সরোজ দরবার: ‘অনুষ্ঠান কি আজ? যেতে হবে?’, নির্ভেজাল বাঙালি খাবারে দুপুরের খাওয়া শেষ করে তিনি এ কথা বলতেই তরুণ উদ্যোক্তার মুখ কাঁচুমাচু। আর মঞ্চে সেই দুষ্টুমির কথা যখন ফাঁস করে দিচ্ছেন এক তরুণ কবি, তখন খলখল হাসি তিরাশি বছরের যুবকের। ‘আরে ভাই যে পেটের জন্য এত লড়াই, তাইই যখন ভরে গেল, তখন আর অনুষ্ঠান কেন?’- ভরা মঞ্চে বসে তুমুল করতালির মাঝে যিনি দ্বিধাহীন এ কথা বলতে পারেন, তিনিই গুলজার।
গুলজার মানে- আঁধি, মাচিস।
গুলজার মানে- মেরা কুছ সামান…
গুলজার মানে, বাই চয়েস বাঙালি হয়ে ওঠা৷
গুলজার মানে তাই ‘পান্তাভাতের’ মিঠে বাঙালি নস্ট্যালজিয়া৷
গুলজার মানে, ‘বেঘর’ প্লুটোর জন্য দরদে কেঁদে ওঠা মন। আহা! একদিন হুট করে গ্রহরাজ্য থেকে বাদ দিয়ে দিল। ও বেচারির তো কোনও দোষ ছিল না।
গুলজার মানে তাই ভরা নন্দনের দুপাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। মেঝের ফাঁকফোকরও যেন কবিতার ডিঙি। যে পেরেছে গলুই ছুঁয়ে থেকেছে। নান্দীমুখে শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন, ‘কলকাতা যে সংস্কৃতির রাজধানী আজ যেন তা টের পাওয়া যাচ্ছিল।’ সত্যিই তো আমরা কী করে ভুলে যাব, গুলজার মানেই যে ‘আঁধি’।
সংবাদ প্রতিদিন এবং দে’জ পাবলিশিং-এর উদ্যোগে ‘গুফতগু উইথ গুলজার’ আসলে হয়ে উঠল চলন্তিকা কাব্য। ওই গুলজার ঝড়ে রেখে যাওয়া কবিতার ঠিকানা। কবিমন। গুলজারি মুহূর্তের সাক্ষী হতে উপস্থিত ছিলেন সংবাদ প্রতিদিন-এর সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস। ছিলেন, দেজ কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে। সংবর্ধনার পালা মিটল। হল আনুষ্ঠানিক বই প্রকাশ। বাংলা ভাষায় গুলজারের প্রথম বই। তারপরই খোলা স্মৃতির ঝাঁপি। আর বাঙালি দেখল এক আরশিনগর। সেখানে যে পড়শি বসত করেন, তিনি যেন আর একটু বেশি বাঙালি। ভাষাকে ভালবেসে ভাষার টানে ভাসা তো কম কথা নয়। শঙ্খবাবু বলছিলেন, গীতাঞ্জলির সূত্রে অনেককেই রবীন্দ্রনাথকে চেনেন। কিন্তু কিশোর বয়স থেকে রবীন্দ্রটানের এমন অনন্য অনুভবের নমুনা সচরাচর মেলে না। তারপর এই পরিণত বয়সে এসে রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ। গুলজার ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম তো বটেই। নইলে কে আর তাঁর বইয়ের নাম রাখেন, পান্তাভাতে। যে জিনিস বাঙালির জীবন থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, গুলজার তা ফিরিয়ে এনেছেন। এনেছেন কেননা দ্ব্যর্থহীন তিনি বলতে পারেন, এই বাংলা থেকে তাঁর শেখার শেষ নেই। ‘গুরু’ বিমল রায় থেকে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী হোক বা পঞ্চম- গুলজারের বাঙালি সান্নিধ্যের স্মৃতি যেন পান্তা ভাতের মতোই যত্নে চাপা দিয়ে রাখা। সময়ের জারণে তা আরও মেদুর। মন খারাপের ছোঁয়াচ থেকেই বেরয় মন ভালো আলো। অন্যবদ্য স্মৃতিকথনে যিনি তা বের করে আনতে পারেন, তিনিই গুলজার।
