তন্ময় মুখোপাধ্যায়: চিত্র ১: ছেলেকে পড়াতে গেলে সংসার যে চলে না। অভয় দিলেন মাস্টারমশাই। ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ। পড়ুয়াকে আর বই কিনতে হয়নি। সেই ছেলে এখন নৌসেনায় উচ্চপদে।
চিত্র ২: বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। মামারবাড়িতে আশ্রয় দুই ভাইয়ের। পথভোলা শৈশবকে সাহস দেখিয়েছিলেন শিক্ষাদরদী মানুষটি। বাতলেছিলেন এগোনোর পথ। সহোদররা এখন স্কুলশিক্ষক।
চিত্র ৩: মাস্টারমশাইয়ের বিষয় অঙ্ক এবং পদার্থবিদ্যা। তবে অন্য কিছুর প্রতিও অপার আগ্রহ। ইতিহাস, ভূগোল বা বাংলা নিয়ে পড়লে কোন পথ ধরা উচিত তার সুলুক সন্ধান দেন।
[প্লুটোকে আবার ফেরানো হোক গ্রহের সংসারে, নাসায় আরজি খুদের]
এই তিনটি উদাহরণের মতো এমন অসংখ্য আখ্যানের নেপথ্যে রয়েছেন সৌমিত্র রায়। গ্রামবাংলার এক শিক্ষা-বিপ্লবী। ছেলেমেয়েদের কেরিয়ার কীভাবে এগোবে? এর উত্তর খোঁজাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। এর জন্য পকেট থেকে খরচ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। ঘণ্টার ঘণ্টার পর স্কুলে পড়ান। স্কুল শেষ হওয়ার সন্তানসম পড়ুয়াদের বাড়তি ক্লাসে ডেকে বিভিন্ন বিষয়ে তৈরি করেন। এসব শেষ হওয়ার পরও মাস্টারমশাইয়ের ছুটি নেই। কারণ বাড়ি ফিরলে দেখেন অজস্র সন্তান তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। কোনওরকমে দুটো মুখে দিয়ে আবার পড়ানো। সকাল সাতটা বাজলে সেই একই রুটিন। অন্তত ২০ জন পড়ুয়াকে দু’বেলা শিক্ষাদান করে চলেছেন পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের নাসিগ্রাম হাইস্কুলের এই শিক্ষক। এক্কেবারে বিনা পয়সায়। প্রায় ৩০ বছর ধরে এটিই তাঁর দিননামচা। পড়ানোর পাশাপাশি তাদের এগিয়ে যাওয়ার পাঠ দেন সৌমিত্রবাবু।
[মাতৃত্বের নজিরবিহীন নমুনা, রুপান্তরকামীর স্তন্যদানেই প্রাণ বাঁচল শিশুর]
কোন তাগিদ থেকে এভাবে অক্লান্তভাবে এগিয়ে চলেছেন? প্রশ্নটা শুনে একটু থামেন মাস্টারমশাই। আসলে তাঁর বংশ পরম্পরায় যে রয়েছে সবার পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা। সৌমিত্রবাবুর বাবা লক্ষ্মীকান্ত রায় নাসিগ্রামের স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন। সন্তানকে সমাজসেবামূলক কাজে উজ্জীবিত করতেন লক্ষ্মীকান্তবাবু। সেই পথে হেঁটে সৌমিত্র রায় এখন নাসিগ্রামের ‘গাইড’। নিজের স্কুলে পড়াশোনা করে সেখানেই শিক্ষকতার সুযোগ। ১৯৯০ সালে যখন তিনি হাতে চক, ডাস্টার তুলে নেন তখন ছেলেমেয়েদের সেভাবের পথ দেখানোর কেউ ছিলেন না। প্রতিভাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পড়ুয়াদের নিয়ে কেরিয়ার গাইডেন্সের ক্লাস শুরু হয়। কেউ ইনজিনিয়ারিং, কেউ ডাক্তারি, কাউকে কমপিউটরের কোর্স। গড় গড় করে বলে যান সৌমিত্রবাবু। যারা আর্টসের পড়ুয়া তাদেরও যে কিছু করা সম্ভব সেই বিশ্বাসটাও তৈরি করে দিয়েছেন মাস্টারমশাই। যার সুবাদে দেশের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছেন ভাতারের কোনও সন্তান। কেউ মার্কিন মুলুকে নাম কুড়িয়েছেন। তাঁর দেখানো পথে বহুজাতিক সংস্থার শীর্ষ পদ, আইআইটি, এনআইটি, কিংবা কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলো করে আছেন অজস্র ছাত্র-ছাত্রী। সাফল্যের তালিকা যেন ফুরোয় না। যাঁদের অনেকেই একসময় অর্থের অভাবে পড়ার সুযোগটুকু পায়নি। সৌমিত্র রায়ের উৎসাহে সেইসব কুঁড়ি ফুল ফুটে সৌরভ ছড়াচ্ছে।
