রাহুল চক্রবর্তী, দাড়িভিট: তখনও সাতটা বাজেনি। ভোরের নরম রোদে ঘুমের জড়তা কাটছে একটু একটু করে। ভোট শুরু হতে বেশ খানিকটা দেরি। বুথের ভিতর ভোটকর্মীরা সবে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। রাজনৈতিক দলের এজেন্টরাও চলে আসছেন একে একে। এমন সময় ডাক পড়ত তাপসের– ‘কই রে! চা নিয়ে আয় ক’টা।’ ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১০টা । ভোট চলছে নির্বিঘ্নে। মোড়ে পার্টির ক্যাম্প অফিস থেকে তাপসের কাছে ফোন। ‘ঝটপট ১০ কাপ চা নিয়ে আয়, বাবু।’ মাঝদুপুরে সুয্যি মাথার উপর উঠতেই ফের তাপসের খোঁজ– ‘হ্যাঁ রে! খাবারের প্যাকেটগুলো রেডি তো? লোক পাঠাচ্ছি। দিয়ে দে।’ বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। নির্বিঘ্নে মিটেছে ভোটপর্ব। ভোটকর্মী, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সবার মুখেই নিশ্চিন্তির ছাপ। এবার শেষ দফা ডাক পড়বে তাপসের– ‘ভাল করে বানিয়ে চা নিয়ে আয়।’
[ আরও পড়ুন: ভোটে আগ্রহ নেই নারায়ণগড় বিস্ফোরণে মৃত দুই যুবকের পরিবারের]
উত্তর দিনাজপুরের এই গাঁয়ে ভোট আসা মানেই ব্যস্ততা বাড়ত তাপসের। চায়ের কেটলি আর কাগজের কাপ হাতে কাকভোর থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় চা নিয়ে বুথমুখো হতে তো হতই, বুথকর্মী থেকে দলীয় এজেন্ট-কর্মীদের দুপুরের লাঞ্চের প্যাকেট বা লুচি-ছোলার ডালের জলখাবার জোগান দেওয়ার যাবতীয় দায় সামলাতে হত তাঁকেই। এই তো পঞ্চায়েত ভোটের সময় অনেক রাত পর্যন্ত লাগাতার চা জোগাতে হয়েছে তাপসকেই। ‘‘আসছে ১৮ তারিখের ভোটে আর কেউ হাঁক পেড়ে বলবে না– তাপস চা নিয়ে আয়।” ছেলের ফটোর সামনে বসে অঝোরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছিলেন তাপসের মা মঞ্জু বর্মন।
গ্রামের নাম দাড়িভিট। গাঁয়ের মাঝে দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়। ইসলামপুরের এই স্কুলটাই গত ২০ সেপ্টেম্বর শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছিল। বাংলা শিক্ষকের দাবিতে আন্দোলনে নামে পড়ুয়ারা। উর্দু ও সংস্কৃত নয়, বাংলা শিক্ষক চাই– এটাই ছিল দাবি। আর সেই ঘটনায় পুলিশের গুলিতে তাপস বর্মন ও রাজেশ সরকারের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। রায়গঞ্জ লোকসভার ভোটে অন্যতম ইস্যু সেই গুলি চালানোর ঘটনা। ভোট এলে বুথ হয় স্কুলেই। আর সেই স্কুল থেকে বেরোলেই তাপসের বাড়ি। বাড়ির সামনে দোকান। চা, শিঙাড়া, মিষ্টি, লুচি-তরকারির দিনভর বিক্রিবাটা। ছেলে চলে যাওয়ার পর দোকান-খদ্দের সামলান তাপসের বাবা বাদল বর্মন। বললেন, দোকানটা চলত তাপসের জন্যই। ওঁর ব্যবহারেই লোকজন আসত। তাপস নেই। বিক্রিবাটাও অর্ধেক।