প্লুটোর জন্য তাঁর দুঃখ হয়। এই যে প্রযুক্তি এসে বই দেওয়া নেওয়ার অছিলায় সম্পর্ক গড়ায় দেওয়াল তুলে দিল, সে যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। চিনির দাম বাড়ছে, আর কিছু না করে আমরা শুধু চায়ে চিনি মিশিয়ে যাব, এ প্রশ্ন তিনিই করতে পারেন। আর তাঁর কবিতা বলে ওঠে, ঋণের মাটি চিবিয়ে কৃষকরা আজ আত্মঘাতী। গ্রামে গ্রামে শবযাত্রা। এ তো যন্ত্রণার কালযাপন। কবিমাত্রই সে বিষে নীল। তবে গুলজার বলেই আমরা সে বিষ মন্থন করে এমন অমৃত পাই। দেখি নজম থেকে নজম পেরিয়ে হাঁটছেন এক তরুণ। সামনে যার অনন্ত সম্ভবনার দরজা খোলা। শান্তনু মৈত্র একটা দারুণ জিনিস জানিয়ে দিলেন। গুলজারের স্টাডিতে কোনও অ্যাওয়ার্ড রাখা নেই। সে তো তিনি কম পাননি। কিন্তু কী হবে অতীত নিয়ে! আছে বলতে গীতবিতান আর রবি ঠাকুরের ছবি। একদিকে পান্তাভাতে মাখা স্মৃতি, অন্যদিকে নিজেরই অতীত গৌরবকে পিছু ফেলে, আগামীর সন্ধানে এগিয়ে যাওয়া। একটা সন্ধেয় কলকাতা চিনল, এই বৈপরীত্যের নামই গুলজার। গীত-গজল-নজমে যাঁকে আমরা খুঁজছি, খুঁজতে অভ্যস্ত, তিনি খুঁজছেন ভারত আত্মাকে। কবিতাকে ছুঁয়েই। এই সময়ের প্রায় ২০০ কবির, নানা ভাষার কবিতা অনূদিত হয়েছে তাঁর কলমে। আর লেখার মুড ধরে তিনি চিনছেন এই সময়ের দেশকে। নর্থ ইস্টের ডায়নামিক কবিতা তাঁকে চমকে দিচ্ছে। আবার অনেক গা জোয়ারি ভাষার সাহিত্যে মরাস্রোতের আক্ষেপ ধরা দিচ্ছে তাঁর গলায়। আর এর ভিতর দিয়েই তাঁর আবিষ্কার তাঁর নিজস্ব দেশকে। ‘মজহব’ আর ‘জুবান’-এর একদিন তো বৈরিতা ছিল না। আজও যে তা থাকতে নেই, এ কথা যিনি কবিতা চর্যার এই অখণ্ড কর্মসূচিতে জানাতে পারেন, তিনিই গুলজার।
আর এক সন্ধেয় বাঙালি দেখল, সামনের মানুষটি এমনিই লজ্জামুখে বলছেন, বাঙালির সামনে এসে বাংলা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। আসলে তিনি বাঙালির সামনে আত্মদর্শনের আরশিখানাও খাড়া করে দিচ্ছেন। হ্যাঁ পঞ্চমের বেচেহনিপনা, সলিলের দুষ্টুমির স্মৃতিই শোনাচ্ছেন বটে, আসলে তো শোনাচ্ছেন বাঙালির পথের পাঁচালি। যেখানে মিশে আছে সৃষ্টি আর সাফল্যের আলপনা। যে পথ দিয়ে হেঁটে আসা তাই কি আজ একটু একটু করে ভুলতে বসেছে বাঙালি? গুলজারের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত তাই মনে হয়। হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা আজ আর কজন বাঙালি সলিল চৌধুরির নাম উচ্চারণ করে কানে আঙুল ঠেকান!
হাজার বাঙালির মধ্যে দাঁড়িয়ে যিনি তা করেন, তিনিই গুলজার। বাঙালির আরশিনগরের পড়শি।
ছবি: রাজীব দে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.