সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর: গোদা বাংলায় কম্পিউটারে ছাপানো ‘বিজ্ঞপ্তি।’ ‘আমাকে অবহেলার কারণে আমি আই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম৷ আমাকে আর অবহেলা না করিলে সব ঠিক করে দেবো৷ ইতি-আম্মা ভগবান৷’ অজস্র ভুলে ভরা বানানে এই নোটিস এসে পৌঁছেছে কাঁকসার দেবশালার মাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। প্রেরক নাকি দক্ষিণ ভারতের কোনও এক ‘ধর্মগুরু’৷ তাঁর কাছেই দীক্ষা নিয়েছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার৷ সেই ‘ধর্মগুরু’ এবার তাঁর ভক্তকে লীলা দেখাতে হাজির কাঁকসায়৷ যদিও ‘গুরু’-র লীলার মাত্রা দেখে পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে ভক্তির থেকে শ্লেষ বেশি। তবে শুধু চিঠিতেই থেমে নেই ‘ধর্মগুরু’র লীলা৷ তিনি নাকি চব্য চোষ্য ভোজনও করছেন প্রতিদিন। খাবার পর বন্ধ ঘরে একটু পায়চারি। বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বেশ কিছু জিনিসপত্র হারিয়ে যাচ্ছিল। এবার তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বৈশাখের প্রথম দিকে আলমারির চাবিটা যায় হারিয়ে৷ বাড়ি জুড়ে চলছে খোঁজার পালা৷ হঠাৎ ব্যাগ থেকে আলমারির চাবি উড়ে এসে পড়ল মেঝেতে৷ আলমারি খুলতেই চাবির সঙ্গে মিলল ‘ধর্মগুরু’র নোটিস৷ ব্যস, স্ক্রিপ্ট তৈরি। শুরু প্রচার৷ প্রথম লোকমুখে প্রচারে তেমন গতি মিলছিল না। তাই গতি বাড়াতে ডাক সংবাদমাধ্যমকে। লক্ষ্য, রাজ্য জুড়ে প্রচার। যদিও গুরুর মহিমাতে বুজরুকির গন্ধ পাচ্ছেন বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রতিবেশীরা।
কী আছে এই ‘ধর্মগুরু’-র কাহিনিতে? তিনি নাকি সহধর্মিনীকে নিয়ে রোজ রাজকীয় ভূরিভোজ সারছেন৷ কী আছে সেই ভোজের থালায়? নানা তরিতরকারির সঙ্গে ভাত, বেগুন ভাজা-সহ বেশ কয়েক ধরনের ভাজা৷ সঙ্গে পায়েস, নানা রকমের মিষ্টির সঙ্গে সীতাভোগও৷ কিন্তু ‘ধর্মগুরু’ বলে কথা, সবার সামনে খাবেন কেন? তাই বন্ধ ঘরে থালা সাফ করছেন তিনি৷ থুড়ি, শুধু তিনি নন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও৷ খাওয়াদাওয়ার পর হজম করতে তিনি নাকি সেই বন্ধ ঘরেই সিংহাসন থেকে নেমে খড়ম পায়ে একটু হাঁটাহাঁটিও করছেন৷ গুরুর লীলা এখানেই শেষ নয়। প্রভাব দেখাতে তাঁর ছবি থেকে অবিরাম নাকি ঝরে পড়ছে মধু৷ মধুতে মধুতে জমজমাট কাহিনীতে ওই ঠাকুর ঘরের অন্যান্য ঠাকুররা বেশ কোণঠাসা৷ তাই এবার তাঁরাও লীলা দেখাতে ঢুকে পড়েন স্ক্রিপ্টে৷ ‘ধর্মগুরু’র ছবির তলাতেই গোপাল ঠাকুরের পিতলের মূর্তি৷ সপ্তাহ খানেক ধরে সেই গোপাল ঠাকুরের গা বেয়েও অঝোর ধারায় ঝরছে মধু৷ মধু নাকি শুধুই ঝোলা গুড় ঝরছে, তা নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে ভক্তদের মধ্যে৷ ইতিমধ্যেই মধুর বিভূতি নিতে বেশ কিছু ভক্ত আগ্রহও প্রকাশ করেছেন৷ এই পরিবারের সদস্য ও সেবাইত মাধব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “আম্মা ভগবানের জন্যেই আমাদের রাহু মুক্তি ঘটেছে৷ আমাদের পরিবারের বিপদ কেটেছে৷” আম্মা ভগবানের এই লীলাতে কাত হয়েছেন বাইরের বেশ কিছু ভক্তরাও।
তবে দিন দিন ওই ‘ধর্মগুরু’র লীলার মহিমা যত বাড়ছে ততই চটছেন প্রতিবেশীদের একাংশ। তাঁদের কথায়, বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির ঠাকুরঘরে দু’টো দরজা আছে। ভোগ দিয়ে সামনের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ, ভিতরের দরজা দিয়েই চলে সব কেরামতি। আর এই কেরামতিতে জড়িত ওই পরিবারের সদস্যরাই। এদিকে ‘ধর্মগুরু’র এই লীলাকে শুধু মিথ্যা প্রচার বলেই থেমে থাকেনি রাজ্য বিজ্ঞান মঞ্চ৷ এদের বিরুদ্ধে মানুষকে ঠকানো ও প্রতারণার অভিযোগ তুলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের দুর্গাপুর শাখার সম্পাদক শ্রীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘‘বুজরুকির নয়া কায়দা৷ নিত্য নতুন উপায়ে লোক ঠকানোর কারবার৷ এইভাবে ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ছক এই সব ধর্মগুরু ও তার সাগরেদদের৷ ধর্মের নামে এই লোক ঠকানোর কারবার বন্ধে পুলিশ ও প্রশাসনকেও ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তবে মানুষ এখন অনেকটাই বিজ্ঞানমনষ্ক৷ তাই সবাইকে ঠকানো আর সম্ভব নয় বলেই নিত্য নতুন ফাঁদ পাতছে এই কারবারিরা৷”
ছবি: উদয়ন গুহরায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.