Advertisement
Advertisement
Purulia

কুড়মি কাঁটায় বিদ্ধ পদ্ম, সরল শান্তিরাম ‘অ্যাডভান্টেজ’ তৃণমূলের, পুরুলিয়ায় আর কারা ফ্যাক্টর?

ক্রমশ চাপ বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের ঘরে-বাইরে।

Lok Sabha Election 2024: In depth analysis of Purulia constituency
Published by: Paramita Paul
  • Posted:March 27, 2024 8:12 pm
  • Updated:March 27, 2024 10:58 pm

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ভরা বসন্তের হাওয়ায় দুলছে পলাশের ডাল। লাল-হলুদে একেবারে রঙিন। নাকে লাগছে মহুয়ার মাতাল করা গন্ধ। মাঠের পর মাঠ শুধুই ঝরা পাতা। কুসুমের কচি লাল পাতায় ফেরানো যাচ্ছে না চোখ। তাই বনমহল পুরুলিয়ায় দেওয়ালে বিক্ষিপ্তভাবে ভোটের রঙ থাকলেও মনে যে এখনও বসন্তের-ই রং। তাই পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পুরুলিয়া, জয়পুর, বাঘমুন্ডি, বলরামপুর, কাশিপুর, পাড়া, মানবাজার বিধানসভার ‘পলাশ’ ভূমে এবারও পদ্ম ফুটবে কিনা এখনই বলা বড় মুশকিল। পদ্মে যে এবার কাঁটা উদীয়মান সূর্য! দোল-হোলিতে যেভাবে হলুদ রং উড়ল তাতে ক্রমশ চাপ বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের ঘরে-বাইরে। তাই একেবারে গোড়া থেকেই ‘অ্যাডভান্টেজ’ নিয়ে ভোট যাত্রা শুরু করে ঘাসফুল শিবির।

জনবিন্যাস
লোকসভা কেন্দ্রের মোট ভোটার: ১৮ লক্ষ ১৯ হাজার
মুসলিম ভোটার: ৬ শতাংশ
তফসিলি উপজাতি ভোটার: ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার অর্থাৎ প্রায় ৬ শতাংশ
তফসিলি জাতি ভোটার: ৩ লক্ষ ৪০ হাজার অর্থাৎ ৬ শতাংশের কিছু বেশি
ওবিসি অর্থাৎ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে কুড়মি জনজাতি ভোটার: ৩৫ শতাংশ
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) ভোটার: ১৬.৮ শতাংশ

Advertisement

 

Advertisement

[আরও পড়ুন: দিলীপের বিরুদ্ধে কমিশনে গিয়ে বেলাগাম কুণাল, ফের শুভেন্দুকে ‘বাবা’ তুলে আক্রমণ]

ইতিহাস
লোক সেবক সংঘের সাংসদ: ৩ বার
কংগ্রেস সাংসদ: ১ বার
ফরওয়ার্ড ব্লকের সাংসদ: ১১ বার
তৃণমূল সাংসদ: ১ বার
বিজেপি সাংসদ: ১ বার

২০১৪ সালে বছরের লোকসভায় পুরুলিয়ার শুষ্ক মাটিতে ঘাসফুল ফোটান তৃণমূলের মৃগাঙ্ক মাহাতো। তবে চমকে দিয়ে ২০১৯ সালে পুরুলিয়া পদ্ম ফোটান জ্যোর্তিময় সিং মাহাতো। ২০১৯ সালে ২ লক্ষের বেশি ভোটে হেরেছিল তৃণমূল। সেই জায়গা থেকে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মানবাজার, বাঘমুন্ডি বিধানসভা দখল করে ঘাসফুল শিবির। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মানবাজার থেকে লিড পেয়েছিল তৃণমূল-ই। ২০১৯ এর পর বাঘমুন্ডি বিজেপির শক্ত ঘাঁটি ছিল।

বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো।

গত পঞ্চায়েতে পুরুলিয়া কেন্দ্রে বিজেপি ধরাশায়ী হয়। জেলা পরিষদে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল বিজেপি। একটি পঞ্চায়েত সমিতিও দখল করতে পারেনি তারা। তবে এটা বলতেই হবে সহজ- সরল শান্তিরামকে দিল্লি পাঠাতে তৃণমূল যে কৌশলি চাল চেলেছে তাতেই রীতিমতো বাজিমাত এই বনমহলে। আর উলটোদিকে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী বঙ্গ বিজেপির রীতিমতো হেভিওয়েট, এমনকি দিল্লিও যাকে এক নামে চেনে। সেই রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। কিন্তু এই বিদায়ী সাংসদ যে বনমহলে গত পাঁচ বছরে নিজের ‘জ্যোতি’ ছড়িয়ে দিতে পারেননি।

তৃণমূল প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতো।

 

গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি

‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত থেকে এই জেলায় উত্থান বিজেপির। আরও সঠিকভাবে বললে পুরুলিয়া থেকেই উত্থান বঙ্গ বিজেপির। সেই রামচন্দ্র আবেগে পদ্মের পিছনে আর জনস্রোত থাকছে না। একুশের বিধানসভাতেই ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পুরুলিয়া জেলা বিজেপিকে। আর পঞ্চায়েত ভোটে একেবারে ধরাশায়ী। রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে একরাতে ঝড় ওঠাতে চাইলেও ফাগুনের শেষ বেলায় বসন্তের খামখেয়ালি বৃষ্টি তা থামিয়ে দেয়। কিন্তু তা যে মানতে চাইছে না পুরুলিয়া বিজেপি।

কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো।

এবার আর রাম-বাম হাতে হাত হচ্ছে না। ২০১৯-এ জঙ্গলমহলের নিচুতলায় ওই হাত মেলানো যে কত বড় ভুল হয়েছিল তা বামফ্রন্টকে বিশেষ করে সিপিএমকে বুঝিয়ে দিয়েছে একুশের বিধানসভা। আর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের আসনগুলির নিরিখে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৪২৪। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের হিসাব বলছে, এর প্রায় অর্ধেক ভোট, ‘জয় শ্রীরাম’ আবেগে গত লোকসভায় পদ্মে পড়েছিল। কংগ্রেস ভোটও পড়ে বিজেপিতে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের আসনগুলির নিরিখে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ৮৮ হাজার ৪৮৩। এই ভোটের অর্ধেক গিয়েছিল বিজেপিতে। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো আর এবার কোনও আত্মঘাতী অঙ্ক কষবেন না। যাতে হাতের ভোট গেরুয়ার দিকে ঝুঁকে না পড়ে। একুশের বিধানসভায় যে বাঘমুন্ডি ‘হাত’ খালি করে দিয়েছে। সেখান থেকে ঠেকে শিখে পঞ্চায়েতে ৯০ হাজার ছুঁইছুঁই ভোট টেনেছেন। আর পদ্ম ফোটানোতে এবার যাঁরা সবচেয়ে বড় কাঁটা সেই উদীয়মান সূর্যের আদিবাসী কুড়মি সমাজের পঞ্চায়েতে জেলা পরিষদের নিরিখে তাদের প্রাপ্ত ভোট ৬৮ হাজার ১৯৮। অথচ সব আসনে কুড়মি সমাজ সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ছিল না। গত লোকসভায় এই শাসকবিরোধী ভোট পড়েছিল পদ্মে। এবার বিজেপি থেকে সেই ভোট ‘মাইনাস’ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। অর্থাৎ ভোট কাটাকাটির অঙ্কে কী হতে পারে তা সকলের কাছে পরিষ্কার। আর তাই প্রথম থেকেই চওড়া হাসি শান্তিরামের।

 

আদিবাসী কুড়মি সমাজের অজিতপ্রসাদ মাহাতো।

প্রার্থী পরিচয়

২০১৯-এ এই বাংলায় বিজেপির ঢেউ ছিল যেমন ‘নতুন’। তেমন-ই পুরুলিয়া কেন্দ্রে ‘নতুন’ ছিলেন তরুণ জ্যোতির্ময়। কিন্তু এই ৫ বছরে পুরুলিয়া জ্যোতির্ময়কে ভালোভাবে দেখে নিয়েছে। বুঝে নিয়েছেন তিনি পুরুলিয়ার জন্য সংসদে কী করতে পারেন! কিন্তু ২০১৯-এ তিনিই আশা জাগিয়েছিলেন। কারণ তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ গতবারে এই কেন্দ্রে শাসক দলের প্রার্থী থাকা চিকিৎসক মৃগাঙ্ক মাহাতো যে কোন দাগ কাটতেই পারেননি। তাই এই বনমহল জ্যোতির্ময়ে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু তা যে ভুল ছিল সাবেক মানভূমের হাটে-বাজার এখন কান পাতলেই তা শোনা যাচ্ছে। এবারে যে শাসকের প্রার্থী প্রবীণ শান্তিরাম মাহাতো। তাঁর বিরুদ্ধে অতি ধীরে চলো যতই অভিযোগ উঠুক না কেন। পাঁচ বারের বিধায়ক, দু’বারের মন্ত্রী এই রাজনীতিকের আন্তরিকতা, আদ্যোপান্ত মানভুঁইয়া সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা সহজ-সরল জীবন যাপনে ‘মনের মানুষ’। প্রার্থীদেরর মধ্যে রয়েছেন আদিবাসী কুড়মি সমাজের অজিতপ্রসাদ মাহাতো। পাঁচবার জেলে গিয়েছিলেন। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতোও এবার বড় ফ্যাক্টর হবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

[আরও পড়ুন: ‘তাঁর প্রজ্ঞা বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে’, বেলুড় মঠের অধ্যক্ষের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ মোদি]

সম্ভাবনা
জঙ্গলমহল জুড়ে শাসকের উন্নয়নের জোয়ারে একেবারেই চাপা পড়ে গিয়েছে তৃণমূলের বেনিয়ম। যেখানে দাগ কাটতে পারছে না কেন্দ্রের বিকশিত ভারতও। সবুজশ্রী থেকে সমব্যথী। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানান প্রকল্প। আর সর্বোপরি লক্ষ্মীর ভান্ডারের অর্থ বৃদ্ধিতে বনমহলের মহিলা মহল ভোলেনি একুশের সেই স্লোগান, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চাই।’ নানান সমীকরণে গেরুয়া ঝড় থেমে গিয়েছে বটে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বিজেপির অতিসক্রিয়তা অনেক হিসাব-নিকাশকেই ওলটপালট করে দিতে পারে। যেখানে বহু পিছিয়ে তৃণমূল। ফলে প্রচারের ওই একটা প্ল্যাটফর্মেই ‘অন্য খেলা’ হয়ে যেতে পারে এই বনমহলে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