Advertisement
Advertisement

Breaking News

Clothing Controversy

অশ্লীলতা ও ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’: দিল্লির বাসে বিকিনি পরিহিত মহিলা যাত্রী যে প্রশ্নগুলো তুলে দিলেন

এদেশে কি সত্যিই এ-ধরনের আচরণ আইনত অপরাধ?

Bikini-clad woman on Delhi bus created clothing controversy

ছবি: প্রতীকী।

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:April 23, 2024 1:35 pm
  • Updated:April 23, 2024 1:35 pm

গণ পরিবহণে একজন নারী অন্তর্বাস পরে উঠলে, সেটা আইনত অপরাধ নয়, যদি না তিনি যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত করে রাখেন। তবে সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে, যে-পোশাক পরে সমুদ্রসৈকতে বসা যায়, সেই পোশাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করা যায় না। লিখেছেন অবন্তিকা পাল

সম্প্রতি, দিল্লি (Delhi) ট্রান্সপোর্টের একটি বাসে একজন মহিলার অন্তর্বাস পরে দঁাড়িয়ে থাকার দৃশ্য ‘ভাইরাল’ হয়। স্বভাবতই, ভিডিওটির নিচে ‘নেটিজেন’-রা তঁাদের মতামত ব্যক্ত করতে শুরু করেন। অধিকাংশই বিষয়টির তীব্র নিন্দায় সরব। এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একদল আবার মেয়েটির এহেন আচরণকে ‘মাই বডি মাই চয়েজ’ হিসাবে ব্যাখ্যা করছেন।

Advertisement

এ-দেশে কি সত্যিই এ-ধরনের আচরণ আইনত অপরাধ? সহজ উত্তর হল: না, শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে রাস্তায় ঘুরলে পুলিশ কাউকে লক আপে পাঠাতে পারে না, যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি সরাসরিভাবে কোনও যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত রেখেছেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনই এসেছে ব্রিটিশ আইন থেকে। অশ্লীলতার আইনও ব্যতিক্রম নয়। ১৭১৭ সালের আগে ইংল্যান্ডে অশ্লীলতার বিচার হত ধর্মীয় আদালতে। কোন বই ‘অশ্লীল’– সেটা ঠিক করতেন পোপ এবং চার্চ। ১৭১৭ সাল থেকে স্থির হয় যে, অশ্লীলতার বিচার হবে সাধারণ আদালতে। ১৮৬৮ সালে ‘হিক্‌লিন্‌স মামলা’-য় অশ্লীলতার যে-ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, মোটামুটিভাবে তার উপর ভিত্তি করে ভারতের অশ্লীলতা আইনগুলি (অবসিনিটি ল) রচিত।

Advertisement

[আরও পড়ুন: চরম গরমে প্রিয় পোষ্যকে সুস্থ রাখবেন কীভাবে? রইল সহজ কিছু টিপস]

অশ্লীলতা নিরোধের জন্য বহু আইন ভারতে রয়েছে। যেমন: ভারতীয় দণ্ডবিধি ২৯২ ও ২৯৩ ধারা। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৮৭ সালে পাস করা হয় নারীর অশোভন উপস্থাপন নিরোধ আইন (Indecent Representation of Women Prohibition Act)। এছাড়া, ‘সিনেমাটোগ্রাফি আইন ১৯৫২’, ‘ইনফরমেশন টেকনোলোজি আইন ২০০০’, ও অন্যান্য মিডিয়া বিষয়ক আইনেও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সংস্থান আছে। প্রথম বিশ্বের অনুকরণে অশ্লীলতাকে ভারতের বিচারব্যবস্থা নির্ধারণ করত ‘হিক্‌লিন্‌স টেস্ট’-এর মাধ্যমে। ক্রমশ সমাজমাধ্যম প্রভাব বিস্তার করার পরে বিভিন্ন উন্নত দেশে অশ্লীলতা বিচারের ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয় ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট’-এর উপর। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গেও ২০১৪ সালে অভীক সরকার বনাম রাষ্ট্রের মামলায়, অভীক সরকার সম্পাদিত একটি বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রকাশিত, বরিস বেকার ও তঁার সঙ্গিনী বারবারা ফেলটাসের অর্ধ-উন্মুক্ত ছবিকে ‘অশ্লীল নয়’ রায় দেওয়া হয় ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট’-এর ভিত্তিতে।

কী এই ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট’? এর অর্থ: কোনও শিল্পকর্ম/ কোনওরকম অঙ্গভঙ্গি/ কোনও বিষয়বস্তুকে শুধুমাত্র তখনই ‘অশ্লীল’ বলে ধরা হয়, যখন সামগ্রিকভাবে মূল উপজীব্য বিষয়টি সমসাময়িক সম্প্রদায়ের মানদণ্ডের বিরোধী। এখন সমসময়ের সামাজিকতার মানদণ্ড নিয়েই যত বিতর্ক। একদা প্রথম বিশ্বে অশ্লীলতার দায়ে নির্বিচারে বইপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হত। মহিলার উরু প্রদর্শনকে মনে করা হত অশ্লীলতা।

[আরও পড়ুন: যশস্বীর শতরানে রাজস্থানের মুম্বই জয়, হেরে প্লে অফের রাস্তা কঠিন করে ফেললেন হার্দিকরা]

