শংকরকুমার রায়, রায়গঞ্জ: প্রিয়-দীপ নির্বাপিত হল।
রায়গঞ্জের কুলিক নদীর ধারে বসেই প্রথম জীবনের বহু সময় কাটিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন। সেখানেই ছড়া গেঁথেছেন তিনি। সেই কুলিক নদীর তীরেই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিতার আগুনে মুছে গেল প্রিয়র নশ্বর দেহ। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন বাংলার গত অর্ধশতাব্দীর এক বর্ণময় চরিত্র। যাঁর কণ্ঠস্বরে বাংলা তথা দেশের অজস্র ছাত্র-যুব উন্মাদনায় মুখর হত, সেই প্রিয় মানুষটি আজ চিতাভস্মে মিলিয়ে গেলেন। হেলিপ্যাড থেকে রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ হয়ে বন্দর শ্মশান। সর্বত্রই ছিল অজস্র মানুষের ঢল। যে রাস্তা দিয়ে একসময় তিনি নিজেই হুডখোলা জিপে এগিয়ে যেতেন, আর দু’পাশ থেকে জনতা ফুল ছুড়ে দিত, সেই পথেই আজ আবার এগিয়ে এল তাঁর নশ্বর দেহ। আগে ফুল ছুড়লে পাল্টা হয় হাসি, নয়তো ফুলের মালা ছুড়ে দিতেন। কিন্তু এদিন আর প্রত্যুত্তর এল না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ তো অবশ্যই, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা চোখের জলে বিদায় জানালেন রায়গঞ্জের প্রিয় মানুষটিকে। ভারাক্রান্ত লক্ষ কণ্ঠে স্লোগান উঠল, ‘প্রিয়দা অমর রহে’।
শোকে-শ্রদ্ধায় ঘরের নেতাকে বিদায় জানাল রায়গঞ্জ-কালিয়াগঞ্জ। রায়গঞ্জ আশায় ছিল, একদিন সুস্থ হয়ে তিনি ফের ফিরে আসবেন তাঁর প্রিয় শহরে। এলেনও। কিন্তু কফিনবন্দি হয়ে। মঙ্গলবার বারবেলায় রায়গঞ্জের ভূমিপুত্র প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির কফিনবন্দি মৃতদেহ হেলিকপ্টারে এসে পৌঁছল শহরে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৪.৩০ পেরিয়েছে। সকাল থেকেই শহরের কসবায় রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের চতুর্থ ব্যাটালিয়নের ব্যারাকের হেলিপ্যাডের আশপাশে ভিড় জমিয়েছিলেন প্রিয় অনুরাগীরা। হেলিপ্যাডে হাজির ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন সেই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। হেলিকপ্টার নামতেই সবাই একবার কফিনবন্দি তাঁদের প্রিয় নেতাকে দেখতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ভিড় সামলাতে তখন হিমশিম পুলিশ। অনেকের চোখেই জলের ধারা। পরিস্থিতি সামলাতে শেষপর্যন্ত প্রিয়পত্নী দীপাকেই হাতজোড় করে সবাইকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করতে হল। সে সময় পাশে ছিল একমাত্র ছেলে প্রিয়দীপ, দলীয় নেতা আবদুল মান্নান। কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে তাঁরাই প্রিয়বাবুর শেষযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন। শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকে হাজির মালদহের কংগ্রেস নেত্রী মৌসম বেনজির নুর। তিনি শেষপর্যন্ত হাজির ছিলেন প্রিয়বাবুর শেষযাত্রায়।
শুনশান রায়গঞ্জ
প্রাণপ্রিয় নেতাকে হারিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকেই শুনশান রায়গঞ্জ শহর। বন্ধ অধিকাংশ দোকানপাট। নানা পরীক্ষার জন্য স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও সেখানে পরীক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের হাজিরা প্রায় নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ারও তেমন দেখা নেই। মাঝে মধ্যে চলছে কয়েকটি সরকারি বাস। অনেকটা অঘোষিত বনধের চেহারা নিয়েছে রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জ শহর। রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ডালখোলা ও ইসলামপুর পুরসভায় অর্ধদিবসে কাজের পরই প্রিয়বাবুর স্মরণে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। সবারই গন্তব্য হয় হেলিপ্যাড ময়দান নতুবা কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির প্রিয়বাবুর বাড়ি। শহরের সেন্ট্রাল মার্কেটের দোকানদাররা সকাল থেকে তাঁর ছবিতে বড় রজনীগন্ধার মালা দিয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। কারণ, রেলের জমিতে তৈরি এই মার্কেট এক সময় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিই রেলের উচ্ছেদ অভিযানের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। এই বাজারের মালিকানা তুলে দিয়েছিলেন দোকানদারদের হাতে।
