Advertisement
Advertisement

Breaking News

Priya Ranjan Dasmunsi

বহুবর্ণের প্রিয়দা

কুণাল ঘোষের কলমে উঠে এল অজানা তথ্য।

Exploring Priya Ranjan Dasmunsi, writes Kunal Ghosh
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 28, 2023 5:00 pm
  • Updated:May 28, 2023 5:00 pm

যে-কয়েকজন নেতার বিদায়জনিত শূন্যতায় বাংলার কংগ্রেসটাই নজিরবিহীনভাবে শূন্য স্পর্শ করেছিল, তাঁদের অন্যতম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। লড়াকু ছাত্রনেতা, সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সুবক্তা, সুকৌশলী রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিপ্রেমী, ফুটবল প্রশাসক- আরও কত কিছু। অলরাউন্ডার প্রিয়দাকে ফিরে দেখা। কলমে কুণাল ঘোষ

‘সাংবাদিকের ডায়েরি’ থেকে আজ আর-এক বর্ণময় চরিত্র, তুখড় অলরাউন্ডার প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে নিয়ে কিছু পুরনো কথা।

Advertisement

প্রিয়দা লড়াকু ছাত্রনেতা, সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সুবক্তা, সুকৌশলী রাজনীতিবিদ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, সংস্কৃতিপ্রেমী, লেখক-কবি-সম্পাদক, ফুটবল প্রশাসক- আরও কত কিছু। এবং মিশুকে, আড্ডাবাজ।

Advertisement

সমালোচকরা প্রিয়দার বিরুদ্ধে দু’-দশটা কথা বলতে পারেন। কিন্তু মানুষটা ওসবের ঊর্ধ্বে, এটা অনস্বীকার্য। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থেকে উঠে এসে সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠিত থাকা, কম বড় কথা নয়। আর রাজ্য-রাজনীতিতে আস্ত একটা প্রজন্মকে প্রচারের সামনে এনে দিয়ে গিয়েছেন প্রিয়দা, যে-তালিকার মধ্যে প্রথম নাম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ‘প্রিয়-সুব্রত’ জুটি একসময় কংগ্রেসকে অনেক দিয়েছে।

সালটা বোধহয় ১৯৮৭, আমি চুটিয়ে ছাত্র পরিষদ করি। প্রিয়দা তখন রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য। যে কোনও কারণেই হোক, বুঝতাম, প্রিয়দা আমাকে পছন্দ করেন। আমার ভারি ইচ্ছা, আমাদের এলাকায় প্রিয়দাকে দিয়ে সভা করাব। ছাত্র পরিষদের মঞ্চ থেকে। বললাম প্রিয়দাকে। সম্মতি দিলেন। সুকিয়া স্ট্রিট মোড়ে মঞ্চ বেঁধেছি। দু’রকম বিপদ এল। এক) এলাকা সোমেনদা, অজিত পাঁজার প্রভাবপুষ্ট। যাঁরা গোষ্ঠীবিন্যাসে প্রিয়দার বিরুদ্ধে। সোমেনদা কিছুই বলেননি। কিন্তু স্থানীয় সিনিয়র কংগ্রেসিরা হাওয়া। দুই) অনেকেই বললেন, ধুর, একটা বাচ্চা ছেলের কথায় প্রিয়দা আসবেন? আমরা লোক হাসাচ্ছি।

সেদিন সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে বিমানবন্দরে নেমে প্রিয়দা এসেছিলেন সুকিয়া স্ট্রিট মোড়ে। আমাকে পাশে নিয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেন। ভিড়ের সমুদ্রে অত বড় ট্রামরাস্তা বন্ধ। বুঝলাম, ভাষণের ‘ম্যাজিক’ কাকে বলে। এ-ও বুঝলাম, নতুন ছেলেদের স্বীকৃতি দেন এই নেতা। সেই থেকে যোগাযোগ বাড়ল।

[আরও পড়ুন: কৃতী ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে রাজনৈতিক বিবৃতির লড়াই? কমরেড, ক’টা কথা ছিল]