২১ শতকের পৃথিবী সেই সাপেক্ষে অনেকাংশে সহিষ্ণু। এখন স্যানিটারি ন্যাপকিনকে ব্যবহার করা হয় প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে, যা আইনের চোখে অশ্লীল নয়। কেননা, ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী এ-ধরনের আন্দোলন বৃহত্তর প্রেক্ষিতের বিচারে সমাজের পক্ষে অহিতকর নয়। কিন্তু বিষয় হল, আইন ও নৈতিকতা সর্বদা সমার্থক না-ও হতে পারে। ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ বা ‘স্লাট শেমিং’-কে বিন্দুমাত্র সমর্থন না-করে কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। অন্তর্বাস পরে রাস্তায় বেরনো ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী আইনত অপরাধ নয়। এই মর্মে যদি কোনও স্কুল শিক্ষক বা শিক্ষিকা দাবি করেন, খুব গরম পড়েছে, অতএব অন্তর্বাস পরে ক্লাস নিতে যাওয়া যাক– তাহলে সেই আচরণ কি স্কুল কর্তৃপক্ষর দ্বারা কিংবা রাষ্ট্রের দ্বারা গৃহীত হবে? কিংবা এ-দেশের কোনও খবরের চ্যানেলের সঞ্চালিকা যদি মনে করেন, বিকিনি পরে খবর পড়বেন, টিভি চ্যানেল কি তা আদৌ মেনে নেবে? তখন কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াইয়ে ‘মাই বডি মাই চয়েজ’ স্লোগান খুব কার্যকর হবে না। বিষয়গুলিকে কর্তৃপক্ষ তো বটেই, স্কুল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা কিংবা খবরের চ্যানেলের দর্শকেরাও মেনে নেবেন না– এমনটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এখন স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন পোশাককে ‘শ্লীল’ বলে মনে করবে, বা কোনটিকে ‘অশ্লীল’, প্রশ্ন উঠতে পারে। এ-দেশের গ্রামীণ স্কুলগুলিতে এখনও শিক্ষিকার কুর্তি-লেগিংসের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এমনকী, পুরুষ শিক্ষকও ইচ্ছা হলেই বারমুডা পরে পড়াতে যেতে পারেন না। এসব সত্ত্বেও ২১ শতকের দেশে শিক্ষিকারা স্বচ্ছন্দে সালোয়ার-কামিজ বা প্যান্ট-শার্ট জাতীয় ফরমাল পোশাক পরে কর্মস্থলে যেতে পারছেন, সেটা খুবই আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। তার কারণ এ-ধরনের পোশাক ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’-কে আহত করছে না।

‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’-এর ব্যাখ্যায় দু’টি শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘সমসাময়িক’ এবং ‘উক্ত সম্প্রদায়’। অষ্টাদশ শতকে যে-দেশে ব্লাউজ না-পরাই ছিল রীতি, সেই দেশের নৈতিকতার বোধ এখন ব্লাউজবিহীন শাড়িকে ‘অশ্লীল’ বলে মনে করে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে অশ্লীলতা বিষয়ক নৈতিকতার ধারণা বদলায়। এবং সম্প্রদায়ের নিরিখেও পাল্টায়। মিয়ামির সমুদ্রসৈকতে যত সহজে বিকিনি পরিহিতা নারীরা ঘুরে বেড়াতে পারে, মন্দারমণিতে পারে না। কেননা, ভারতের অধিকাংশ সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্লীলতার ধারণা পশ্চিমি সভ্যতার সাপেক্ষে এখনও কিছুটা ভিন্ন। যদিও আগামী কয়েক দশকে এই প্রভেদ আর বহাল না-ও থাকতে পারে। কিন্তু এখনও আছে, এবং সেটাই উপজীব্য।

দিল্লির অন্তর্বাস পরিহিতার ভিডিওর নিচে কেউ কেউ যেমন স্রেফ অসমর্থন জানিয়ে গিয়েছে, কেউ আবার উদ্যত হয়েছে ‘স্লাট শেমিং’-এ। তারা মূলত পুরুষ। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে: ‘মেয়েটি বলতে চাইছে আমি তৈরি আছি’ কিংবা ‘রাস্তায় সিঙ্গল ছেলেদের বিনোদন দেওয়ার জন্য এরা তো আছেই’। এই ধরনের বক্তব্য অত্যন্ত কুরুচিকর। একজন মহিলার উন্মুক্ত ছবি প্রকাশ্যে আসছে মানেই তাকে যা-খুশি বলে ফেলা যায়, এমন নয়। সমান্তরালভাবে, ‘জেন্ডার’ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকেও কিন্তু সমসময়ের শ্লীলতার ধারণাকে মাথায় রাখতে হবে। বুঝতে হবে, যে-পোশাক পরে সমুদ্রসৈকতে বসা যায়, সেই পোশাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠা যায় না। এবং এই সিভিক সেন্সটুকু মেনে চলা যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য।
এসব বিতর্কের মাঝে একটা প্রশ্ন কিন্তু এখনও বিশেষ চোখে পড়ল না। দিল্লির ওই বাসে যে-ব্যক্তি ভিডিও ক্লিপিংটি রেকর্ড করেছিলেন, তঁার বিরুদ্ধে শাস্তি হচ্ছে না কেন! একজন মহিলার অজ্ঞাতসারে তঁার ভিডিও বানিয়ে ইন্টারনেটে প্রচার করা প্রশ্নাতীতভাবে আইনত অপরাধ– নানা বিতর্কের ভিড়ে এই প্রাথমিক বিষয়টি যেন ধামাচাপা পড়ে না-যায়।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