কখনও বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা আবার কখনও বাবুল সুপ্রিয় কাণ্ডের ঝড়। অনেক বিতর্কের পালা পেরিয়ে বছর শেষ করল তিলোত্তমা। ২০১৯-এ কী কী ঘটনা বা স্মৃতির সাক্ষী থাকল এই শহর? কলকাতার অলি-গলি ঘুরে সেই স্মৃতিই টেনে আনল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
যত কাণ্ড NRS-এ
বছরের শুরুতেই নৃশংস কাণ্ডের সাক্ষী ছিল তিলোত্তমা। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ১৬টি কুকুরছানাকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় শোরগোল পড়ে শহরে। নাগরিক সমাজ থেকে বিদ্বজ্জন, প্রত্যেকেই তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল এই নৃশংস কাণ্ডের। সারমেয় খুনের ঘটনায় সোমা বর্মন এবং মৌটুসি মণ্ডল নামে দুই নার্সিং স্টাফের নামে চার্জশিট জমা দেয় কলকাতা পুলিশ।
রোগীর পরিবারের হাতে বারবার আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসকরা। ঈশ্বরের সমতূল্য সেই চিকিৎসকদের উপর এই হামলায় সহ্যশক্তির বাঁধ ভাঙে জুনিয়র ডাক্তারদের। পরিবহ মুখোপাধ্যায় নামে ডাক্তারি পড়ুয়ার উপর ‘পেশেন্ট পার্টি’র হামলায় গর্জে ওঠে চিকিৎসা মহল। যার জেরে নড়ে উঠেছিল গোটা রাজ্য তথা দেশ। রোগীমৃত্যু এবং চিকিৎসক নিগ্রহের জেরে চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থায়। প্রতীকী হিসেবে কালো ব্যাচ লাগিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন গোটা দেশের চিকিৎসকরা। দেশজুড়ে চিকিৎসকদের ধর্মঘট, কর্মবিরতিতে ব্যাহত হয়েছিল চিকিৎসা পরিষেবা। শেষে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কর্মবিরতি তুলে নেন ডাক্তাররা। এনআরএসের সেই ধুন্ধুমার কাণ্ডই উঠে আসছে বড়পর্দাতেও।
বিদ্যাসাগরের মূর্তি হল খানখান
সাত দফা লোকসভা ভোটের মাঝেই একটি ঘটনা আচমকাই হয়ে উঠল ভোটের ইস্যু৷ সপ্তম তথা শেষ দফার ঠিক আগে৷ ১৪ মে, সন্ধে৷ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ শহরে এসেছিলেন ভোটের প্রচারে৷ তাঁর অন্যতম কর্মসূচি ছিল রোড শো৷ সেখানেই ঘটে গিয়েছিল অপ্রীতিকর ঘটনা৷ যা পরবর্তী সময়ে ভোটের ইস্যু হয়ে দাঁড়াল৷ বিজেপির রোড শো থেকে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষ এবং বিদ্যাসাগর কলেজে মনীষীর ঐতিহ্যবাহী মূর্তি ভাঙচুর। মূর্তি ভাঙা নিয়ে দু’পক্ষের দোষারোপ পালটা দোষারোপের পালা চলে বহুদিন। পরে আরও বড় মূর্তি গড়ে দেয় রাজ্য সরকার।
দিদিকে বলো
লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ভরাডুবির পর ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরের শরণাপন্ন হয় তৃণমূল। কাজে নেমেই পিকের মাস্টারস্ট্রোক ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। রাজ্যের মানুষের অভাব-অভিযোগ শোনার প্ল্যাটফর্ম। কলকাতা থেকে সেই কর্মসূচির সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কর্মসূচিই লোকসভায় বিপর্যয় থেকে অনেকটা টেনে তোলে তৃণমূলকে। রাজ্যের বহু মানুষই এই কর্মসূচির মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। আবার উলটোটাও আছে। দিদিকে জানিয়ে অনেক সময় সাহায্য মেলেনি। ভাল-মন্দ মিশিয়ে মোটামুটি হিট দিদিকে বলো।
অশ্রু’সজল’ মেট্রো
মহানগরীর পাতালপথে ভয়ংকর দুর্ঘটনার শিকার হলেন শিল্পী সজল কাঞ্জিলাল। পার্ক স্ট্রিট থেকে ভিড় মেট্রোয় উঠতে গিয়ে গেটে হাতের কবজি আটকে যায় ষাটোর্ধ্ব শিল্পীর। সেই অবস্থাতেই ছুটতে থাকে রেক। কিছুদূর যাওয়ার পর ঝাঁকুনি দিয়ে মেট্রো থেমে যায়৷ পড়ে যান সজলবাবু৷ সরু পাতালপথে তাঁকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে করতেই প্রাণবায়ু নিভে যায়৷ শিল্পীর মৃত্যুর পরও মেট্রো কর্তৃপক্ষের গাফিলতি নিয়ে তরজা চলছিল। তদন্ত রিপোর্টে সজলবাবুর অসতর্কতা ও তাড়াহুড়োকেই দায়ী করা হয়। ক্ষতিপূরণও দিতে অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ।
বউবাজারে বিপর্যয়
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর জন্য টানেল খোঁড়ার ফলে বিপত্তি। তাসের ঘরে পরিণত হয় বউবাজার এলাকা। বহু বাড়ি ভেঙে পড়ে, কোনওটায় আবার ফাটল দেখা দেয়। চোখের সামনে ধুলোয় ভিটেমাটি ধুলোয় পরিণত হতে দেখে আতঙ্কে মারাও যান অনেকে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বউবাজার কাণ্ড নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরও শুরু হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। শেষে KMRCL ও রাজ্য সরকারের তরফে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় আর্থিক সাহায্য।
বাবুল কাণ্ড
