Advertisement
Advertisement
Adani

তালপুকুরে ঘটি ডোবে না

যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা অনেকটাই সামলে নিয়েছে উন্নত দেশগুলি।

Economic downturn and the inapt handling of economy by Central govt | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:February 28, 2023 11:33 am
  • Updated:February 28, 2023 4:46 pm

অতিমারী পেরিয়ে গেল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেরও বছর অতিক্রান্ত। যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা অনেকটাই সামলে নিয়েছে উন্নত দেশগুলি। কিন্তু ভারতে ভোজ‌্য তেলের দামে হেরফের লক্ষ‌ করা যাচ্ছে না। মুদ্রাস্ফীতির এহেন হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে আদানি কাণ্ড প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে ‘ভারতীয় জীবনবিমা নিগম’ তথা ‘এলআইসি’ ও স্টেট ব‌্যাংকের ভবিষ‌্যৎ নিয়ে। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী

 

Advertisement

র্থনীতি পরিচালনায় ক্রমশ ল‌্যাজে-গোবরে অবস্থা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের। পৃথিবীজুড়ে যখন বলা হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, তখন ভারতে জিনিসপত্রের দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই। ভোজ‌্য তেলের দাম সেই যে অতিমারীর সময় থেকে বেড়ে গেল, তা আর কমেনি। প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রের তরফে ব‌্যাখ‌্যা দেওয়া হয়েছিল- মালয়েশিয়ায় পাম তেলের দাম বাড়ার জন‌্যই ভারতের বাজারে প্রভাব পড়ছে। এরপর অজুহাত দেওয়া হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। বলা হল, ইউক্রেন থেকে সরবরাহ বন্ধ হওয়াতেই দেশে সাদা তেলের দাম কমানো যাচ্ছে না।

Advertisement

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পার হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব-অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা অনেকটাই সামলে নিয়েছে উন্নত দেশগুলি। কিন্তু ভারতে ভোজ‌্য তেলের দামে কোনও হেরফের লক্ষ‌ করা যাচ্ছে না। ইদানীং, সাদা তেলের দাম লিটার-প্রতি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এই দাম-ই বাজারে স্থায়ী হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ, অতিমারীর গোড়ায় বাজারে সাদা তেলের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ছিল।

অস্বাভাবিক দাম বেড়ে গিয়েছে চালের। গত ৩ বছরে যে কোনও চালের দামই গড়ে অন্তত কেজিতে ১০ টাকা করে বেড়েছে। ডাল, চিনির দামও ঊর্ধ্বমুখী। চালের মতোই ভয়াবহ বেড়েছে আটার দাম। রেশনে দেশের এক বিরাট অংশের মানুষকে বিনামূল্যে পর্যাপ্ত চাল-গম দেওয়া হলেও খোলা বাজারে কেন চাল ও আটার দাম নিয়মিত বাড়ছে, তার কোনও সদুত্তর নেই। খাদ‌্যপণ‌্যর সঙ্গে সঙ্গে অন‌্যান‌্য যে-কোনও প্রয়োজনীয় স্টেশনারি সামগ্রীর দাম গত দু’-তিন বছরে ইউনিট-প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।

[আরও পড়ুন: সংকটে কাশীর রামকৃষ্ণ মিশন, ভাঙা পড়বে স্বামীজির স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান?]

অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির একটা চক্র কাজ করে। বিভিন্ন কারণে পণ‌্যর দাম কিছুদিন বাড়লেও আবার তা স্থিতিশীল হতে দেখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম কমেও। যেমন ২০২১-এ বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল, তার উৎস ছিল আমেরিকা। কোভিডের সময় মার্কিন সরকার তাদের নাগরিকদের বড় অঙ্কের আর্থিক সাহায‌্য দেয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সময় তাঁর কোষাগার থেকে প্রায় ২ লক্ষ কোটি ডলার অনুদান বরাদ্দ করেন। এর ফলে লোকের হাতে আচমকা অনেক অর্থ চলে আসে। যার প্রভাব পড়ে বাজারে। জিনিসপত্রের চাহিদা হু হু করে বেড়ে যায়। চাহিদা অনুযায়ী, বাজারে পণ‌্যর সরবরাহ ছিল না। যার নিট ফল মূল‌্যবৃদ্ধি। বাজারে পণ‌্যর চাহিদা বৃদ্ধিতে আমেরিকার আমদানিও বিশ্বজুড়ে বাড়ে। এতে চাপ পড়ে বিশ্ববাজারের জোগান-শৃঙ্খলেও।

