স্টাফ রিপোর্টার: তিনি ছিলেন অপরিচিত। মৃত্যুর পরও থেকে গেলেন অপরিচিতই। জানা গেল না তাঁর আসল নাম ও ঠিকানা। আর প্রকৃত পরিচয় না জানা যাওয়ায় তাঁর মৃতদেহের দাবিদারও কেউ নেই। শেষপর্যন্ত তাঁর মৃতদেহের সৎকারের দায়িত্ব নিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই। কারণ, প্রায় সতেরো বছর ধরে তিনি রোগী হিসাবে ছিলেন হাসপাতালেই!
[তামিলনাড়ুতে বাঙালি শ্রমিকের রহস্যমৃত্যু, দুর্ঘটনা মানতে নারাজ পরিবার]
লোকমুখে তাঁর নাম হয়েছিল লোকনাথ। যাঁর একমাত্র ঠিকানা ছিল হাসপাতালের বেড। হাসপাতালই ছিল ঘরবাড়ি। ডাক্তার, নার্স, আয়া আর হাসপাতালে আসা রোগীরাই তাঁর সব। এত বছর ধরে ওঁরাই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর আত্মীয়-বন্ধু। গড়ে উঠেছিল মায়ার টান, স্নেহের সম্পর্ক, পিতৃত্বের বন্ধন। হয়তো বা আরও কিছু। বৃহস্পতিবার সকালে তাই তাঁর মৃত্যু হাসপাতালের গতানুগতিক পরিবেশকেও ভারী করে তুলেছিল। কেঁদে ফেলেছিলেন হাসপাতালের নার্স, ডাক্তাররাও। বৃদ্ধ লোকনাথের মৃত্যুতে নদিয়ার শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ছিল এদিন শোকের পরিবেশ। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়া, কর্মীরাই ফুলের মালায় লোকনাথকে জানিয়েছেন শেষ শ্রদ্ধা। ডাক্তার-নার্সরা নিজেরা চাঁদা তুলে করেন সৎকারের ব্যবস্থা।
ঠিক কবে তাঁকে কে বা কারা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, তা এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন না হাসপাতালের কেউই। আসলে যে সময় গড়িয়ে গিয়েছে নয়-নয় করে প্রায় সতেরো বছর। হাসপাতালের প্রবীণ কর্মীরা জানালেন, যতদূর মনে পড়ে ওঁকে কয়েকজন লোক অসুস্থ অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে বাড়ির লোকজন কেউ ছিলেন না। যাঁরা এনেছিলেন, তাঁরা কেউই রোগীর নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি। বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরও রোগী নিজে নাম পরিচয় সঠিকভাবে জানাতে পারেননি। সেই থেকে হাসপাতালেই থেকে যান তিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাম -ঠিকানা জানার চেষ্টা করে। কয়েকবার নাম-ঠিকানা বলেছিলেন তিনি। পুলিশের মাধ্যমে খোঁজখবরও নেওয়া হয়। কিন্তু কিছুই মেলেনি। শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে হাসপাতালেই পাকাপাকিভাবে থেকে যান তিনি। হাসপাতালের নার্স, কর্মীরা জানালেন, নাম তো বলতে পারেননি। তাই আমরাই ওঁর নাম রাখি সবাই মিলে। ওঁর টুকটুকে ফর্সা গায়ের রং, সাদা দাড়ি, সাদা পোশাক দেখে আমরা লোকনাথ বলে ডাকতে থাকি। উনিও সেই নামেই সাড়া দিতেন। সতেরো বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও লোকনাথবাবুকে দেখতে বাড়ির কেউ আসেননি। অথচ আমরা কেউ ওঁকে বাবার মতো, কেউ বা দাদুর মতো ভালবাসতাম। শ্রদ্ধা করতাম। হাসপাতালের আয়া রেখা দাস চোখের জল মুছে বললেন, “এতগুলো বছর ধরে একটা টান পড়ে গিয়েছিল, তা ভুলি কী করে? ওঁকে বাবার মত শ্রদ্ধা করতাম। দেখভাল করতাম।”
বার্ধক্যজনিত রোগে বৃহস্পতিবার প্রায় ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলেন লোকনাথবাবু। যদিও মৃত্যুর পরও তাঁর মৃতদেহের দাবি জানাতে স্বাভাবিকভাবেই কেউ আসেননি। ফলে কার হাতে তুলে দেওয়া হবে মৃতদেহটি, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে শান্তিপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল সুপার জয়ন্ত বিশ্বাস জানিয়েছেন, “উনি অনেকদিন ধরেই রোগী হিসাবে ছিলেন। যদিও খাতায়-কলমে ভর্তির রেকর্ড রয়েছে মাত্র এগারো মাস। যেহেতু মৃতদেহের কোনও দাবিদার নেই, তাই সব নিয়ম মেনে হাসপাতালের পক্ষ থেকেই তাঁর সৎকার করা হয়।”
[শুক্রবার থেকে টানা ৩ দিন ব্যাঙ্কের ঝাঁপ বন্ধ, আপনি জানেন কি?]