টিটুন মল্লিক,বাঁকুড়া: পরাধীন দেশে ব্রিটিশদের কাছে দু’শো বছর মাথা নত করে থাকার পর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে এদেশে। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সেই আন্দোলনের অন্যতম সাক্ষী বাঁকুড়ার কালীতলার কালীপুজো। এই পুজোতেই মিশে আছে অগ্নিযুগের বীরসন্তানদের যজ্ঞশক্তি।
শুধু বাঁকুড়া বললে ভুল বলা হবে, এই কালীপুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে যতীন দাস, বাঘা যতীন, ভগৎ সিং ও রাজগুরুর মতো দেশবরেণ্য বাংলার বীরসন্তানদের নাম। বাংলার এই বীরসন্তানরা তাঁদের জীবন দিয়ে দেশবাসীকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করেছেন। এই বড় কালীতলা মন্দিরের সামনেই রয়েছে প্রাচীন এক বৈপ্লবিক বাড়ি। তৎকালীন বাঁকুড়ার আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই বাঁকুড়া তথা বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের এক উজ্বল অধ্যায় ভেসে ওঠে চোখের সামনে। “অনুশীলন সমিতি”, “যুগান্তর দল”-এর এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ওই বৈপ্লবিক অধ্যায়ের যেন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঁকুড়া শহরের এই বড় কালী।
অগ্নিযুগের ইতিহাস অনুসারে, বিশ শতকের গোড়ার দিকে স্থানীয় বাসিন্দা রামদাস চক্রবর্তীর বাড়িতে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। সেখানে আনাগোনা ছিল বীরেন ঘোষ, প্রফুল্ল চাকিদের মতো বিপ্লবীদের। আগত বিপ্লবীরা শক্তির আরাধনা করতেন এই কালী মন্দিরে। শুধু পুজো উপলক্ষে নয়, প্রতিদিন সকাল-বিকেল এই মন্দির চত্বরে নিয়ম করে চলত বিপ্লবীদের শরীরচর্চা। কুস্তি, মুগুর ঘোরানোর মত তৎকালীন জনপ্রিয় ব্যয়াম এবং যোগাসন চলত। এবং এই কালীমন্দিরে এসবের আড়ালেই চলত বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ।
কথিত আছে, জনৈক রঘু ডাকাত তৎকালীন জঙ্গলঘেরা এই এলাকায় শাক্ত দেবীর উপাসনা শুরু করেছিলেন একসময়ে। তখন এই এলাকা ছিল প্রায় জনশূন্য। তারপর ওই এলাকায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বসতি। এই মন্দির লাগোয়া এলাকাতেই রামদাস চক্রবর্তী তৈরি করেন বাড়ি। তবে সেই স্বর্ণযুগের এই ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর নেই কারও। দিনের পর দিন এই ইতিহাস বিজড়িত বাড়ি চলে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। খসে পড়ছে সেই এই বাড়ির চুন,সুরকি।
তবে কালীপুজোর দিন ফের সেই অগ্নিযুগের স্মরণে মন্দির সংলগ্ন মাঠে ঝোলানো হয় শামিয়ানা। রাতভর ভক্তিভরে হয় কালীর আরাধনা। ইতিমধ্যেই শিল্পী তৈরি করছেন দেবী মূর্তি। প্রয়াত ইতিহাসবিদ রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী বেঁচে থাকাকালীন বারবার বলতেন, এই মা কালীর অঙ্গে বিপ্লবীদের গন্ধ মিশে আছে। পুরাতত্ত্ববিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তের কথায়, এই পুজোতেই মিশে আছে অগ্নিযুগের বীরসন্তানদের যজ্ঞশক্তি।
ছবি: সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.