চন্দ্রজিৎ মজুমদার: দেশের ইতিহাস নিয়ে চর্চা হলে সেখানে নিঃসন্দেহে স্থান পাবে মুর্শিদাবাদ। কারণ পলাশির যুদ্ধ হোক কিংবা হাজারদুয়ারির মতো একাধিক স্থাপত্য, সেখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু সেই মুর্শিদাবাদেই কিনা উপেক্ষিত রাধা সাগর দিঘি। নাম শুনলে কপালে ভাঁজ পড়বে। প্রশ্ন উঠতে পারে কী এমন ইতিহাস রয়েছে এই দিঘির? কিন্তু একটু সবিস্তারে খোঁজ খবর নিলেই দেখা যাবে এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। মহারাজ নন্দকুমার থেকে সুপণ্ডিত রাধামোহন ঠাকুর, রাধা সাগর দিঘির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এদের নাম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না সেটা। ফলে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও উপেক্ষিত রয়েছে এই দিঘি।
কী সেই ইতিহাস? মহারাজ নন্দকুমার গুরুগৃহ মালিহাটি গ্রামে এসেছেন গুরু রাধামোহনের বিবাহ উপলক্ষ্যে। গুরু বললেন, এলাকায় পানীয় জলের খুব সমস্যা। শিষ্য সূর্য উদয়ের সময়ে একজন রক্ষীকে বললেন, গ্রামের পূর্ব মাঠে প্রভুর বাড়ির সামনে থেকে ঘোড়া ছোটাও। এক চাবুকে ঘোড়া দক্ষিণ দিকে যত দূর যাবে তত লম্বা একটা দিঘি কাটানো হবে। ঘোড়া পৌঁছল তালিব পুরের কোল পর্যন্ত। রাজার আদেশ হল, তত লম্বা দিঘি কাটানো হবে প্রভুর জন্যে। কিন্তু প্রভু চাষের এত জমি নষ্ট না করে ১০০ বিঘা জলা জমি নিয়ে খনন করলেন রাধা সাগর দিঘি।
দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে রাধাসাগর দিঘির এই ইতিহাসের কথা শোনাচ্ছিলেন গ্রামেরই এক বাসিন্দা। তিনি অবশ্য এসব কথা শুনেছেন ঠাকুরদার কাছে। ঠাকুরদা কার কাছে শুনেছেন সেটা বলতে পারলেন না তিনি। তবে, একথা বললেন, এই বিশাল পুকুরের পিছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা জানে না এলাকারই অনেকেই। তাই পুকুর পড়ে রয়েছে কচুরিপানা ভর্তি হয়ে। জঙ্গল হয়ে রয়েছে পাড়গুলি। যে যেভাবে পারছেন ব্যবহার করছেন এই ঐতিহাসিক পুকুরটি। গা ধোওয়া থেকে কাপড়কাচা, কেউ দেখারও নেই, বারণ করারও নেই। সেই আক্ষেপই করছিলেন পুকুরের ইতিহাস জানা এলাকার অনেকে। অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন রাধামোহন ঠাকুর সম্পর্কেও। এলাকার বাসিন্দা তথা কান্দি রাজ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “মুর্শিদাবাদের সালার থানা এলাকায় খুব পরিচিত ছিলেন বৈষ্ণব শাস্ত্রে সুপণ্ডিত জগদানন্দের প্রথম পুত্র রাধামোহন। রাধা মোহন বৃন্দাবনে ৬ বছর বাস করে বৈষ্ণব শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে মালিহাটিতে ফিরেছিলেন। শুধু তাই নয়, পলাশির যুদ্ধের পর মীরজাফর বাংলার নবাব। জয়পুর থেকে কৃষ্ণদেব এলেন মুর্শিদাবাদে। তিনি বললেন, আপনার দেশের যে কোনো পণ্ডিত কে আমি হারিয়ে দেবো। একে একে এলাকার সব পণ্ডিত হেরে গেলেন। শেষে নবাব নন্দ কুমারের একান্ত অনুরোধে রাধামোহন এলেন মুর্শিদাবাদে। পাণ্ডিত্যে হারালেন জয় সিংহের পণ্ডিত কে। তিনি লিখে দিলেন বিজয় পত্র। আর নবাব দিলেন প্রচুর সম্পত্তি।” কান্দির বাসিন্দা তথা কান্দি লাল স্কুলের শিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “রাধামোহন প্রথম বঙ্গ দেশে প্রচলিত আড়াই হাজার বৈষ্ণব পদ সংকলন করেন তার ‘পদকল্প তরু’ বইয়ে।”
কিন্তু কীভাবে যাবেন রাধাসাগর দিঘিতে? আজিমগঞ্জ রেল লাইনে সালারের কাছেই রয়ে গিয়েছে মালিহাটি গ্রাম। সেখানেই গেলে দেখতে পাবেন এই দিঘি। তবে রাধামোহনের মূল ভিটে আজ আর আলাদা করে বোঝা যায় না। শুধু সাক্ষী হিসাবে থেকে গিয়েছে কয়েকটি তমাল গাছ। আর একটি প্রায় ভেঙে পড়া দেওয়াল। আর রয়েছে সেই রাধাসাগর দিঘি। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। সেই দিঘির পাড়ে দাঁড়ালে যেন এখনও সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে অনেকের মানসচক্ষে। চিঁহি আওয়াজ তুলে বল্গাহীন ঘোড়া ছুটে চলেছে দক্ষিণে। গিয়ে থামল তালিবপুরের কোলে। তারপরই শুরু হল একশো বিঘের দিঘি কাটা। জলাভাব কাটল। এলাকার নাম যুক্ত হয়ে গেল এক ইতিহাসের সঙ্গে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.