সুকুমার সরকার, ঢাকা: রাজধানী ঢাকা থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরের পশ্চিমপ্রান্তের সীমান্ত জেলা ঝিনাইদহ। এই বছর ঝিনাইদহ-৪ আসন (কালীগঞ্জ উপজেলা) থেকেই সাংসদ নির্বাচিত হন আনোয়ারুল আজিম আনার। যিনি গত ১২ মে ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। বুধবার ভারতীয় পুলিশ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, খুন হয়েছেন আনোয়ারুল। তাঁকে ঘিরেই এখন দানা বেঁধেছে নানা রহস্য। এদিন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও দাবি করেন, পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে আনোয়ারুলকে। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার সন্দেহে ইতিমধ্যেই ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এই সাংসদকে খুন করার আসল ‘মোটিভ’ নিয়ে। কেনই বা কলকাতায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে খুন হলেন তিনি? এর ঘটনার শিকড় কি লুকিয়ে ঝিনাইদহে?
ঝিনাইদহের সীমান্ত এলাকার অপর পার রানাঘাট মহকুমার গেদে রেলস্টেশন। এক সময় ঝিনাইদহ এলাকাটি ছিল নকশালদের ঘাঁটি। নিত্যদিন খুন-খারাপি লেগেই থাকতো সেখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই এক ইদে প্রকাশ্যেই একজন সাংসদকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এহেন এলাকার সাংসদ হওয়া সত্বেও আনোয়ারুল কখনও পুলিশ প্রটোকল ব্যবহার করেননি। তিনি নিজেই মোটরবাইক চালিয়ে দিন অথবা রাতে যখন প্রয়োজন তখনই নির্বাচনী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে কোনও গ্রামে পৌঁছে যেতেন।
তবে আনোয়ারুলের জীবন ঘিরেও রয়েছে নানা বিতর্ক। এক সময় তাঁর উপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। হুন্ডি কারবার, চোরাচালান ও পাচারের অভিযোগে ইন্টারপোল তাঁর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করেছিল। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৬ সালে ইন্টারপোলের তালিকায় উঠে এসেছিল আনোয়ারুলের নাম। যদিও ২০০৯ সালে সেই তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করা হয়। পুনরায় নিজের কাজ শুরু করেন আনোয়ারুল। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামি লিগ থেকে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনোয়ারুল। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তাঁর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও সোনা চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’ হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের উপর আক্রমণ করে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। বিএনপি-জামাতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনোয়ারুল।
জানা যায়, বনগাঁও মহকুমার বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন আনোয়ারুল। ওই সময় কালীগঞ্জ থানা-সহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করত তাঁর বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন আনোয়ারুল। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তির মালিক হন তিনি। এর পর সোনা পাচার করতে গিয়ে একটি খুনের ঘটনায় নাম জড়ায় আনোয়ারুলের। ২০০৯ সাল থেকে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হলে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনোয়ারুল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, নানা অপরাধে এক সময় তাঁর বিরুদ্ধে ২৪টিরও বেশি মামলা ছিল। ফলে, পূর্ব কোনও ঘটনার কারণেই কী আনোয়ারুলকে খুন করার ছক কষা হয়েছিল? উঠছে এমন প্রশ্নও।
এই খুনের ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে আরেক বিস্ফোরক তথ্য। আজিম একা ভারতে গিয়েছেন বলে শুরু থেকে প্রচার করা হলেও আসলে তাঁর সঙ্গে নাকি আরও দুজন ছিলেন। তারাও বাংলাদেশি বলে জানা গিয়েছে। ওই দুই ব্যক্তি সাংসদের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাঁদের বাড়িও আনোয়ারুলের এলাকায় বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে গত ১২ মে গেদে সীমান্ত হয়ে বরাহনগরে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন আনোয়ারুল। পরদিন ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রউফের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। গত ১৬ মে সকাল ৭টা ৪৬ মিনিটে আনোয়ারুলের ফোন থেকে আবদুরের নম্বরে সর্বশেষ ফোন আসে। কলটি ধরতে পারেননি আবদুর। তার পর একাধিক বার ফোন করা হলেও আর আনোয়ারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। বুধবার ভারতের তরফে দাবি করা হয় আনোয়ারুলকে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনায় যৌথভাবে কাজ করছে ভারত ও বাংলাদেশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.