রঞ্জন মহাপাত্র: কঠোর শ্রমের বিনিময়ে জমিতে ফসল ফলাচ্ছেন। সেই ফসল বাজারে গিয়ে বিক্রি করছেন। তার থেকে যা উপার্জন হচ্ছে তাতে মোটামুটি চলছে সংসার। কাউকে আপনি ঠকাচ্ছেন না, নিজেও ঠকছেন না। তাই দিব্যি গায়েগতরে খেটে চাষের কাজ করে সৎ পথে উপার্জন করছেন।
[সরকার পাঠাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, কোন চক্র উধাও করছে রেশনের চাল-গম?]
কোন পথে প্রতারণা?
এই প্রতিবেদন কৃষক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চাষিভাইরা কি জানেন আপনার অজান্তে কীভাবে ঠকে চলেছেন? আপনি কি জানেন চাষের কাজে যে সার ব্যবহার করছেন তাতে সরকার ভরতুকি দেয়? যাতে আপনি কম খরচে সার কিনে কৃষিজ ফসল উৎপাদন করতে পারেন। কিন্তু সার ব্যবসায়ীরা পাকা রসিদ না দিয়ে আপনার থেকে ১ কেজি সারের বিনিময়ে অনেক বেশি টাকা নিয়ে নিজেরা বড়লোক হচ্ছে আর আপনি দিনরাত খেটেও লভ্যাংশ দেখতে পাচ্ছেন না। তাই এবার থেকে সার কিনতে দোকানে গেলে পাকা রসিদ চাইবেন। আর যদি তারা দিতে অস্বীকার করে তাহলে সরাসরি ব্লক কৃষি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করুন। তাহলেই আপনার ঠকার ভয় থাকবে না।
যত বিক্রি তত ‘জল’
আপনার থেকে ইউরিয়ার দাম কেজিতে ২-৩ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। সার বিক্রেতাদের অভিযোগ, হোলসেলাররা বিক্রির সময় ইউরিয়া সারের কুইন্টালে ৬০-৭০টাকা বেশি নিচ্ছেন। কুইন্টাল পিছু সারের সরকারি দাম যেখানে ৫৯০ টাকা, সেখানে ডিলারদের কাছে ৬৫০-৬৬০টাকা নেওয়া হচ্ছে। সেই কারণে ডিলাররা নাকি কৃষকদের বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সব হিসেবের শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বা ঠকছেন কিন্তু কৃষকরাই। তাই কৃষকদের এবার সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন হয়েছে।
[ঘিতে মিশছে রাসায়নিক-চর্বি, কীভাবে ভেজাল ধরবেন?]
কী ব্যবস্থা প্রশাসনের?
রাজ্যের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা সারের কালোবাজারির অভিযোগ তুলেছিলেন অনেক আগেই। অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয় রাজ্য কৃষি দপ্তর। সেই মতো পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় সার দোকানে হানা দেন কৃষি দপ্তরের আধিকারিকরা। জেলা মুখ্য কৃষি আধিকারিক সুশান্ত মহাপাত্রের নেতৃত্বে ৫ জনের একটি দল খেজুরির হেঁড়িয়ায় থাকা সার দোকানগুলিতে সম্প্রতি অভিযান চালায়। একইভাবে কাঁথি, ভগবানপুরেও তল্লাশি চলবে বলে জানা গিয়েছে। রাজ্যের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সার দোকানের কালোবাজারির একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। সেই অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে এই ধরনের অভিযান। সারে সরকারি মূল্যের থেকেও বেশি দাম কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া, ভেজাল ওষুধ বিক্রি-সহ একাধিক অভিযোগ উঠেছিল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। অভিযান চালিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া, সার মজুত ও বিক্রির হিসেবে গরমিল হাতেনাতে ধরেছেন কৃষি দপ্তরের আধিকারিকেরা। ১০০টিরও বেশি সারের দোকানকে শো-কজ করা হয়েছে। জেলা মুখ্য কৃষি আধিকারিক সুশান্ত মহাপাত্র জানান, রাজ্য সরকার কৃষির উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্য কৃষকদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছে। কিন্তু কৃষকদের অভিযোগ, জেলায় একাধিক সার দোকানে সরকারি নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি করা হয় না। সরকারি মূল্য থেকে অনেক বেশি দাম নেওয়া হয়। তাছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছেন বলেও উঠেছে অভিযোগ। যার ফলে কৃষি জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে জেলার বিভিন্ন দোকান হাজির হয়ে সরেজমিনে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেশ কিছু গরমিলও ধরা পড়েছে। সারের কালোবাজারি রুখতে দোকানগুলিতে পয়েন্ট অব সেলিং মেশিন বসাতে চাইছে কৃষি দপ্তর। