শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই কেন্দ্রের হিসাবে প্রায় ১৮৬ থেকে ১৮৮ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন হবে। ১৮-অনূর্ধ্বদের ধরলে দেশে মোট টিকার প্রয়োজন ২৮০ কোটি ডোজের কাছাকাছি হবে। এর ২৫ শতাংশ মানে প্রায় ৭০ কোটি ডোজ। গড়ে যদি একেকটি ডোজের দাম হাজার টাকা ধরা হয়, তাহলে ৭০ হাজার কোটি টাকার একটি বিরাট ব্যবসা। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
কীভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ককে টিকা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে একটি হিসাবের খতিয়ান দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) একটি মামলায় কেন্দ্রের এই হিসাবের খতিয়ান হলফনামা হয়ে জমা পড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৩১ জুলাই পর্যন্ত টিকাকরণের লক্ষ্যপূরণে কেন্দ্র অন্তত ৩০ শতাংশ টিকার ক্ষেত্রে রাজ্য ও বেসরকারি সংস্থার সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। ২১ জুনের পর থেকে উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির কাছ থেকে সমস্ত টিকা সংগ্রহ করছে কেন্দ্র। তার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ ১ মে থেকে ২০ জুনের মধ্যে, রাজ্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে উৎপাদনকারীর কাছ থেকে টিকা সংগ্রহে ছাড়পত্র দেওয়া ছিল। ওই সময়-কালে বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি যে টিকা (vaccine) উৎপাদনকারীর কাছ থেকে সরাসরি কিনেছে, তা জুলাই পর্যন্ত কেন্দ্রের লক্ষ্যপূরণের একটি ফাঁক পূরণ করবে। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই জানাচ্ছে, সেই ফাঁকটি এই সময়ে যে টিকা দেওয়া হবে, তার অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
সুপ্রিম কোর্টের চাপেই কেন্দ্রীয় সরকার তার টিকা-নীতির পরিবর্তন করেছে বলে রাজনৈতিক মহলের দাবি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বেশ কিছুদিন ধরেই বিনামূল্যে জনগণের সব অংশকে টিকা দেওয়ার কথা বললেও প্রাথমিকভাবে তা নিয়ে কেন্দ্রের হেলদোল ছিল না। অর্ধেক টিকা দেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলির উপরই ছেড়ে রেখেছিল কেন্দ্র। শীর্ষ আদালত যাকে কেন্দ্রের ‘খামখেয়ালি নীতি’ বলে বর্ণনা করেছিল। শীর্ষ আদালতের মন্তব্যের পর কেন্দ্র যে নয়া টিকা-নীতি ঘোষণা করল, তাতেও ২৫ শতাংশ টিকাদানের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার উপর ছেড়ে রাখা হয়েছে। ভুয়া টিকাকাণ্ড ধরা পড়ার পর পশ্চিমবঙ্গ কার্যত বেসরকারি টিকাদান শিবিরের উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছে।
এই নিষেধাজ্ঞার অর্থ বেসরকারি উদ্যোগে টিকাদান পুরোপুরি বন্ধ নয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে টিকাদান যেমন চলছে, তেমন চলবে। দেশের নিরিখে বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে বিক্রি হওয়া টিকার পরিমাণ মোটেও কম নয়। দেশে যা টিকাদান হবে, তার ২৫ শতাংশ টিকা এই বেসরকারি সূত্রে যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই কেন্দ্রের হিসাবে প্রায় ১৮৬ থেকে ১৮৮ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন হবে। ১৮-অনূর্ধ্বদের ধরলে দেশে মোট টিকার প্রয়োজন ২৮০ কোটি ডোজের কাছাকাছি হবে। এর ২৫ শতাংশ মানে প্রায় ৭০ কোটি ডোজ। গড়ে যদি একেকটি ডোজের দাম হাজার টাকা ধরা হয়, তাহলে ৭০ হাজার কোটি টাকার একটি বিরাট ব্যবসা।
অতিমারী বিশেষজ্ঞদের একটি বিরাট অংশ করোনা অতিমারীর জন্য অর্থনীতিকে দায়ী করছে। এদের বক্তব্য, শিল্পায়ন ও নগরায়নের স্বার্থে গাছপালা ও বনাঞ্চল ধ্বংস করার কাজ চলছে। জমির দখল নেওয়া হচ্ছে। যার জেরে পশুপাখি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে এবং তাদের দেহ থেকে ‘সার্স কোভ ২’-এর মতো ভাইরাস মানবদেহে চলে এসে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। যখন কোভিডের মতো অতিমারী হল, তখন দেখা যাচ্ছে, রোগ প্রতিরোধের জন্য ওষুধ প্রস্তুত নেই। ওষুধ ছাড়া অন্য উপায়ে অতিমারী প্রতিরোধ করার যখন আমরা চেষ্টা করছি, তখন বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। এই করোনা-কালেই বিরাট ব্যবসা হয়েছে মাস্ক, স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে নানা চিকিৎসা সামগ্রীর। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, বিশাল ব্যবসার পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে প্রতিষেধক বা টিকা নিয়েও। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, একটা অতিমারীর দু’-প্রান্তেই রয়েছে বাণিজ্য। একদিকে বাণিজ্য অতিমারীর কারণ হিসাবে রয়েছে। অন্যদিকে, অতিমারী (Corona pandemic) হলে তাও একটা বিশাল বাণিজ্যে পরিণত করা হচ্ছে।
ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প বাড়াতে গিয়ে যদি আমরা অতিমারী ডেকে এনে থাকি, তাহলে এর দায় অবশ্যই রাষ্ট্রেরও। ফলে রাষ্ট্র মানুষের বিনামূল্যে টিকাদানের দায়িত্ব নেবে- এই দাবি সামাজিক ন্যায়ের দাবি। এই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা যে কোনও আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এ নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই যে, সার্বিক টিকাকরণ ছাড়া করোনা অতিমারীকে রোখা সম্ভব নয়। যতক্ষণ না পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনা যাবে, ততক্ষণ এই ভাইরাসকে কোনওভাবেই নির্মূল করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন প্রায় ৮০০ কোটি হতে চলেছে। এই ৮০০ কোটি জনসংখ্যার এখনও পর্যন্ত খুব অল্প অংশকেই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ৮০০ কোটি জনসংখ্যার সিংহভাগ বাস করে অনুন্নত বিশ্বে। এই অংশে টিকা দেওয়া কিছুটা দায়িত্ব উন্নত বিশ্ব গ্রহণ করেছে। যদিও তা মোটেই যথেষ্ট নয়। এখনও বিশ্বের যত সংখ্যক মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস বেঁচে রয়েছে, তা মোটেও কম নয়। বিশাল সংখ্যক মানুষের দেহে ভাইরাস বেঁচে থাকার অর্থই হল, তা ক্রমাগত নিজের রূপ বদলে টিকে থাকার চেষ্টা চালাবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভারত একটি ন্যায্য দাবি তুলেছে। এই দাবিটি হল, বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাগুলি যে-টিকা তৈরি করেছে, তার পেটেন্ট যেন তারা ধরে না রাখে। পেটেন্ট না নিলে উন্নয়নশীল বিশ্বের বহু সংস্থা টিকা উৎপাদন করে তা পৌঁছে দিতে পারবে বিশ্বের দরিদ্র জনগণের কাছে। ভারতের এই দাবিকে আমেরিকা সমর্থন করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মতি মেলেনি। ফলে বোঝা যাচ্ছে না, ভারতীয় টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির টিকা উৎপাদনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে কি না। যদি ‘ডব্লিউটিও’ টিকার ক্ষেত্রে পেটেন্ট তুলে নেয়, তাহলে ভারতীয় টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির হাতে বিরাট দায়িত্ব এসে বর্তাবে। সেক্ষেত্রে এমন ব্যবসায়িক নীতি নিয়ে চললে হবে না।
অতিমারীর সুযোগে ভারতীয় ওষুধ শিল্পের মালিকরা তাদের সম্পদ কোটি কোটি টাকা বাড়িয়েছে। লকডাউন এবং কোভিড (COVID-19) অতিমারীতে যেমন দেশের অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের চাকরি গিয়েছে, তেমনই দেশে বহু কোটিপতিরও জন্ম হয়েছে। বহু শিল্পোদ্যোগীর আয় কোটি কোটি টাকা বেড়েছে। এই জায়গায় প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপের। সরকার যদি এই পরিস্থিতিতে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেয়, তাহলে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় না। ভারতে সেই জিনিসটাই ঘটে চলেছে। কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আমাদের সামনে বহু নিদর্শন রয়েছে, যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে অন্যায়ভাবে কোভিড আক্রান্তরা আর্থিক শোষণের শিকার হয়েছে।
টিকার ক্ষেত্রে কেন বেসরকারি সংস্থাকে ২৫ শতাংশর ময়দান ছেড়ে দেওয়া হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। বেসরকারি টিকাদান শিবিরের উপর কঠোরতম নিয়ন্ত্রণ চাপানোর যে-সিদ্ধান্ত রাজ্য নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। অন্য রাজ্যেরও উচিত এই উদাহরণ অনুসরণ করা। এতে একদিকে যেমন ভুয়ো টিকাদান শিবিরের সম্ভাবনাকে এড়ানো যাবে, তেমনই টিকা নিয়ে ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলি যে টিকাদান শিবিরগুলি করছে, সেগুলিতে টিকার দামের ক্ষেত্রে কোনও নিয়ন্ত্রণ-ই দেখা যাচ্ছে না। একান্তই যদি কেন্দ্রকে টিকার কিছুটা বেসরকারি হাতে রাখতে হয়, তাহলে তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। অতিমারী নিয়ে এবার ব্যবসা বন্ধ হোক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.