[বিয়ের আসরে সচেতনতার বার্তা, নববধূকে হেলমেট উপহার পুলিশের]
সংসার কার্যত ভুলে বইয়ে ডুব। পড়ুয়াদের জন্য সারাক্ষণ চিন্তাভাবনা, আধুনিক শিক্ষাদান এবং পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা। তাদের হাতে-কলমে শেখানো। মা, স্ত্রী এবং সন্তান অভিমান দূরের কথা এই পাশে থাকার দৌড়ে প্রবলভাবে রয়েছেন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। পরিবারের লোকজনও যেন সমৃদ্ধ। আর তাঁর সন্তানসম পড়ুয়ারা। যারা বিভিন্ন জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত তারা অন্যভাবে মাস্টারমশাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নাসিগ্রাম হাইস্কুলের প্রাক্তনী শুভদীপ মুখোপাধ্যায়, তুষার নন্দী, সুরজিৎ নন্দী, বনানী রায়, স্বপন যশ থেকে কাশীনাথ ভট্টাচার্য। প্রিয় স্যারকে নিয়ে তাঁদের যেন মুগ্ধতার শেষ নেই। প্রাক্তনীরা বর্তমানদের জন্য কিছু করতে ফান্ড তৈরি করেছে। তাঁদের সুবাদে ভাতারের এই প্রত্যন্ত গ্রামে স্কাইপের মাধ্যম পড়াশোনা হয়। পঠন-পাঠনের অনেকটাই অ্যাপ নির্ভর। এই ডিজিটাল উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন স্কুলের প্রাক্তনী শুভদীপ। বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত এই যুবার কথায়, ”যেভাবে স্যার ডিজিটাল স্কুল বানাচ্ছেন তার পাশে অন্যান্যরা এলে স্বপ্নপূরণ সম্ভব। শহরে কেরিয়ার গাইডেন্সের অনেক রাস্তা আছে। কিন্তু প্রান্তিক এলাকায় স্যার পথ দেখাচ্ছেন।”
ক্লাস নাইন থেকে ছেলেমেয়েদের ছকভাঙা পথের সন্ধান দেওয়া শুরু করেন সৌমিত্র স্যার। নিজের উদ্যোগে স্কলারশিপ তোলা, ভর্তির ব্যবস্থা, ভাল কোর্সের সুলুকসন্ধান। এইসব করতে করতে জীবনের পঞ্চাশটা বসন্ত পেরিয়ে গেল। ক্লান্তিহীন মানুষটি পড়ানোর ফাঁকে বলে গেলেন, পড়াশোনা করলে তো নম্বর আসবেই। কিন্তু জীবনের খাতায় কতটা নম্বর পেলাম সেটা জানতে হবে। তার জন্য ভাল মানুষ হওয়া জরুরি। যার কারণে মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই। স্বামীজির প্রেরণায় এগোনো মাস্টারমশাই বলেন, ”স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন ম্যান মেকিং এডুকেশন। তাই ভাল ফল করলেই কাজ শেষ হয় না। সমাজ ও নিজের জন্য মঙ্গলের জন্য ভাল মানুষ হতে হবে।”
বিহারে আইআইটিতে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সুপার ৩০ তৈরি করেছিলেন আনন্দ কুমার নামে এক গণিতজ্ঞ। সেরা তিরিশ মেধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পাটনার এই শিক্ষা উদ্যোগকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা হচ্ছে। হৃতিক রোশন রয়েছেন যার মুখ্য চরিত্রে। বাংলার এক পাণ্ডববর্জিত গ্রামে আরও এক আনন্দ কুমার রয়েছেন। যিনি নীরবে নিজের কাজ করে চলেছেন। যিনি শিখিয়ে যান শিক্ষাকে বহন নয় বা বাহন করে এগোতে হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.