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অধিকাংশ দোকানে এই যন্ত্র বসানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু এলাকায় কাজ শুরুও হয়েছে।
[দেখতে ছানা টাটকা, দুধ কাটাতে ব্যবহার হচ্ছে ‘বিষ’]
বিনা রসিদে কারবার
সার বিক্রিতে বেনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কৃষকের সুবিধায় ইউরিয়া, ডিএপি ও পটাসিয়াম-সহ বিভিন্ন সারে সরকার ভরতুকি দিয়ে থাকে। বাজারদরের থেকে কম দামে প্রয়োজনীয় সার পেয়ে থাকেন চাষিরা। এই ভরতুকিযুক্ত সার সরকার অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরো দোকানেই বিক্রি করা হয়। যাতে কৃষকরা কম টাকার বিনিময়ে সার ব্যবহার করে চাষ করতে পারেন। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাতে সরকারের নির্ধারিত দামের থেকে বেশি টাকায় সার বেচেন কৃষকদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিক্রেতারা কৃষকদের পাকা রসিদ না দিয়েই সার বিক্রি করেন। তাই প্রশাসনও সেভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়।
প্রতারক ধরতে ব্যবস্থা
সার্বিকভাবে সারের কালোবাজারি রুখতে ও বণ্টন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে কেন্দ্র সরকার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। তাতে পিওএস যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিটি ভরতুকি মূল্যের সারের দোকান অনলাইনে যুক্ত থাকবে কেন্দ্রীয় সার-রসায়ন মন্ত্রক এবং রাজ্যের কৃষি দপ্তরের সঙ্গে। প্রতিদিন কত পরিমাণ সার কেনাবেচা হল, তার হিসাব সরাসরি গিয়ে পড়বে কেন্দ্রীয় সার-রসায়ন মন্ত্রকে। আবার ওই যন্ত্র থেকে বের করে ছাপানো রসিদ দিতে হবে প্রত্যেক কৃষককে। এতে সার সরবরাহ এবং বণ্টন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আসবে বলে কৃষি দপ্তর মনে করছে। পূর্ব মেদিনীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১২০০ সারের দোকান রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৮৬৭ টি সারের দোকানে এই যন্ত্র বসানোর কাজ হবে। জেলায় সরকারিভাবে বিনামূল্যে পিওএস যন্ত্র বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।
[আলুতে দেদারে মিশছে বিষাক্ত রং, বুঝবেন কীভাবে?]
ছাঁকনির ফাক গলে
ইতিমধ্যে জেলা কৃষি দপ্তরের পক্ষ থেকে ব্লক কৃষি আধিকারিকদের এলাকার ১০টি করে বড় সার দোকানের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই তালিকার মধ্যে যে কোনও পাঁচটি দোকানে সারপ্রাইজ ভিজিট করা হয় অর্থাৎ ২৫টি ব্লকের প্রায় ১২০টি দোকানে অভিযান চালানো হয়েছে। কৃষি দপ্তরের অভিযোগ, সার দোকানগুলিতে অভিযানের সময় দেখা যায় সিংহভাগ জায়গায় ডিসপ্লে বোর্ড ঝোলানো নেই। থাকে না কোনও স্টক রেজিস্ট্রার। এননকী প্রায় কেউই সার বিক্রির পর পাকা রসিদ দেন না। কোনও কোনও দোকানে যদিও বা ডিসপ্লে বোর্ড রয়েছে, সেখানে তথ্য আপডেট করা নেই। কৃষি দপ্তরের ব্যর্থতার কারণে জেলা জুড়েই সার ব্যবসায়ীদের বড় অংশ মুনাফার জন্য এভাবেই সারের চরম কালোবাজারি করে চলেছেন। যা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কৃষি দপ্তরকে রীতিমতো চিন্তায় ফেলেছে।
[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.