কালিয়াগঞ্জের বাড়ি
কালিয়াগঞ্জ স্টেশন রাস্তার পাশ দিয়ে শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রীকলোনিতে প্রিয়বাবুর বাসভবন। হালকা নীল রঙের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা দোতলা বাড়ি। ঢুকতেই বাঁ-হাতে একতলার দুর্গামন্দির। কয়েকমাস আগে এই মন্দিরেই প্রিয়বাবুর ভাই সত্যরঞ্জনবাবু ঘটে মায়ের পুজো সম্পন্ন করেন। প্রিয়বাবু অসুস্থ হওয়ার আগে ২০০৮ সালে এই মন্দিরে বসে পুজোর দিনগুলিতে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়েছেন। বাড়ির সামনে থিকথিকে ভিড়। হালকা সবুজ রঙের বাড়িটা তখন বিষণ্ণতায় ঢেকে গিয়েছে। সামনের বড় উঠোনে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। একতলার নিচের বড় হলঘরটিতে যেখানে তিনি বসে সবার সব কথা শুনতেন সেই ঘরটি আজ প্রিয়জনকে হারিয়ে নীরব। যে চেয়ারে তিনি বসতেন সেখানে তাঁর একটি বড় ছবি রাখা হয়েছে। তাতে ঝুলছে টাটকা রজনীগন্ধার মালা। সামনে পুড়ছে সুগন্ধী ধূপ। পাশের বাড়িতে থাকেন অকৃত্রিম বন্ধু রমেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী। ছোটবেলায় একত্রে পড়তেন মহেন্দ্রগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর কালিয়াগঞ্জের পার্বতীসুন্দরী হাইস্কুল হয়ে রায়গঞ্জ কলেজ। যে কলেজ এখন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় নামে সুপরিচিত। এই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই পাশাপাশি বাড়ি।
দলীয় দফতর
কালিয়াগঞ্জের বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে তালতলায় ব্লক কংগ্রেস কার্যালয়। সেখানেও সকাল থেকেই দলীয় কর্মীদের ভিড়। এখানে মৃতদেহে শ্রদ্ধা জানাতে ১৫ মিনিট থাকার কথা থাকলেও দলীয় কর্মীদের আবদার মেনে শেষপর্যন্ত আধ ঘণ্টা পর দেহ রওনা হয় রায়গঞ্জের মোহনবাটিতে দলের জেলা কার্যালয়ে। সেখানে তখন অপেক্ষায় ছিলেন দলের জেলা সভাপতি মোহিত সেনগুপ্ত, তৃণমূল পরিচালিত রায়গঞ্জ পুরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান সন্দীপ বিশ্বাস, বিজেপির রায়গঞ্জ উত্তর দিনাজপুর জেলা কমিটির সহ সভাপতি পবিত্র চন্দরা। এই সন্দীপবাবু ও পবিত্রবাবু এক সময় প্রিয়বাবুর হাত ধরেই রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেন। নিজের হাতে এই দুই নেতাকে তৈরি করেছিলেন প্রিয়বাবু। সেকথা এখনও তাঁরা অন্য দলে থাকলেও স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
বন্দরের পথে
রায়গঞ্জ শহরের সুপরিচিত ‘স্বর্গপথ’ এই বন্দর শ্মশান। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে কুলিক নদী। ঠান্ডার আবহে নদীতে তেমন ঢেউ নেই। মাঝে মাঝে উড়ে আসছে দু’-একটি চেনা-অচেনা পাখি। সোমবার রাত থেকেই এই শ্মশানের দখল নিয়েছে পুলিশ। চলছে শেষবিদায়ের প্রস্তুতি। এখানেই সাজানো হচ্ছে প্রিয় নেতার চন্দনকাঠের চিতা। জড়ো করা হয়েছে ১২ কুইন্টাল চন্দন কাঠ। আনা হয়েছে আরও কাঠ। আসেন দলের রাজ্য পর্যবেক্ষক সিপি যোশী, আবদুল মান্নান। ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বাচ্চু হাঁসদা, বিনয় বর্মন প্রমুখ। এখানেই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রিয়বাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই শ্মশানে আসার পথেই প্রিয়বাবুর দেহ ছুয়ে আসে তাঁর হাতে তৈরি বিদ্রোহী ক্লাব। কিছুক্ষণ রাখা হয় রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও। উল্লেখ্য, এই বন্দর শ্মশানের আধুনিকীকরণ হয়েছে প্রিয়বাবুর হাত ধরেই। আজ সেখানেই তিনি রাতে বিলীন হয়ে যান পঞ্চভূতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.