আমি প্রবেশ করলাম সাংবাদিকতায়। একটু যেন যোগাযোগ কম। তারপর ১৯৯২ ডিসেম্বর। মমতাদির ব্রিগেডের আগের দিন বিকেল। মাঠ পরিদর্শন চলছে। ভিড়। আমি তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। আমার নজর মমতাদির দিকে। হঠাৎ ডাক, ‘এই, তুই কুণাল না?’ ঘুরে দেখি প্রিয়দা। প্রণাম করলাম। কথা হল। নতুন করে আবার যোগাযোগ শুরু। এক সামান্য কর্মীকে নাম ধরে মনে রাখা, এতেই তো নেতা মন জয় করে নেন।

১৯৯৪। আমি ‘আজকাল’-এ। প্রিয়দার ফোন। পরদিন সকালে রাজারহাটে জমি দখলের বিরুদ্ধে মিছিল। প্রিয়দা আনছেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। গেলাম। আলাপ, কভারেজ, সবই হল। পরে জানতে চাইলাম, এত নেতা থাকতে মনমোহন সিং কেন? উনি তো ঠিক রাজনৈতিক নেতাও নন। ১৯৯৪ সালে প্রিয়দার জবাব ছিল, ‘লিখে রাখ, এমন একটা দিন আসবে, কংগ্রেস এই লোকটাকে প্রধানমন্ত্রী করতে বাধ্য হবে। আমি এখন থেকেই ধরে রাখলাম (প্রবল হাসি)।’ অনেক পরে, ২০০৪ সালে এই কথা মনে করিয়ে দিতে প্রিয়দা হেসে বলেছিলেন, ‘তাহলে বল- মিলিয়ে দিলাম!’

১৯৯৭, দেবগৌড়া সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তাল বানচাল হয়েছে কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরীর। প্রধানমন্ত্রী বদল। গুজরাল দায়িত্বে। সর্বত্র কেশরীর নিন্দা। লোকসভায় আস্থাভোটে কেশরীর সম্মানরক্ষা করবে কে? কেশরীই তো লোকসভায় নেই। বিজেপি তুলোধোনা করছে। অসাধারণ বক্তৃতায় বিজেপিকে শুইয়ে দিয়ে কেশরীর মান বাঁচালেন প্রিয়দা। গ্যালারি থেকে নেমে প্রিয়দাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন কেশরী। মনে রাখতে হবে, প্রিয়দা সে-সময় কেশরীকে সরিয়ে শরদ পাওয়ারকে সভাপতি করার লড়াইয়ে ব্যস্ত।

কিন্তু দেশের নজরকাড়া লোকসভার বিতর্কে সভাপতির সম্মানহানি রুখতে তিনি-ই সেরা বক্তা। একটা লোক একসঙ্গে ক’টা কাজ পারে? প্রিয়দা মন্ত্রী। দপ্তরের কাজ। সর্বভারতীয় নেতা, দায়িত্ব। একই সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। গোষ্ঠী, দল, জেলা, আন্দোলন। একই সঙ্গে এআইএফএফ সভাপতি। প্রতিটি রাজ্যের ফুটবল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে। ভোটে জিতে সভাপতি হচ্ছেন। আই লিগ থেকে নেহরু কাপ করছেন। একই সঙ্গে সাংসদ। এলাকায় যান। কাজ করেন। প্রিয়দার একাধিক নির্বাচন আমি ‘কভার’ করেছিলাম। সিপিএমের তৎকালীন জেলা সম্পাদক বীরেশ্বর লাহিড়ী একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রিয়র উপর নজর রাখতেই পাগল হওয়ার জোগাড়! কখন যে কোথায় যায়, কী করে, কী বলে। ওর উপর গোয়েন্দাগিরি করতে হচ্ছে।’ বীরেশ্বরবাবুর এই কঠিন সমস্যা দিয়েই সেবার খবরের শিরোনাম হয়েছিল। বীরেশ্বরবাবুই বলেছিলেন কাণ্ডটা, ‘আমাদের প্রার্থীর নাম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। প্রিয় আর-একটা সুব্রত মুখোপাধ্যায় এনে নির্দল দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে শুনলাম বারাসতে থাকে, তৃতীয় ডিভিশনের রেফারি। প্রিয় ওকে ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবলে আনবে বলে টুপি দিয়ে এখানে দাঁড় করিয়েছে। এখন আমাদের দুই সুব্রতর তফাত বোঝাতে সময় যাচ্ছে।’
আবার প্রিয়দা একই সঙ্গে কবি, লেখক, সম্পাদক। প্রতি বছর মহালয়ার সকালে ‘দক্ষিণীবার্তা’ প্রকাশ। গুণমানে অসাধারণ বই। সঙ্গে গুণীজন সংবর্ধনার তারকা সমাবেশ ও অনুষ্ঠান। কে নেই? ছিলেন বাংলার প্রায় সব তারকা। ক্ষমতার আস্ফালন নয়। দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক সংগঠকের ভূমিকা। সকালে বীরেন ভদ্রর মহিষাসুরমর্দিনীর পর বেলায় প্রিয়দার ‘দক্ষিণীবার্তা’- এটা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় প্রথম মোহন সিংয়ের রবীন্দ্রসংগীত ওখানেই শোনা। এবং তার ফাঁকেই প্রেম আর বিয়ে।

প্রিয়দা সামলেছেন সব দিক। কাজ করেছেন অবিরাম। শেখার মতো। সিপিএম-বিরোধী রাজনীতিতে আপসহীন। যে-ক’জনের নাম শুনলে সিপিএম নেতারা রেগে উঠতেন, তার মধ্যে প্রিয়দা অন্যতম। অবলীলায় তিনি বলে দিতেন, ‘হাত চিহ্নে ভোট দিন। যেখানে হাত নেই সেখানে তৃণমূলকে ভোট দিয়ে দেবেন।’ রাজ্য কংগ্রেসে ‘প্রিয় ঘরানা’ ছিল চিহ্নিত। সুব্রত, সৌগত, সুদীপ-সহ গাদাগুচ্ছের নেতা এই ঘরানার। সোমেনদার সঙ্গে বনিবনা কম। মমতাদির সঙ্গে বিচিত্র ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার’ সম্পর্ক। প্রিয়দা মমতাদিকে সাহায্য প্রচুর করেছেন, আবার উল্টো ঘটনাও ঘটিয়েছেন।

প্রিয়দা কংগ্রেস বা ছাত্র-যুব রাজনীতিতে নেতাদের জমিদারি ইমেজ ভেঙে মাটির ছোঁয়া লাগা ‘পাশের বাড়ির ছেলে’ হতে পেরেছিলেন। সহপাঠীদের সঙ্গে থাকা-খাওয়া জীবনযাপনে কমিউন সংস্কৃতি। বাম বাম গন্ধ। এলাকা দখলের রাজনীতি নয়, মস্তিষ্কভিত্তিক রাজনীতি।

দিল্লির দরবারে একবার ধাক্কা খেয়েও ঘুরে দাঁড়ানো বড় কম কথা নয়। প্রিয়দা সঞ্জয় গান্ধীর উপর রাগে ইন্দিরাজিকে ছেড়ে যান। সফল হননি। আবার দলে ফিরে শীর্ষে ওঠা, সোনিয়া গান্ধীর আস্থাভাজন হওয়া- এই যাত্রাপথ দক্ষতার পরিচায়ক।

দলের মধ্যে প্রিয়দা মূলস্রোতে থেকেও স্বতন্ত্র। একসময় ইন্দিরাকে ছেড়ে যান। পরে যখন কেশরী সভাপতি, তখনও প্রিয়দা তাঁকে সরিয়ে শরদকে আনতে মরিয়া। সেটাও না-হওয়ায় সোনিয়া আবাহনে অন্যতম কারিগর। লিখতেই হচ্ছে, ওই সময় আমি দিল্লিতে। একদিন সকালে ‘বিকেলের প্রতিদিন’-এর জন্য খবর চাইলাম। খবরের বাজার ফাঁকা। প্রিয়দা দিন-পাঁচেক পরের একটা তারিখ দিয়ে বললেন, ‘কংগ্রেসে ক্যু হবে। কেশরীজি ক্ষমতাচ্যুত, সোনিয়াজি সভানেত্রী হবেন। লিখে দে।’ ভাবলাম প্রিয়দা গল্প দিচ্ছেন। তবে সান্ধ্য কাগজ তো, গল্প চলবে। কলকাতায় বললাম, ‘সান্ধ্যে বড় করে। কিন্তু পরদিন সকালে ছোট করে।’ এসব অবিশ্বাস্য কথাবার্তা পরে না মিললে কেলেঙ্কারি! কী কাণ্ড, ওই তারিখেই নাটক, কেশরী অপসারণ, সোনিয়াজি সভানেত্রী। প্রিয়দার কাছে সঠিক খবর ছিল।

রাজ্য-রাজনীতিতেও আলাদা ঘরানা। প্রিয়দা প্রণববাবু বা বরকত সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলাটা ঠিক হবে না। অজিত পাঁজা বা সোমেনদার টিমও না। প্রিয়দা আলাদা, প্রিয়দারই মতো। রানি ভবানী রোডের বাড়িটার বৈঠকখানার যা মেজাজ, তাতে তা যত না রাজনীতিবিদের, তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিজীবীর।

আমার সঙ্গে অনেক নেতা-নেত্রীর পরিচয় থাকলেও, তাঁরা পুজোয় এলেও, যতদিন প্রিয়দা সুস্থ ছিলেন, আমাদের রামমোহন সম্মিলনীর দুর্গাপুজোর উদ্বোধন তিনিই করতেন। সেটা ২০০৬, অনিল বিশ্বাস প্রয়াত। ঠিক হল পুজোর সঙ্গে যে-প্রদর্শনী, তার বিষয় হবে অনিল বিশ্বাস। উদ্বোধক তৎকালীন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য। পুজো উদ্বোধন আগে, বিকেল ৫টায়। আগেই বলে রাখতে গেলাম প্রিয়দাকে, অনিল বিশ্বাসকে নিয়ে প্রদর্শনী করা হয়েছে। সামনে দিয়েই যেতে হবে। রাজনৈতিক কারণে আমার দ্বিধা আন্দাজ করে প্রিয়দার জবাব, ‘বেশ করেছিস অনিলকে নিয়ে প্রদর্শনী করেছিস। অনিলের চলে যাওয়াটা সিপিএমের অপূরণীয় ক্ষতি। দেখবি, ওরা সামলাতে পারবে না। মাথাটাকে সেলাম করতে হয়।’ প্রিয়দা দিব্যি সময় কাটালেন রামমোহন সম্মিলনীতে। অনিলদার ছবির সংগ্রহের প্রশংসা করলেন।

আমার পারিবারিক অনুষ্ঠানেও প্রিয়দা এসেছেন। বহু কর্মসূচিতে তো বটেই। প্রিয়দার পছন্দের আরেক সাংবাদিক ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায়। তাকে কাটিয়ে প্রিয়দার ঘর ঠিক রাখা, খবর করাটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। প্রিয়দা নিজে সাহায্য না-করলে এসব হত না। কলকাতা, দিল্লি- দু’-জায়গাতেই প্রিয়দার বাড়ি ছিল অবারিতদ্বার। দাদা এবং বউদি- দু’জনেই পছন্দ করতেন। একবার রাতে প্রিয়দার দিল্লির খান মার্কেটের বাড়ি ঢুকেছি। বললেন, ‘চ, কেশরীজির বাড়ি যাব।’ দেখি, সঙ্গে বউদিও। তারপর প্রিয়দা ঢুকে গেল কেশরীজির বাড়ি, আমি আর বউদি রাস্তায় গল্প করেই যাচ্ছি।

