Advertisement
Advertisement

Breaking News

গণিকালয়ে মাটি অমিল, দশকর্মার চলতি মাটিতেই চলছে প্রতিমা নির্মাণের কাজ!

প্রতিমার কাঠামো ও সপ্তমীর দিন ওই মাটিতে ফুল দিতে হয়৷ তা নিয়ে মিথ্যাচার চলছে৷ কোথায় পাচ্ছেন দশকর্মা ভাণ্ডারের মালিক ওই মাটি?

Tradition Has Gone, Durga Puja Is Celebrated Without Red Area's Soil
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:September 30, 2016 10:31 am
  • Updated:September 30, 2016 10:31 am

তরুণকান্তি দাস: মা আর মাটি। মাটির ‘মূল্য’ না জানলে দক্ষযজ্ঞ হয়ে যেতে পারে মাতৃ আবাহনের ভূমিক্ষেত্রে!
তখন মৃন্ময়ীর চিন্ময়ীতে রূপান্তরই সিদ্ধ হবে না৷ চারদিনের উৎসব তো দূর! সেই মাটি সভ্যসমাজের টেরা চোখে দেখা পতিতাপল্লির৷ সঠিক ব্যাখ্যা, কোঠাবাড়ির দোরগোড়ার৷ ধর্ম তাই বলে৷ কেন না হাজার শরীরের পাঁকে ডুবতে ডুবতে সমস্ত আবেগ হারিয়ে বসা নারীটির দেহ-নদে পৌরুষের নাও ভাসাতে গিয়ে সকলেই না কি চৌকাঠের সামনে ছেড়ে রেখে যায় তার সব কিছু৷ মনের যত সাদা৷ নারীও তার শরীরের বাণিজ্যিকীকরণে প্রবেশের আগে শেষ পদচিহ্ন ফেলে যায় এখানেই, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভূষণ লুণ্ঠিত হবে জেনেও৷ সেই মাটি তো মনের কষ্টিপাথরে যাচাই করা, সমস্ত পাপ-উত্তীর্ণ৷
এবং সেই পুণ্যমাটি তুলে এনে মাতৃশক্তির স্বরূপ গড়ে মনের যত কালো মুছে ফেলার হুলিয়া দিচ্ছে কিন্তু সেই চোখ ট্যারানো সমাজই৷ যদিও ট্র্যাজেডিটা অন্য জায়গায়, দেহপট নিয়ে বেসাতি করা গণিকাসমাজের বর্তমান বসত তো আর মাটির বাড়ি, নিকোনো উঠানে নয়৷ তা রীতিমতো সাজানো-গোছানো ইট-পাথরের৷ টাইলস বসানো মেঝে, জমকালো আলোর মধ্যে আদিম রিপুর উৎসব৷ কোটি-কোটি টাকার বিকিকিনির মেলায় মাটি তো বাড়ন্ত৷ তাই ‘নকল’ দিয়েই কম্ম সারা৷ যা বিকোচ্ছে আমার আপনার পাড়ার দশকর্মা ভাণ্ডারে৷ এক শিশি মাটি, খাঁটি নয়৷ তবুও নিয়মরক্ষার উপচার এবং অমূল্য৷
ধর্ম যে বিধান দেয় তার পিছনে কার্যকারণ থাকে৷ অনেকে সংস্কারে ডুবে থাকেন৷ কারও সন্ধানী মন উঁকি দেয় বিজ্ঞানের অন্দরে৷ ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, পুণ্যমাটি ছাড়া প্রতিমাকে ‘মা’ করে তোলা? ভাবাই যায় না৷ তা হলে কোথায় পাব তারে? চলো মন পতিতাপল্লি, কিন্তু শরীরকে পতিত করে নয়৷ বরং পুণ্যশরীরে, পবিত্র মনে৷ তবেই না মিলবে তার সন্ধান৷ নারীর কাছে পুরুষের পাণিপ্রার্থনা বা সম্ভোগসন্ধানে যাত্রা তো নতুন কিছু নয়৷ কিন্তু সেই কামনাকে শিকেয় তুলে স্রেফ মাটি! পুরুষের শরীর একতাল কাদা নয় কি?
আসলে এই মাটি নিয়ে একদা যে কাড়াকাড়ি, বাড়াবাড়ি ছিল এখন তা ধুয়ে সাফ৷ শুধুই নিয়মরক্ষার তাগিদ৷ তাই ঠাকুরের ফর্দমতো দশকর্মা ভাণ্ডারের এক-শিশি মাটি সই৷ শিবের মতোই তাঁর জায়াও বুঝি অল্পেতেই খুশি! সত্যি? তা ছাড়া আর একটি বিষয় নিয়েও সকলে সংকটে৷ কলকাতায় সোনাগাছি বা হাড়কাটা গলি না হয় হাতের কাছে৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনায় শাসন, ঘুঁটিয়ারি শরিফ, ডায়মন্ডহারবার, গড়িয়া, ক্যানিং, কাকদ্বীপেও তেনাদের চাষ-বাস৷ উত্তরের দেগঙ্গার মাটিয়া, বসিরহাট, হুগলির শেওড়াফুলি, আসানসোলের নিয়ামতপুর, খড়গপুর, কাঁথি বা শিলিগুড়ির খালপাড়ও তো একসূত্রে বাঁধা৷ কিন্তু যে তল্লাটে দেহপসারিণীদের কোনও আস্তানা নেই, স্রেফ ফ্লাইং, সেখানে? জটিল, বড় জটিল এই জট খোলা৷
