতেই পারতাম না। আজকের আধুনিক ফুটবলে তিনজনের সঙ্গে তিনজন বা দু’জনের সঙ্গে দু’জনের খেলা, এসবই কিন্তু কলকাতার মাঠে প্রথম চালু করেছিলেন প্রদীপদা।
শুধু তাই নয়, ২০ গজের মধ্যে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে জোরাল শট মারতে হবে। বিপরীতে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকেও সেই জোরাল বল রিসিভ করে টার্ন করতে হবে। তারপর নিতে হবে সেই জোরাল শট। এইভাবে তিনি আমাদের রিসিভিং, পাসিং, শুটিং-সব শেখাতেন। এশিয়াড দল থেকে বাদ পড়ার জন্য মাঝে মাঝে প্রদীপদার উপর অভিমান হয়। জানি, সেদিন যদি প্রদীপদা একটু উদ্যোগ নিয়ে আমাকে দলে রাখতেন তাহলে জীবনের অপূর্ণ সাধ বোধহয় থাকত না। কার না সাধ জাগে দেশের মাঠে এশিয়াড দলে থাকার। ১৯৮২ সালে সেই দলে থাকতে পারিনি। তবু বলব, তিনি আমার দ্বিতীয় পিতা। ১৯৭২-এ খিদিরপুর থেকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে এলাম। প্রদীপদা তখন ইস্টবেঙ্গলের কোচ। একদিন বউদিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন মধ্যাহ্নভোজ সারতে। বাবা-মাকে বলে গেলেন, গৌতম আপনাদের মান রাখবে।
[আরও পড়ুন: করোনায় বাতিলের পথে আই লিগ, এপ্রিলের গোড়াতেই মোহনবাগানকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা]
আর একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। আমার উপর কতটা আস্থা রাখতেন তার একটা নমুনা দিই। পেলে এলেন কলকাতায় খেলতে। আমাকে প্রদীপদা ডেকে বললেন, পেলেকে একমাত্র তুমি পারো থামাতে। আমি শুনে থ। পেলেকে আটকাতে আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছেন প্রদীপদা? দুরু দুরু বুকে প্রদীপদাকে বললাম, “ঠিক আছে। তবে পুলিশ ম্যান হব না। আমার নজরেই থাকবে। তবে পেলে এক জায়গায় নিশ্চয় দাঁড়িয়ে খেলবে না। যখন যেখানে যাবে সে যেন একটু আলাদা নজর রাখে। বাকিটা আমি বুঝে নেব।” সেদিন মোহনবাগান দলটা অসাধারণ খেলেছিল। কিন্তু প্রদীপদা আমাকেই দিয়েছিলেন বিশেষ দায়িত্ব। তাই রাগ-অভিমান যাই থাকুক, প্রদীপদাকে কোনওদিন ভুলতে পারব না। তিনি আমার কাছে পিতৃসম। কেউ কী পিতাকে ভুলে যেতে পারে? না সম্ভব?