দীপা দাশমুন্সি সম্পর্কে আমার অতি উচ্চ ধারণা ছিল। রুচিশীল, সংস্কৃতিমনস্ক, রাজনীতি সচেতন, সুবক্তা। বড় টিপটা আমার বেশ লাগত। যেভাবে রায়গঞ্জ সামলাতেন দীপাদি, দেখার মতো, প্রিয়দার কাজ কমিয়ে দিতেন। ঘর সাজানো থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি- সবেতেই নিজস্বতা ছিল বউদির। কিন্তু পরে, ক্রমশ সেটা বোধহয় ধরে রাখা যায়নি; প্রিয়দার পর প্রিয়দা-শিবিরের পতাকাটা ধরে রাখার গুণ ছিল বউদির, কিন্তু সম্ভবত কিছু ভুল পদক্ষেপে সেটা হল না। শিবিরটাও ভেঙে গেল। কংগ্রেস রাজনীতিতে যতজন রাজনীতিমুখী বউদি দেখেছি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা ছিলেন দীপাদি। কিন্তু, উগ্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে, কিছু নেতার ভুল পরামর্শে দীপাদি মূলস্রোত থেকে ছিটকে গেলেন। কিন্তু ওঁর মধ্যে রাজনীতির সব উপাদান আছে। জানি না ভবিষ্যতে দীপাদি কী করবেন।

সরস্বতী পুজোয়, কলকাতায়, প্রিয়দার দাদার বাড়ি সকলের গেট-টুগেদার। সেখানে দীপাদি বাড়ির বউ। আবার রায়গঞ্জে দেখেছি, রাতে কোমর বেঁধে টর্চের আলোয় ঢাল পথে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরছেন। সোমেনদা তৃণমূল থেকে কংগ্রেসে ফেরার সময় শিখাদিকে নিয়ে দীপাদির বাড়ি গিয়েছিলেন। দুই বউদির সে কী আড্ডা! সেসব পরে একদিন লেখা যাবে।

একবার আমার উপর বেদম চটেছিলেন প্রিয়দা। বোধহয় ২০০৭। প্রিয়দা আবার প্রদেশ সভাপতি হয়েছেন। সোমেনদাকে সামলে সুষ্ঠুভাবে শুরু করতে চান। সোমেনদা তখন চটে। প্রিয়দা সোমেনদার বাড়ি গিয়ে দীর্ঘ বৈঠকেও ঠান্ডা করতে পারলেন না। এরপর খবর পেলেন, সোমেনদা-মমতাদি বৈঠক হয়েছে।

আরও খবর পেলেন, সোমেনদাকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। প্রিয়দা রেগেছিলেন। দুঃখ পেয়েছিলেন। ক’দিন কথা বলেননি। তারপর ডাকলেন অদ্ভুত জায়গায়। গ্র্যান্ড হোটেলে কোনও সেমিনারে এসেছিলেন। আগে নির্দেশ এল, রিসেপশনের সামনে যেসব বসার জায়গা, তার পিছনের দিকে চেয়ারে বসে থাকতে হবে। বসে আছি। হঠাৎ সদলে প্রিয়দার প্রবেশ। সবাই দূর থেকে তাকিয়ে। প্রিয়দা আর আমি মিনিট ২০ একান্তে। ‘তুই এটা করতে পারলি? মমতা-সোমেন এক করে দিলি! খুব দুঃখ পেলাম। আমি সভাপতি জেনেও এটা করলি?’

আমি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বললাম, যদি দু’জন সিনিয়র নেতা-নেত্রী কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে তৃতীয়ের ভূমিকা কি নিমিত্তমাত্র নয়? প্রিয়দা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তবে যোগাযোগটা আবার শুরু হয়ে যায়। প্রিয়দা এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর সম্পর্কে শুনেছি। জেনেছি। দেখার সুযোগ পেয়েছি কাছ থেকেও। তিনি আমাকে রাজনৈতিক কর্মীর মর্যাদা দিয়েছেন। পরে সাংবাদিক হিসাবে সম্মান দিয়েছেন, ‘এক্সক্লুসিভ’ দিয়েছেন। রাজনীতির বাইরেও সামাজিক বা ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। প্রমোদ দাশগুপ্তর স্মরণসভায় নজিরবিহীন সৌজন্যে নিজের লেখা কবিতা পাঠ; কখনও লোকসভায় অটলবিহারী বাজপেয়ীকে আক্রমণ করে দুরন্ত বক্তৃতার মধ্যে বাজপেয়ীজির লেখা কবিতার ব্যবহার; ঢাকা সফরের সেই রাত, যখন প্রিয়দা ফোনে যোগাযোগ করতে পারলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে; কিংবা তৃণমূল ঝড়ে কংগ্রেস লাটে ওঠার পর পরেশ পালের যুব কংগ্রেসের ব্রিগেড মঞ্চে প্রিয়দার মৃতসঞ্জীবনী ভাষণ- মনে আসছে একের পর এক ঘটনা।

ঢাকার কথা বলি। প্রিয়দা কেন্দ্রের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। জলবণ্টন নিয়ে কথা চলছে। ‘সোনার গাঁ’ হোটেলে সকাল দশটা থেকে টানা বৈঠক নানা ইস্যুতে। সন্ধে পার। প্রিয়দা জট খুলতে চাইছেন। রাত সাড়ে ন’টা, দশটা। হঠাৎ প্রিয়দা বেরিয়ে এসে বললেন, ‘বুদ্ধকে জরুরি দরকার। তিস্তা নিয়ে। একবার কথা বলব।’ বুদ্ধবাবুকে সবরকমভাবে খবর দেওয়ার চেষ্টা হল। কিন্তু তিনি প্রিয়দার ফোনটি ধরেননি। বলা হল, ‘শুয়ে পড়েছেন।’ প্রিয়দা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বৈঠকটা আটকে গিয়েছিল।

প্রিয়দার সম্পর্কে মজাদার সব কথার সিন্দুক ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। প্রিয়দার দক্ষতার সমান প্রবাদপ্রতিম ছিল তাঁর ‘টুপি’ দেওয়ার গল্প। সুব্রতদার কথায়, “প্রিয়দার কাছে অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল, তবু আবার কিছু টাকা দরকার। সেদিন বিকেলে প্রিয়দা দিল্লি যাবে। বলল, ‘এয়ারপোর্ট চলে আয়। দিয়ে দেব।’ কী মনে হল, হাওড়া স্টেশনে চলে গেলাম। দেখি, প্রিয়দা রাজধানী ধরতে ঢুকছে। ভাবলাম অবাক হবে। হল না, কী সাবলীলভাবে বলল, ‘ও, তুই এসে গেছিস?’

২০০৪, প্রিয়দা কেন্দ্রে কংগ্রেসের মন্ত্রী, সুব্রতদা কলকাতায় তৃণমূলের মেয়র। দু’জনকে একসঙ্গে ‘রামমোহন সম্মিলনী’-র পুজোয় আমন্ত্রণ করেছিলাম। দু’জনেই এলেন, অনেক আড্ডা, দারুণ খবর আর ছবি হল, দীর্ঘকাল পর প্রিয়-সুব্রত একসঙ্গে। পুজো উদ্বোধন হিট!

একটি ঘটনা। চুপি চুপি বলি। সিপিএম নন্দীগ্রাম পুনর্দখলে হামলা করেছে। রক্তগঙ্গা বইছে। ভোর সাড়ে ছ’টায় মমতাদির ফোন, প্রিয়দাকে ধরো এখনই, প্রধানমন্ত্রীকে বলুক, কিছু একটা করুক কেন্দ্র। প্রিয়দা তখন ইউপিএ-ওয়ান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। সাতসকালেই পেলাম প্রিয়দাকে। শুনে বললেন, ‘শোন, এখন কাউকে পাব না। আমি ফোনটা অফ করে দিচ্ছি। তুই মমতাকে বলে দে আমাকে পাচ্ছিস না। সাড়ে দশটার পর আবার পাবি।’ সেদিন বেলায় অবশ্য দু’জনের কথা হয়েছিল। প্রিয়দা সিপিএমের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিছুটা তৎপরও হন।

একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল। ভারত জিতেছে। প্রিয়দা মাঠে শিশুর মতো লাফাচ্ছেন। টিভিতে দেখলাম বউদিও কাছাকাছি, ফোন করলাম, ‘দাদাকে দিন।’ প্রিয়দা ওই অবস্থায় কাগজে ওঁর বাইলাইন কলমের পয়েন্টস দিয়েছিলেন। আরেকবার বিশ্বকাপের আসর থেকে ফোনে কপি, সেটাও বাইলাইন। জাতীয় লিগ-সহ একাধিক পদক্ষেপে ভারতীয় ফুটবলেরও বহু সময়োপযোগী কাজ করে দিয়ে গিয়েছেন প্রিয়দা। মোহনবাগানকে ‘জাতীয় ক্লাব’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। শেষবার দেখেছি ২০১১-’১২ সালে। প্রিয়দা শয্যাশায়ী। সুদীপদা তখন কেন্দ্রে স্বাস্থ্য রাষ্ট্রমন্ত্রী। সুদীপদাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। তখনই অসুস্থ প্রিয়দার ছবি তুলেছিলাম।

মৃত্যুর সঙ্গে এ এক অসম লড়াই। প্রিয়দা এখন নেই। প্রিয়দা যেখানেই থাকুন, চিরশান্তিতে থাকুন।

একটি মজাদার ঘটনা লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। প্রিয়দা কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হয়ে কলকাতা ফিরছেন। রাজ্যের সমস্যা নিয়েও কথা হবে। রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী তখন নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। অধুনা প্রয়াত বর্ষীয়ান সিপিআই নেতা। নন্দদা তখন অসুস্থ। এসএসকেএম হাসপাতালে উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি। মাথায় ভূত চাপল, কেন্দ্র-রাজ্য দুই জলমন্ত্রীর সাক্ষাৎ ছবি-সহ ‘এক্সক্লুসিভ’ করব। হাসপাতালের বেডে নন্দদার পাশে প্রিয়দা। প্রিয়দা তখনও দিল্লিতে। ফোনে প্ল্যানটা বললাম। তিনি রাজি। বলে দিলাম, আর কোনও কাগজকে বলে বসবেন না যেন। প্রিয়দা বিকেলের বিমানে কলকাতা এলেন। সন্ধ্যায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র অফিসে গেলেন সৌজন্য সাক্ষাতে। আমাকে বলা ছিল একটু এগিয়ে ‘দ‌্য স্টেটসম্যান’-এর সামনে দাঁড়াতে। অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ওদিকে নন্দদাকে বলা আছে। ফোটোগ্রাফারও রেডি। স্টোরি জব্বর! একে তো সমসাময়িক ছাত্র আন্দোলনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধু। প্রিয়দা কংগ্রেস। নন্দদা কমিউনিস্ট। তার উপর ঘটনাচক্রে দুই জলসম্পদ মন্ত্রী। সাক্ষাৎ রাতে, হাসপাতালে। প্রথম পাতায় জায়গা রাখা। কিন্তু প্রিয়দা আসবেন তো?

প্রিয়দা এলেন। কনভয় ‘দ‌্য স্টেটসম্যান’-এর সামনে দাঁড়াল। উঠলাম। সটান পিজি উডবার্ন। হাসপাতাল শয্যায় দুই মন্ত্রীর আলিঙ্গনে গভীর আন্তরিকতা। ছবির পর ছবি। তারপর দু’জনের কথোপকথন। ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক- দু’রকমই। পুরনো দিনের গল্প। লেখা পরের কথা, এসব শোনা মানেই সমৃদ্ধ হওয়া। যাক, বেশ কিছুক্ষণ এসব চলল। তারপর প্রিয়দা চলে গেলেন রানি ভবানী রোডের বাড়িতে। আমি অফিসে ঢুকে কপি লিখতে বসলাম।
পরদিন ‌‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রথম পাতায় ছবি-সহ এক্সক্লুসিভ– কলকাতায় ফিরেই হাসপাতালে গিয়ে রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রের মন্ত্রী প্রিয়।