এমনিতেই মহামায়ার আরাধনায় এত নিয়ম-নিষ্ঠা, যে তার সবটুকু পালন করা হয়তো সবসময় সম্ভব হয় না৷ এই প্রচার সর্বস্ব সময়ে তা অনেকক্ষেত্রে গুরুত্বও পায় না৷ সেখানে আচার-উপাচারের চেয়েও সাজ-সজ্জা ঠাট-বাট বড়৷ এই সময়ে পতিতাপল্লির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে সেখানকার মাটি আনা? বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও পুরানবিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতে, “এখন কোনও পতিতাপল্লিতে মাটি পাওয়া সম্ভব? দশকর্মা ভাণ্ডারে যদি তা বিক্রি হয়, তবে তার চেয়ে আর বড় মিথ্যাচার কিছু নেই৷” পুরাণগবেষক পূর্বা সেনগুপ্ত মানেন, সম্ভব নয়৷ জানেন, দোকানেই বিকোয় সেই মাটি৷ ব্যবসা৷ বলেন, “যাঁরা নিষ্ঠাভরে পুজো করেন, তাঁরা হয়তো নিয়ম মানতে চেষ্টা করেন৷ না হলে, দশকর্মা ভাণ্ডার মুশকিল আসান৷”
প্রতিমা তৈরির সময় যেমন গঙ্গাজল, গোময়, গোমূত্র, গঙ্গার মাটি লাগে তেমনই চাই গণিকালয়ের মৃত্তিকা৷ কেন? সমাজের সমস্ত শ্রেণির তিনি, সকলের সমান অধিকার অথবা উপেক্ষিতাদেরও তিনি মা, এই ধারণাকে মানবমনে গেঁথে দেওয়া৷ বিপন্ন ভুবনের পরিত্রাণ যাঁর হাতে, তাঁর মূর্তি নির্মাণেও থাকুক না সমাজের উপেক্ষিতাদের পরোক্ষ স্পর্শ৷ তাই সেখানকার মাটি৷ এবং তা চুরি করে নিয়ে আসা যাবে না৷ চাইতে হবে অন্তর দিয়ে৷ পুরোহিত নিয়ে গিয়ে প্রয়োজনে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে তুলে নেওয়া হবে সেই ধূলিকণা যা মহার্ঘ, বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠটির পূর্ণতা পেতে প্রয়োজনীয়৷ শেষ কবে এই প্রথার সাক্ষী হয়েছে আমবাঙালি, অথবা কোনও পুজো কমিটি? প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কেউ মাথা চুলকান, কেউ ভ্রু কুঁচকে বুঝিয়ে দেন, এই প্রশ্নটা কি না করলেই নয়? নৃসিংহপ্রসাদবাবু বলেন, “মায়ের কাছে কেউ অচ্ছুৎ নয়, এটাই এর অন্তর্নিহিত বার্তা৷ প্রতিমার কাঠামো ও সপ্তমীর দিন ওই মাটিতে ফুল দিতে হয়৷ ডোমেদের মাটিও তো লাগে৷ মা সর্বত্র বিরাজমান, কেউ ফ্যালনা নয়, তা বোঝাতেই এই আচার৷ তা নিয়ে মিথ্যাচার চলছে৷ কোথায় পাচ্ছেন দশকর্মা ভাণ্ডারের মালিক ওই মাটি?”
আগেকার দিনে কোনও বাচ্চা ছেলেকে পাঠিয়ে কম্ম সারা হত৷ কখনও লুকিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা হত ‘পবিত্র’ মাটি৷ অর্থাৎ, কখনও আদিম রিপু-তাড়িতের বেশে ঢুকে পড়া সেই ললনাদের দোর টপকে এবং বেরিয়ে আসা মাতৃ-পুজোর জন্য মহৎ কর্মটি সেরে৷ যিনি তা করতেন, তাঁকে নিয়ে পাড়া জুড়ে হই-হই, রই-রই৷ নায়কের মর্যাদা মিলত তার৷ আড়ালে আবডালে চলত তার চরিত্র নিয়ে চর্চাও৷ পুজোর আনন্দযজ্ঞে এও এক পাঁচফোড়নের কাজ করত বটে৷ তবে সেই সময়, সেই আবেগ এখন যেন ঝুলপড়া চিলেকোঠা৷ কে খোঁজ রাখে? তাই গণিকালয়ে যেমন মাটি নিখোঁজ, তেমনই আবেগের জলাঞ্জলি দিয়ে বাঙালি কিনছে মাটি৷ একশিশি৷ দাম কোথাও একশো, কোথাও হাজার ছুঁই ছুঁই৷ টাকা দিয়েই না হয় টিকিয়ে রাখা হল আচার-ধর্ম৷ আপনি আচরি ধর্ম অন্যকে শেখানো তো ভুলেই গিয়েছে এই জাতি৷ মা-ই বা বাদ পড়েন কেন? নিষিদ্ধপল্লির মাটি ছাড়াই তাই সিদ্ধিলাভের উৎসবে বাঙালি৷ মায়ের আবাহনেও জয়ী পুরুষতন্ত্র!

Advertisement

Advertisement

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