বিতর্কের শিরোনামে থাকা প্রায় অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। এবছর এবিভিপির নবীনবরণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই আমন্ত্রিত ছিলেন বাবুল। কিন্তু ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা পান তিনি। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের পড়ুয়াদের হাতে রীতিমতো নিগৃহীত হন আসানসোলের সাংসদ। বিতর্কের রেশ শহর ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে ছড়ায়। তাঁকে উদ্ধারে আসেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। প্রায় ছ’ঘণ্টা পর ঘেরাও থাকা বাবুলকে বের করে নিয়ে আসেন তিনি। হেনস্তার অভিযোগে সরব হন বঙ্গ বিজেপি-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা।
মমতা বনাম ধনকড়
সূত্রপাত দুর্গাপুজো কার্নিভ্যালের মঞ্চ থেকে। তারপর থেকে বিভিন্ন কারণে রাজ্য ও রাজ্যপাল সংঘাত জারি থেকেছে। বছরের শেষপর্যন্ত যার রেশ বর্তমান। জগদীপ ধনকড় জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকের উদ্যোগ নেন। যে কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর অভিযোগে সরব হন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী-আমলারা। বছরভর মমতা বনাম ধনকড় সংঘাত বিরাজমান ছিল। দুই প্রশাসনিক প্রধানের স্নায়ুর লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছেন শহরবাসী। কখনও অপমানিত হয়েছেন বলে সরব রাজ্যপাল, তো কখনও ধনকড়ের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সবমিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপালের ঠান্ডা লড়াই বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে এবছর।
টার্গেট সিনিয়র সিটিজেন
যোধপুর পার্ক থেকে নেতাজিনগর, তারপর গড়িয়াহাট। বছরভর শহরের একাধিক জায়গায় আততায়ীদের টার্গেট হয়েছেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কোথাও সম্পত্তির লোভে তো কোথাও আবার বউমার অসমবয়সী প্রেম জেনে ফেলায় খুন হতে হয়েছে বৃদ্ধাকে। কলকাতা পুলিশের তরফে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বছরভর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে কলকাতায় বসবাসকারী নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। কিন্তু আক্রমণ থামেনি। এটাই যেন এখন একটা ট্রেন্ড। হয়তো আগামী বছর পুলিশ আরও কড়া হাতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা রুখতে পারবে, এমনটাই আশা শহরবাসীর।
ত্রাস এটিএম
গোটা বছর বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের কাছে ত্রাসে পরিণত হয়েছে ব্যাংকগুলির এটিএম। কেন? কারণ এটিএমে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করে লেনদেন করতে গিয়েই বিপদে পড়েছে। অ্যাকাউন্ট থেকে বহু গ্রাহকের উধাও হয়েছে টাকা। নেপথ্যে স্কিমার গ্যাং। সিলভিউ ফ্লোরিন স্পিরিদন, বয়স ২৮ বছর। আদতে রোমানিয়ার নাগরিক। এদেশে এসে জাঁকিয়ে বসে এটিএম জালিয়াতির কারবার শুরু করেছিল। স্কিমার-সহ একাধিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এটিএম থেকে টাকা সাফ করার পর সে কলকাতাতেও ঘাঁটি গাড়ে। সম্প্রতি যাদবপুর-সহ একাধিক এলাকায় এটিএম থেকে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত। তার ভিত্তিতেই কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্তে নামে। তারপর দিল্লি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবুও আতঙ্ক যায়নি গ্রাহকদের। ব্যাংক এবং পুলিশের পরামর্শ, কার্ডের পিন নম্বর বদলানোর। পরের বছরও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না তার গ্যারান্টি কী?
গোলাপি টেস্ট
বিসিসিআইয়ের মসনদে বসেই মাস্টারস্ট্রোক মহারাজের। নভেম্বরে বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ভারতের মাটিতে প্রথম দিনরাতের টেস্ট আয়োজিত হয় ইডেনে। ঐতিহাসিক সেই টেস্টের জন্য গোটা শহর সাজে গোলাপি আভায়। হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে শহরের উচ্চতম বিল্ডিং The 42, সবেতেই গোলাপি রঙের বিচ্ছুরণ। সেই টেস্টে বাংলাদেশকে আড়াই দিনেই উড়িয়ে দেয় ভারত। এক ইনিংস ও ৪৬ রানে দিনরাতের টেস্ট ও ২-০ সিরিজ জিতে বিরাট কোহালিরা স্মরণীয় করে রাখেন এই বিশেষ মুহূর্ত।
টাকার বৃষ্টি
কলকাতার আকাশে টাকার বৃষ্টি! পাঁচ-দশ টাকা নয়, একেবারে ৫০০, ২০০০ টাকার কড়কড়ে নোটের বৃষ্টি। না, সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির দৃশ্য নয়। দিনদুপুরে খাস কলকাতায় এই ঘটনায় ব্যাপক শোরগোল। বুধবার দুপুরে মধ্য কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটি বহুতল থেকে এমনই টাকার বৃষ্টি। দেখে থমকে গেলেন পথচারীরা। তারপর টাকা কুড়োতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সাধারণের মধ্যে। প্রথমে ৫০০-২০০০ টাকার নোট, তারপর একের পর এক টাকার বান্ডিল বহুতলের জানলা থেকে নিচে পড়তে শুরু করে। পরে জানা যায়, ছতলার ওই অফিসে রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিকরা হানা দেন। অনুমান, তারপরই জানলা দিয়ে টাকার বান্ডিল ফেলা হয় নিচে। বেআইনি লেনদেন হত ওই সংস্থায়, তাই ধরা পড়া রুখতে এই পন্থা। এই ঘটনা শহরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.