সন্দীপ মজুমদার, উলুবেড়িয়া: ছোটবেলা থেকেই পাহাড় আর জঙ্গল তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই সুযোগ ও সময় পেলেই তিনি ছুটে যেতেন পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে। সেটাই যেন ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব একটা পৃথিবী। কোনও পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছলেই তিনি যেন ছোট্ট এক শিশু হয়ে যেতেন। বহুবার তিনি তাঁর বন্ধুদের কাছে বলতেন, “এমন অপার্থিব পরিবেশে মৃত্যুবরণ করা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।”
প্রকৃতিরানি যেন তাঁর সেই কথা শুনেছিলেন। তাই মাত্র ২৮ বছর বয়সেই প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিলেন বাগনান থানার খালোড় গ্রামের বাসিন্দা সৌরভ সামন্ত। বুধবার বিকেলে পশ্চিম হিমালয়ের ফালুটের তুষারশৃঙ্গ থেকে অবতরণের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন এই তরতাজা প্রাণোচ্ছ্বল যুবক। তাঁর সঙ্গে থাকা মিংমা শেরপা সৈকতের হার্ট পাম্প করে কৃত্রিমভাবে তাঁর হৃদযন্ত্রকে সচল করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর সব চেষ্টা বিফলে যায়।
[ মদ্যপ ছেলের অত্যাচারে ঘরছাড়া, পুলিশের দ্বারস্থ ৮০ বছরের বৃদ্ধা ]
বৃহস্পতিবার সকালে বাগনান থানার বোড়োর গ্রামে সৈকতদের পুরনো বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল অসংখ্য মানুষের ভিড়। সকলেই চাপা স্বরে কথা বলছেন। সকলের মধ্যেই এক অদ্ভুত হতাশা লক্ষ করা গেল। হা-হুতাশ করছেন সারা গ্রামবাসী। জানা গেল, সৈকতের মা বন্যাদেবীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির দোতলার একটা ঘরে বিছানার উপর চুপচাপ বসে ছিলেন সৈকতের বাবা কৃষ্ণবাবু। দু’চোখ বেয়ে তখন শুধুই জলের ধারা বইছে। পাশে গিয়ে বসতে একবার শুধু মুখ তুলে তাকালেন। কেঁদে কেঁদে তাঁর চোখদুটো তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চন্দ্রভাগ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মলয় সাহা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পৃথিবীর কোনও সান্ত্বনাই হয়তো সেই মুহূর্তে তাঁর আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। ঘটনার কথা জানতে চাইলে তিনি ঘন ঘন মাথা নাড়লেন। মুখ দিয়ে শুধু বিড়বিড় করে বললেন, “মঙ্গলবার সৈকত তার মাকে শেষবারের জন্য ফোন করেছিল। তারপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনও কথা হয়নি।” তিনি শুধু এইটুকু বলতে না বলতেই ভেঙে পড়লেন কান্নায়।
বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল সৈকতের কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল যে সৈকত ভ্রমণপাগল যুবক ছিল। বছর ছয়েক আগেই তাঁরা সপরিবার বোড়োর গ্রাম ছেড়ে বাগনানের খালোড়ে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে সৈকতের নামেই ‘সৈকত ভিলা।’ তাঁরা জানান এভারেস্ট অভিযান নাকি তাঁকে নাড়া দিয়ে যেত। মনে মনে হয়তো সে এভারেস্ট অভিযানের স্বপ্ন দেখত। আর তাই হয়তো সে বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিং করে এভারেস্ট অভিযানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। সৈকতের আরও এক সঙ্গী দীপ্তরূপ ভৌমিক জানান, গত ৫-৬ বছর ধরে সৈকত বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছে। তবে এর আগে কখনও সে ট্রেকিংয়ে যায়নি। এবারেই প্রথম সে ট্রেকিংয়ে বেরিয়েছিল। গত মার্চ মাসে দীপ্তরূপবাবুরা সৈকতের সঙ্গে ঝাড়গ্রাম বেড়াতে গিয়েছিলেন। সৈকত ছিল অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল এক যুবক। সে আনন্দ করতে ও সকলকে আনন্দ দিতে ভীষণ ভালবাসত। গত বছরেও সে বন্ধুদের নিয়ে ভুটান বেড়াতে গিয়েছিল। তাই সৈকতের মতো ছেলের এই রকম পরিণতি দীপ্তরূপবাবুরা কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। সৈকত আর কোনওদিন সকলকে এভারেস্ট অভিযানের স্বপ্ন দেখাবে না।
[ অবসরপ্রাপ্তদের লক্ষাধিক টাকা সাহায্য করলেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ]