রঞ্জন মহাপাত্র, কাঁথি: রেশন নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। বরাদ্দ কম, ওজনে কারচুপি, দাম বেশি নেওয়া, পাকা রসিদ না দেওয়া। তালিকা বেশ দীর্ঘ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খোলা বাজারে রেশনের চাল, আটা বা কেরোসিন চড়া দামে বিকোচ্ছে। এসব আসছে কোথা থেকে। sangbadpratidin.in-এর অন্তর্তদন্তে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য।
[ঘিতে মিশছে রাসায়নিক-চর্বি, কীভাবে ভেজাল ধরবেন?]
প্রথমেই ‘চোর পার্টি’র দৌরাত্ম্য
কীভাবে খোলা বাজারে আসছে রেশনের সামগ্রী। তার খোঁজ নিতে গিয়ে যে তথ্য উঠে এলে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। নিয়মমাফিক রেশন ডিস্ট্রিবিউটারদের কাছে আসা চাল, গম কিংবা আটা রেশন ডিলারদের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু তার আগেই এইসব খাদ্যসামগ্রী চলে যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে। যাদের বলা হয় ‘চোর পার্টি’। সপ্তাহের যেদিন রেশন গাড়ি ঢোকে তার আগে থেকেই পজিশন নেয় ‘চোর পার্টিরা’। ডিস্ট্রিবিউটারদের থেকে মালপত্র নিজেদের গাড়িতে তুলেই তারা নিমেষে ধাঁ। আর তাদের হাত হয়েই খোলা বাজারে আসছে রেশনের চাল, গম, চিনি কিংবা আটা। অভিযোগ এভাবেই সরকারি ছাপ মারা আটা, চিনি, গম কিংবা চালের বস্তা সহজে ব্যবসায়ীদের গোডাউনে পৌঁছে যাচ্ছে। সোজা কথা ডিস্ট্রিবিউটরদের একাংশের মদতে রেশন ডিলারদের কাছে খাদ্যসামগ্রী যাওয়ার আগে ‘চোর পার্টি’ তা কার্যত খেয়ে নেয়।
[দেখতে ছানা টাটকা, দুধ কাটাতে ব্যবহার হচ্ছে ‘বিষ’]
এবার ডিলারদের বাঁ হাতের খেল
কয়েক দিন আগে কাঁথি-দিঘা বাইপাসে এক ডিস্ট্রিবিউটরের রেশনের চাল, গম, চিনি গাড়ি থেকে নামে। সেখানে আগেভাগে হাজির ছিল ‘চোর পার্টি’র লোকজন। তারা দ্রুত গাড়িতে তুলে হাওয়া হয়ে যায়। এইসব মালপত্র এরপর রিক্সায় করে কাঁথির সুপার মার্কেটে এক ব্যবসায়ীর গোডাউনে পৌঁছে দেওয়া হয়। ডিলারদের অভিযোগ সব জেনেও চুপ কাঁথি মহকুমা খাদ্য নিয়ামক দপ্তর। দুর্নীতির এখানেই শেষ নয়। রেশনের ভাল চালের বস্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহর থেকে দূরে সাতমাইলের কাছে থাকা গোডাউনে। আর খারাপ চাল গ্রাহকদের দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় রেশন ডিলারদের কাছে। চোরা পার্টির অপারেশনের পর এবার ডিলারদের শুরু হয় কারসাজি। রেশনের চাল, গম ইত্যাদি মাপ একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ রেশন ডিলাররা কাউন্টারগুলোকে এমনভাবে তৈরি করেন যেখানে গ্রাহকদের নজর সেভাবে পৌঁছয় না। কারণ মালপত্র মাপার থাকে গ্রাহকরা লাইন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এই সুযোগে ওজনে কারচুপি করেন রেশন ডিলারদের একাংশ।
২ টাকার চাল ২৫ টাকায় ‘ব্ল্যাক’
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ৭৯৯টি রেশন ডিলার এবং ১৬৫২টি কেরোসিন ডিলার রয়েছে। চাল, গম, চিনি ও আটার মতো কেরোসিন তেলের পরিমাপেও চলে কারচুপি। আর তাই খোলা বাজারে ৪৫ টাকা লিটারে বিক্রি হয় কেরোসিন তেল। বিপিএল কার্ড থেকে পাওয়া ২ টাকা কেজির চাল খোলা বাজারে ২৫-৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। আটার প্যাকেট বিক্রি হয় ১৮-২০ টাকায়। একইভাবে ৩ টাকার গম ১২-১৫ টাকায় খোলা বাজারে হাতবদল হয়। প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিনিয়ত ঠকছেন গ্রাহকরা। ভগবানপুর ও পটাশপুর এলাকায় রাস্তার পাশেই চলে রেশনের মালপত্র বিক্রি।
[ আলুতে দেদারে মিশছে বিষাক্ত রং, বুঝবেন কীভাবে? ]
কী ব্যবস্থা প্রশাসনের?
জেলা খাদ্য নিয়ামক দপ্তরের অবশ্য দাবি, গ্রাহকরা নিজেদের রেশনের মালপত্র বাজারে বিক্রি করায় সেগুলোই খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে রেশন সংক্রান্ত কোনওরকম অভিযোগ থাকলে সরাসরি ০৩২২৮-২৮৮৫৫৩ নম্বরে ফোন করে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রেশন ও কেরোসিন ডিলারদের দোকানে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে গত কয়েক মাসে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বেশ কয়েকজন ডিলারকে শো-কজ করেছে খাদ্য দফতর। এছাড়াও ২০১৫ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ভগবানপুর-২ ব্লকের এক রেশন ডিস্ট্রিবিউটরকে বরখাস্ত করে জেলা খাদ্য নিয়ামকের দপ্তর। অনিয়মের অভিযোগে কাঁথি শহরের রেশন ডিস্ট্রিবিউটরকে এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়।
[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]
জেলা খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, সরবরাহ করা চিনি, চাল, গম, কেরোসিন বণ্টনের জন্য জেলার প্রতিটি এলাকায় রেশন ডিলার ও কেরোসিন ডিলারদের দোকান রয়েছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্যে এইসব খাদ্যসামগ্রী ও কেরোসিন বন্টন নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ে খাদ্য দপ্তর-সহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে খাদ্য দপ্তর বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। আবার খাদ্য দপ্তরের কর্তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় রেশন দোকান ও কেরোসিন দোকানে আচমকা পরিদর্শনে যান। সে সময় অনিয়ম ধরা পড়লে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও চলে দুর্নীতি।
এভাবে আর কত দিন?
ইতিমধ্যে রেশন ব্যবস্থা বন্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি বন্ধ করার পর এবারে রেশনে চাল, চিনি, গম, কেরোসিন তেল আর হয়তো মিলবে না। তাই এবার গোটা দেশে রেশন ব্যবস্থা তুলে দিতে চায় সরকার। রেশনে বিক্রি হওয়া পণ্যে দুর্নীতি রুখতে এই পদক্ষেপ। এর বিকল্প হিসাবে সরাসরি গ্রাহকের ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে হরিয়ানায় গ্রাহকদের টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে। তার সাফল্যও মিলেছে বলে কেন্দ্রের দাবি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.