সকাল ন’টাতেই ফোন। দেখি প্রিয়দা, ‘কী রে, হল তোর এক্সক্লুসিভ! খুশি?’ কানে ভাসছে এসব।

প্রিয়দার রাজনৈতিক বহু বৈঠক জানা। আমি শুধু এমন একটি বৈঠক লিখব, যেটায় প্রিয়দা ছিলেন না। সোমেন-মমতা সংঘাতে প্রিয়দা কখন যে কোনদিকে- কেউ জানে না! ১৯৯২ সালে সভাপতিত্ব নিয়ে ভোটে সোমেনদা-মমতাদি মুখোমুখি। কথা বন্ধ। প্রিয়দা দুই শিবিরেই অবারিতদ্বার। সোমেনদা জিতেছিলেন বটে। কিন্তু সোমেন-শিবিরের ধারণা ছিল, প্রিয়দার সব অনুগামী সোমেনদাকে ভোট দিলে জয়ের ব্যবধান আরও বাড়ত। আর মমতাদির ধারণা, প্রিয়-শিবিরের ভোটেই মমতাদির হার।

বুঝুন কাণ্ড! তবে পরে মমতাদির সঙ্গে প্রিয়দার যোগাযোগ ছিল তুলনায় বেশি। মমতাদিও সেটা রাখতেন। সিঙ্গুর নিগ্রহের পর মমতাদি গান্ধীমূর্তির তলায় বসে যখন কাঁদছেন, ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়ান প্রিয়দাই।

যাই হোক, সেটা ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭। দুপুরে মমতাদির ঘোষণা, কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে লড়বেন। বিকেল চারটে। দিল্লির ফোন সোমেন মিত্রকে, মমতাদিকে বহিষ্কার করা হবে। সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করুক প্রদেশ কংগ্রেস, কিন্তু সভাপতি সোমেনদা অনিচ্ছুক। তাঁর যুক্তি, যে নিজেই গিয়েছে, তাকে আর ‘বহিষ্কার’ কেন? দিল্লি শুনছে না। বারবার ফোন। সীতারাম কেশরীর জরুরি এবং কড়া বার্তা। তখন পুরনো প্রদেশ অফিস। সোমেনদা বারবার উঠে গিয়ে ফোন ধরছেন। ফোন আসছে ছাদের ঘরের লাইনে, ধরেই ডাক পাঠাচ্ছেন বাদল ভট্টাচার্য। তুমুল ভিড়! শেষমেশ সন্ধে ছ’টায় জরুরি বৈঠক ডাকলেন সোমেন। ফোন করলেন সিনিয়রদের। অনেকে ছিলেন, অনেকে এসে গেলেন। ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য, জয়নাল আবেদিন-সহ অনেকে।

প্রিয়দা কলকাতায়। সোমেনদা ফোনে সব বললেন। ফোন রেখে বললেন, ‘প্রিয় আসছে। বলল, দিল্লি নির্দেশ দিলে তো মানতেই হবে। বৈঠক শুরু হোক। আমি আসছি।’ বৈঠক শুরু। বৈঠক শেষ। সাংবাদিক বৈঠক। ঘোষণা। প্রিয়দা সেদিন আর এসে পৌঁছননি। বারবার চেষ্টা করেও সোমেনদা আর যোগাযোগও করতে পারেননি।

প্রিয়দার কলম ছিল বেশ শক্তিশালী, বিশেষত কবিতা। আমার সম্পাদিত ‘রাজনীতি অরাজনীতি’ বই থেকে প্রিয়দার লেখা ‘অনিশ্চিত প্রহর’ কবিতার ক’টা লাইন তুলে দিলাম, ‘কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে না,/ শিবিরের কুচকাওয়াজ/ নিয়মের অনুভূতি শুধু।/ ঝড়ের মেঘে/ বৃষ্টির কোনো বার্তা নেই।/ অথচ শান্তি নেই কোথাও।’

[আরও পড়ুন: ‘অখণ্ড ভারত’ কি খণ্ড-খণ্ড হবে, মণিপুরে কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