কোভিডের জেরে একবছর বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রমের জোগানও ব‌্যাহত হয়। কিন্তু, মার্কিন আমদানির চাহিদা বিশ্ব অর্থনীতিকে চাপে ফেলে দেয়। মূল‌্যবৃদ্ধির প্রভাব গিয়ে পড়ে অন‌্য সমস্ত দেশে। মূল‌্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে শ্রমের মজুরিতে, পুঁজির সুদে ও অন‌্যান‌্য পরিষেবার খরচে। কিন্তু একবছর ধরে চলতে থাকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও ফের বিশ্ব-অর্থনীতির জোগান-শৃঙ্খল স্থিতিশীল হয়েছে। ২০২২-এর মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ব‌্যারেল-প্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছেছিল। বেশ কিছুদিন সেটা কমে ব‌্যারেল প্রতি ৮৫ ডলার হয়েছে। একসময় বাজারে মিলছিল না মাইক্রো-চিপ। এখন মাইক্রো-চিপের জোগান অঢেল। ফলে মার্কিন বাজারে চাহিদা না কমলেও পণ‌্যর জোগান বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। পণ‌্যর জোগান আরও বাড়লে জিনিসের দাম হয়তো বিশ্ববাজারে কমেও যাবে। কিন্তু, ভারতের বাজারে এই জিনিসপত্রের দাম কমার বিষয়টি প্রত‌্যক্ষ করা যায় না। একবার যে জিনিসের দাম বেড়ে যায়, সেটা সেই বেড়েই থাকে। যেমন চাল, আটা, তেল ইত‌্যাদির দাম আর বিশেষ কমবে বলে মনে হয় না। অান্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম কমলেও ভারতে পেট্রোল, ডিজেল বা রান্নার গ‌্যাসের দাম কমেনি।

মুদ্রাস্ফীতির এহেন হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে আদানি কাণ্ড প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে ‘ভারতীয় জীবনবিমা নিগম’ তথা ‘এলআইসি’ এবং স্টেট ব‌্যাংকের ভবিষ‌্যৎ নিয়ে। আদানিদের শেয়ারের দাম বাজারে ৬০ শতাংশ পড়ে গিয়েছে। তা ফের উঠবে বলে ভরসা কারও নেই। হর্ষদ মেহতার শেয়ার কেলেঙ্কারির সময় ঠিক ইউটিআইয়ের শেয়ারের যে দশা হয়েছিল, তেমনটা এলআইসি বা স্টেট ব‌্যাংকের আদানির সাম্রাজ্যের করা লগ্নির অবস্থা হবে কি না, সে-ই এখন প্রশ্ন। সংবাদমাধ‌্যমেই জানা যাচ্ছে, আদানি কাণ্ডের পর এলআইসি-র ৫০ দিনে ৫০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এলআইসি আদানি গোষ্ঠীর সাতটি সংস্থার যে-শেয়ার কিনেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর তার বাজার দর ছিল ৮২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। বাজারে আদানিদের শেয়ারে ধস নামার পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সেই শেয়ার দর দঁাড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এলআইসি যদি এখন তার হাতে থাকা আদানি সংস্থার সমস্ত শেয়ার বাজারে বিক্রি করে দেয়, তাহলে তার ক্ষতি হবে ৪৯ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় কথা হল, এলআইসি যে-দামে আদানিদের শেয়ার বাজার থেকে কিনেছিল, এখন শেয়ার বাজারে আদানিদের শেয়ার তার থেকে নিচে চলে গিয়েছে। ফলে ক্ষতিটা শুধু ধারণাগত নয়। আদানিদের শেয়ারের দাম ফের আগের জায়গায় না-পৌঁছলে এলআইসি-র ক্ষতি অনিবার্য। একই অবস্থা স্টেট ব‌্যাংকেরও। আদানিদের সংস্থায় স্টেট ব‌্যাংকের বিশাল পরিমাণে ঋণও রয়েছে। আদানিদের ব‌্যবসা লাটে উঠলে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে স্টেট ‌ব‌্যাংকের।

এখন প্রশ্ন, রাষ্ট্রায়ত্ত এলআইসি বা স্টেট ব‌্যাঙ্ক তাদের এই হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি পোষাবে কোথা থেকে? এলআইসি-র ক্ষেত্রে যেটা ঘটতে পারে, তা হল তারা বিমার গ্রাহকদের টাকা ফেরাতে ব‌্যর্থ হতে পারে। গ্রাহকদের বোনাসের পরিমাণ কমতে পারে। এলআইসি-তে নতুন করে লগ্নিতে কেউ আগ্রহ না দেখাতে পারে। আর্থিক ক্ষতির ফলে এলআইসির পণ‌্যগুলির আকর্ষণ ক্ষমতা কমতে পারে- ইত‌্যাদি ইত‌্যাদি। সংস্থাকে বাঁচাতে এলআইসি-র কর্মীরা ইতিমধ্যে পথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আদানিদের আর্থিক ধাক্কায় স্টেট ব‌্যাংক হয়তো উঠে যাবে না। কিন্তু স্টেট ব‌্যাংকের আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে ফের হয়তো সরকারকে জনগণের করের টাকা খরচ করতে হতে পারে।

সব মিলিয়ে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, এলআইসি ও স্টেট ব‌্যাঙ্কের ভবিষ‌্যৎ ইত‌্যাদি কোনও সংকটেরই যে কোনও সদুত্তর কেন্দ্রর কাছে নেই, তা বলা বাহুল‌্য। বলা হয়, শুধুমাত্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সুদ কমিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে। ব‌্যাংক, বিমার মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলি নিয়ে হেলাফেলা করার মূল‌্য মোদি সরকারকেও চোকাতে হবে কি না, এখন সেটাই দেখার।

[আরও পড়ুন: ইংরেজির বেলায় দরাজ, বাংলা বই কেনার প্রশ্ন উঠলেই ‘পকেটে টান’]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