Advertisement
Advertisement

Breaking News

Abhijit Gangopadhyay

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়: রাজনীতিতে ল্যাটারাল এন্ট্রি!

৫ মার্চ বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে পরদিনই বিজেপি শিবিরে যোগ দিয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

Abhijit Gangopadhyay: a brief analysis after he enters into politics after resignation from the post justice
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:March 9, 2024 2:54 pm
  • Updated:March 9, 2024 9:36 pm

জয়ন্ত ঘোষাল: প্রাচীনকালে ‘জননেতা’ বলতে বুঝতাম বুদ্ধ-শঙ্করাচার্য, রামানুজ-চৈতন‌্য। ‘রাষ্ট্রনেতা’ বলতে রাজনৈতিক নেতাদের গণ‌্য করার রেওয়াজ তো অনেক পরের চল। ক্রমে ক্রমে রাজনীতি এমনই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে সিভিল সোসাইটি, পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল, অর্থাৎ বিদ্বজ্জন সমাজের নিজস্ব পরিসর অ‌্যাপেনডিক্সের মতো নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে।

দলীয় রাজনীতিতে মধ‌্যবিত্ত ও বিদ্বজ্জন সমাজের প্রতিনিধিরা এখন হঠাৎ করে যোগ দিচ্ছেন এমন নয়। চলচ্চিত্রকার, তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়-সাংবাদিক-আমলা বহু দিন ধরেই নির্বাচনী রাজনীতিতে আসছেন। কাজেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ‌্যায় (Abhijit Gangopadhyay) যদি ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন, তমলুকের মতো আসনে প্রার্থী হন, অস্বাভাবিকতা নেই। প্রয়াত নীতীশ সেনগুপ্ত থেকে জহর সরকার; কুণাল ঘোষ থেকে সাগরিকা ঘোষ যদি জনতার কাছে গ্রহণযোগ‌্য হন – তবে জাস্টিস গঙ্গোপাধ‌্যায়ের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ‌্যতা (Acceptance) থাকবে না কেন?তবে মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ, বা মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ‌্যায় যদি রাজনীতির স্বাভাবিক মূলস্রোত হন, তবে এহেন চরিত্রর আগমনকে আমরা বলতে পারি ‘ল‌্যাটারাল এন্ট্রি’। অতীত থেকে বর্তমান অবধি ভোটের আগে বিশেষ এরকম দলীয় আগমন-অনুপ্রবেশ-অভিষেক কম তো দেখলাম না!

Advertisement

Lok Sabha Elections 2024: BJP Worker Writes Abhijit Gangopadhyay name As BJP Candidate of Tamluk

Advertisement

যশবন্ত সিন্‌হা আইএএস অফিসার ছিলেন। বিহার ক্যাডার। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী হন। আমরা তো অনেকে ভুলেই গেলাম যে তিনিও ছিলেন আমলা! বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রূপান্তর সফল হয়, অনেক সময় হয় না। কূটনীতিক জয়শংকর বর্তমানে বিদেশমন্ত্রী, আমলা অশ্বিণী বৈষ্ণব রেলমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী নাকি এ ধরনের বিদ্বৎসমাজকে নিয়ে আসতে বেশি আগ্রহী। তাতে পুরনো চাল আর নতুন চাল মিলেমিশে যাবে। তিনি এও মনে করেন, এতে দলের বেনোজল বেরবে, আখেরে লাভ হবে দলের।

[আরও পড়ুন: চিনের চিন্তা বাড়িয়ে সেলা টানেল উদ্বোধন মোদির, অরুণাচলে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ ভারতের]

