সুমিত বিশ্বাস ,পুরুলিয়া: রাজ্যে পালাবদলের পর কাজের অভাব ছিল না। জঙ্গল ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে এসে রাস্তা, পুকুর কাটা, হাপা খনন। মজুরিও মিলছিল ঠিকঠাক। সঙ্গে হস্তশিল্পের কাজ তো রয়েইছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে মজুরি বন্ধ করে দিল কেন্দ্র। ব্যস, তারপর থেকে কাজ করেও দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মজুরি বকেয়া। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে অর্থাভাব আরও চরমে উঠল। তাই পেটের টানে অন্ধ্রে যাচ্ছিলেন প্রান্তিক শবর জনজাতির পরিযায়ী শ্রমিক দুই ভাই। করমণ্ডলের দুর্ঘটনা কেড়ে নিল দুই ভাইকেই। কেড়ে নিল পরিবারের দুই রোজগেরে সদস্যকেও।
জ্যোতিলাল শবর (৩০) ও মতিলাল শবর( ৪৩)। দুই ভাইয়ের মৃতদেহে এখন যথাক্রমে ১৬৫ ও ১৬৩ নম্বরের ট্যাগ। তাঁদের বাড়ি পুরুলিয়ার একদা মাও উপদ্রুত বান্দোয়ানের ঘাঘরা গ্রামে। বাবা-মাকে নিয়ে দুই ভাই একসঙ্গেই থাকতেন। দিনমজুরি করেই সংসার চলত তাদের। বৃদ্ধ বাবা শম্ভু শবর একসময় কেন্দ্রের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের শ্রমিক থাকলেও পরবর্তীকালে আর খাটতে পারতেন না। তাই ওই কাজে সংসার সামলাতেন এই দুই ভাই-ই। ওড়িশায় আকস্মিক ট্রেন দুর্ঘটনা ওই দুই ভাইকে কেড়ে নেওয়ায় ওই জনজাতির পরিবার যেন থমকে গেল।
[আরও পড়ুন: রেকর্ড গড়ে পরপর ৫ বার দেশের সেরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তালিকায় কলকাতার ২ কলেজ]
শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনার পরই বড় ভাই মতিলালের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা একমাত্র মেয়ে রেখা শবর আত্মীয়দের সঙ্গে ওড়িশার
বালেশ্বরে গিয়েছিলেন। ওই এলাকার একের পর এক হাসপাতাল ঘুরেও বাবা ও কাকুকে পাননি তিনি। তাই হতাশ হয়ে রবিবার সকালের দিকে বাড়ি ফেরেন। এরপর দুপুরের দিকে খবর পান বাবা হয়তো আর নেই। তারপর থেকে অনেক জায়গায় ফোন করেছেন। কিন্তু তার নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন এই অষ্টাদশী। কিন্তু বাবার মৃত্যুর খবর বাড়িতে জানাতে পারেননি পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে। সোমবার দুপুরে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের দল তার বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার সময় খারাপ খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার। আত্মীয়-স্বজন, পরিজন এমনকী পড়শিরাও এই দুঃসংবাদে আর নিজেদের সামলাতে পারেননি। শোক গ্রাস করেছে ঘাঘরা গ্রামকেই।
[আরও পড়ুন: চলন্ত বাসে হস্তমৈথুন: জেলমুক্তির পর অভিযুক্তকে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা মেনস অ্যাসোসিয়েশনের!]
এদিকে দুই ছেলের অকাল মৃত্যু শুনে থরথর কাঁপছেন ষাটোর্ধ বাবা শম্ভু শবর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি তিনি। খাটে শুয়ে পড়েন। বলেন, “১০০দিনের কাজের মজুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল দুই ছেলে। শুনেছি সেই কারণেই ওরা আমাকে সেভাবে কোনও কিছু না জানিয়ে ঘর ছেড়ে অন্ধপ্রদেশে যাচ্ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। কী করে এত বড় সংসারটা চলবে কে জানে।” শোকের মধ্যেই যেন প্রতিবাদী ছোট ভাই মতিলাল শবরের স্ত্রী হিমানী। “মাসের পর মাস আমরা দু’জন একশ দিনের কাজ করেছি। কিন্তু মজুরি পাইনি। কতবার পঞ্চায়েতে, ব্লকে গিয়েছি। বলেছে কেন্দ্র নাকি টাকা পাঠাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে দুই ভাই বাইরে কাজে যান। “
মতিলালের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছোট ভাই জ্যোতিলালের এক ছেলে। এবার এত বড় সংসার কীভাবে চলবে সেটাই বুঝতে পারছেন না মা গুরুবারি শবর। তাঁর কথায়, “১০০ দিনের মজুরি বকেয়া। লক্ষ্মীর ভান্ডারও আমাদের হয়নি।” এই জনজাতির পরিবারের যে জাতিগত শংসাপত্রই নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। সন্ধ্যা শেষে রাতের আঁধার নামছে রাইকাসিনি পাহাড় জঙ্গল বেয়ে ঘাঘরা গ্রামে। দুই ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে শবর সংসারেও যেন সেই আঁধার-ই নেমে এলো।