এর পরও বলব, অভিজিৎবাবুর ইস্তফা এবং বিজেপিতে যোগদান নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে। কেন ওঁকে এত বিতর্কের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? মিশেল ফুকো, উত্তর-আধুনিকতাবাদী ফরাসি দার্শনিক বলেছিলেন – আসল ‘কাম’ হল ক্ষমতা। সেটাই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গে কোনও ‘সিটিং জাজ’ এভাবে ইস্তফা দিয়েই দু’দিনের মধ্যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এমন নমুনা সম্ভবত নেই। আইনজীবী রাজনেতা হয়েছেন – বাংলা থেকে সে তালিকা তৈরি করতে গেলে তো ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাস থেকে সিদ্ধার্থ রায়, অশোক সেন ও ভোলা সেন হয়ে এখনকার দিনে পৌঁছতে হয়। কিন্তু অভিজিৎবাবু বিচারপতি থাকার সময়ও টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে রাজনীতি-সহ বিবিধ বিষয়ে মন্তব‌্য করেছেন। তিনি যে শুধু শাসকদলের বিরুদ্ধে রায় দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন এমন নয়, নিয়মিত রাজনেতার মতোই তখনও ‘বাইট’ দিতেন সরকারের বিরুদ্ধে। এখন অবশ‌্য রাজ‌্যপালেরাও নিয়মিত টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন। বাংলার প্রাক্তন রাজ‌্যপাল জগদীপ ধনকড় তো এ ব‌্যাপারে এক চূড়ান্ত উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

Jagdeep Dhankhar said he doesn't care if he is insulted as an individual
রাজ্যসভায় জগদীপ ধনকড়। ছবি: টুইটার

প্রশ্ন হল সাংবিধানিক প্রোটোকলের। আমরা এই প্রোটোকল কি ভাঙতে চাই? আধুনিক মিডিয়ার যুগে এটাকেই কি দস্তুর বলে ঘোষণা করব? তবে কিন্তু আগামী দিনে আমরা নৈরাজ‌্যও ডেকে আনার রাস্তা প্রশস্ত করছি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিও যদি কেন্দ্রীয় সরকার সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিরুদ্ধ মতামত জানাতে থাকেন, তাহলে সেই সূত্র ধরে দেশের আইন, শাসনব্যবস্থা ও বিচারবিভাগের ভারসাম্যের কী পরিণতি হবে ভেবেছেন কি?

রামমন্দির (Ram Mandir) নির্মাণের রায় কেন্দ্রের পক্ষে গিয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ব ও বালক রামচন্দ্রর প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি কি কোনও মন্তব‌্য করেছেন? মনে পড়ছে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কোকা সুব্বা রাও অবসর গ্রহণের তিন মাস আগে ইস্তফা দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন। জাস্টিস বাহারুল ইসলাম বিচারব‌্যবস্থায় যোগ দেওয়ার আগে কংগ্রেস সাংসদ ছিলেন। তারপর ১৯৮৩ সালে ইস্তফা দিয়ে আবার সংসদে আসেন। প্রয়াত বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি একদা বলেছিলেন, বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর একটা ‘কুলিং পিরিয়ড’ থাকা উচিত, যেখানে অন‌্য কোনও রাজনৈতিক বা সরকারি পদে তিনি যাবেন না। ‘প্রি-রিটায়ারমেন্ট জাজমেন্ট’ অনেক সময় ‘পোস্ট রিটায়ারমেন্ট জব’ পাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে ওঠে। সেটা বন্ধ করার জন‌্যই এই আইন হওয়া উচিত। এটা কি এখনকার দিনেও খুব জরুরি নয়? অথচ আইনগতভাবে কোনও ‘কুলিং পিরিয়ড’-ই নেই বিচারব‌্যবস্থায়। ক্রীড়াজগতে বিসিসিআইতে কিন্তু আছে। যে কারণে সৌরভ গঙ্গোপাধ‌্যায়কেও (Sourav Ganguly) সরতে হয়েছিল ক্রিকেটীয় ক্রীড়া প্রশাসকের সর্বোচ্চ পদ থেকে। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ‌্যায়ের ক্ষেত্রে অবশ্য ন্যূনতম নান্দনিক সময়ের দূরত্বও দেখা গেল না। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, এরকম আইন তো এদেশে নেই। সত্য। তবে নীতিগতভাবে কার্যকারণ সম্পর্কে ফুকোর কায়েমি স্বার্থের প্রশ্ন উঠবেই।

তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ‌্যায় এক বাক্যের প্রতিক্রিয়া ব‌্যক্ত করে প্রশ্নটি জনতার আদালতে পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উনি স্পষ্ট করে একটা সত্যি কথা বলে দিয়েছেন। হয়তো মুখ ফসকেই বলেছেন। কিন্তু সত্যিটা বলেছেন বলে আমি তাঁকে ধন‌্যবাদ জানাচ্ছি। উনি বলেছেন যে, আই অ‌্যাপ্রোচড বিজেপি অ‌্যান্ড বিজেপি অ‌্যাপ্রোচড টু মি। এটা খুব ইন্টারেস্টিং। ইউ হ‌্যাভ টু রিড বিটুইন দ‌্য লাইন্‌স। উনি তার মানে স্পষ্ট করে বলছেন যে, আমি যখন বিচারব‌্যবস্থায় বিচারকের চেয়ারে বসে বিভিন্ন শুনানিতে আমার রায় দিয়েছি, বা আমার এজলাসে যে-সমস্ত ঘটনার শুনানি হয়েছে, সে-সময় বিজেপি আমার সঙ্গে যোগাযোগে ছিল, এবং আমি বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগে ছিলাম।’ বাকিটা অভিষেক সাধারণ মানুষের উপর ছেড়ে দিয়েছেন বোঝার জন‌্য। মনে পড়ছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন রুমা পাল। দিল্লিতে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন ‘‘আমি বিচারপতি হিসাবে অবসর গ্রহণের পরেও কখনও কোনও সাক্ষাৎকার দিতে চাই না। এটা নীতির প্রশ্ন।’’

2024 Lok Sabha Election: Abhishek Banerjee to held mega public meeting and rally in 5 Lok Sabha constituencies starting from Nandigram Diwas

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ‌্যায় জনপ্রিয় চরিত্র। শহুরে বাঙালি মধ‌্যবিত্ত নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ যারা শাসক দলের বিরুদ্ধে – সেই জনসমাজ তাঁকে পছন্দ করেছে। প্রচারমাধ‌্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই ভাবমূর্তি-নির্মাণে। তাঁর নিজেরও সচেতন প্রয়াস ছিল। দেশে যখন ‘সৎ’ নায়কের ঘাটতি হয়, খলনায়কে যখন দেশ ভরে যায়, তখন ‘যদা যদাহি’ বলে এই সমাজে কখনও টি. এন. সেশন তো কখনও বিহারের প্রাক্তন আমলা কে. কে. পাঠকের মতো চরিত্র মানুষের ‘নায়ক’ হয়ে ওঠেন। যেমন কিনা সিনেমায় হয়। তবে আমরা সবাই জানি, এই ‘কাল্ট নির্মাণ’ সাময়িক। এখনও পর্যন্ত এ দেশে কোনও সমস‌্যার স্থায়ী সমাধান এই ব‌্যক্তি-আরাধনায় হয়নি। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ‌্যায়কে দলে পাওয়া বিজেপির জন‌্য লাভজনক। কেননা, বিজেপিতে বিশিষ্ট বাঙালি নাগরিক বিদ্বজ্জনের অভাব আছে। তাই তো বিজেপি কখনও মিঠুন, কখনও সৌরভকে পেতে সচেষ্ট হয়েছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত গত কয়েক বছর ধরে কখনও ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য তো কখনও অজয় চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে জনসম্পর্ক অভিযান চালিয়েছেন। বাঙালির বিদ্বৎসমাজ উত্তরপ্রদেশের সমতুল‌্য নয়, এই বিদ্বৎসমাজে অমর্ত‌্য সেনের প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর মোকাবিলায় বিজেপির প্রয়োজন ‘ল‌্যাটারাল এন্ট্রি’।

[আরও পড়ুন: এক বালতি জলের দাম ২০০০! জলসংকট মোকাবিলায় একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা বেঙ্গালুরুতে

একদা বিপ্লব দাশগুপ্ত, অসীম দাশগুপ্তরা এসেছিলেন দলে এভাবে, কিন্তু এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও প্রশিক্ষণের মধ‌্য দিয়ে।তবে, বিজেপির লাভ হলেও অভিজিৎবাবুর এতে কতটা লাভ হবে – সে প্রশ্ন থেকে গেল। রাজনীতিতে কল‌্যাণ বন্দ্যোপাধ‌্যায়দের ভাষায় কথা বলতে না পারলে, বা ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি হয়েই থাকলে কি তাঁর রাজনীতিক সিদ্ধি লাভ হবে? না কি ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ বলে তিনিও অ‌্যান্টিজেন-অ‌্যান্টিবডির বিবাদভঞ্জন করে বাংলার এক চতুর রাজনেতা হয়ে উঠতে পারবেন? জবাব আপাতত ভবিষ‌্যতের গর্ভে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