Advertisement
Advertisement
Book Fair

ধুলোমুঠি ক্ষয়ক্ষতি

বর্তমানে বাংলার ৩০টি জেলার প্রতিটিতে একটি করে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

Govt must increase aid to book industry in West Bengal | Sangbad Ptratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:January 6, 2023 1:42 pm
  • Updated:January 6, 2023 1:42 pm

সরকারি উদ্যোগ ও আর্থিক আনুকূল্যে বর্তমানে বাংলার ৩০টি জেলার প্রতিটিতে একটি করে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেগুলি ‘জেলা বইমেলা’ নামে পরিচিত। এছাড়া, ব‌্যক্তিগত বা বেসরকারি উদ্যোগে তো অসংখ‌্য বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়-ই। কিন্তু কার্পেটের তলার দগদগে দাগগুলি কতদিন আর উপেক্ষিত থাকবে? কলমে সুগত চক্রবর্তী

শারদোৎসবের মরশুম শেষ হলেই বাংলা সাহিত‌্যপ্রেমী পাঠকের নতুন উৎসব শুরু হয়- বইমেলা। এমন অনেক বাংলা সাহিত্যের পাঠক আছে- যাদের বলতে দেখা যায় যে, তাদের কাছে দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর চেয়েও বড় উৎসব বইমেলা। নভেম্বর মাস থেকে সারা রাজ্যেই শুরু হয়ে যায় অসংখ‌্য ছোট ও বড় বইমেলার প্রস্তুতি। কলকাতা বইমেলা, বলা বাহুল্য, সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বইমেলা। সরকারি উদ্যোগ ও আর্থিক আনুকূল্যে বর্তমানে বাংলার ৩০টি জেলার প্রতিটিতে একটি করে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেগুলি ‘জেলা বইমেলা’ নামে পরিচিত। এছাড়া, ব‌্যক্তিগত বা বেসরকারি উদ্যোগে তো অসংখ‌্য বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়-ই। বাংলা সাহিত্যের জন‌্য সুখবর- এই ধরনের বইমেলার সংখ‌্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Advertisement

রাজ‌্য সরকার ২০২২ থেকে জেলা বইমেলাগুলোর জন‌্য সরকারি অর্থ ৩ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা করেছে। বই কেনার জন‌্যও রাজ‌্য সরকার বিভিন্ন ক‌্যাটেগরির গ্রন্থাগারকে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। ২০২২ সালের হিসাবটা এরকম-জেলা গ্রন্থাগারকে দেওয়া হয় ৩৫ হাজার টাকা, মহকুমা/ টাউন গ্রন্থাগার পায় ১৩ হাজার টাকা, গ্রামীণ ও প্রাথমিক/ পুস্তক গ্রন্থাগার পায় ১০ হাজার টাকা। স্টল ভাড়াও রাজ‌্য সরকার ঠিক করে দেয়। একটি ১০০ বর্গফুট স্টলের জন‌্য প্রকাশক/ পুস্তক-বিক্রেতার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। স্টলের আয়তন অনুপাতে টাকার অঙ্ক বাড়ে। সাধারণত ৬৫-৭০টি স্টল হয় এই ধরনের জেলা বইমেলায়। কিছু নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারের তরফে- যেমন, ‘বাংলা সহায়তা কেন্দ্র’-র একটি স্টল রাখতে হবে, যাতে বইমেলায় আগত পাঠকরা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে অবগত হতে পারে। ইংরেজি বইয়ের জন‌্য তিনটি স্টল বরাদ্দ রাখতে হবে; আর সাহিত‌্যসভা, ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে আলোচনা সভা এসব থাকবে। সাধু পদক্ষেপ। কিন্তু বিভিন্ন বইমেলায় ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তার নিরিখে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরতে চাই।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কোন পথে স্বর্গাদপি গরীয়সী হবে ভারত, ২০২৩ দেবে কি সন্ধান?]

জেলা বইমেলায় স্টল পাওয়ার জন‌্য প্রথম কাজ হল- ‘পাবলিশার্স অ‌্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’-এর কাছে আবেদন করা। এখানে একটি বড়সড় সমস‌্যা রয়েছে। ধরুন, প্রায় ২০০ প্রকাশক/ পুস্তক-বিক্রেতা জেলা বইমেলায় অংশ নেওয়ার জন‌্য আবেদন করল, এবং তারা সবাই ৩০টি জেলায় যেতে চায়। এবার যেখানে বইমেলাগুলোয় স্টলের সংখ‌্যাই ৭০ মতো বা তার আশেপাশে, সেখানে ২০০ প্রকাশককে স্টল দেওয়া যাবে কী করে? অথচ, বাংলার ছোট বা মাঝারি প্রকাশকদের সারা বছরের বিক্রিবাটার জন‌্য সবচেয়ে বড় ভরসা এই নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হওয়া বইমেলাগুলি। এবার ধরুন, স্টল মিলল, তারপরের সমস‌্যা হল- যথেষ্ট পরিমাণে বই বিক্রির অভাব। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় রিটেল সেলের পরিমাণ বেশ কম। মোবাইল ও ইন্টারনেটের যুগে মানুষের মুদ্রিত বইপড়া এমনিতেই কমে যাচ্ছে, যা জেলায়-জেলায় আরও বেশি।

এবার, স্বাভাবিকভাবে তাদের ভরসা করতে হয় গ্রন্থাগারগুলির উপর। কিন্তু গ্রন্থাগারগুলি সরকার থেকে যে-পরিমাণ আর্থিক সাহায‌্য পায়, তা বই কেনার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বহু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের বক্তব‌্য থেকেই এটি জানা যায়। গ্রন্থাগারগুলিকে ‘টার্গেট’ বেঁধে দেওয়া হয় যে, তাদের কমপক্ষে ৩০টি স্টলে বই কিনতে হবে। এই নিয়ম মানতে গিয়ে এমন সব বই কিনতে হয়, যা কোনওমতেই পাঠকপ্রিয় নয়। অনেক ছোটখাটো প্রকাশক আছে, যারা একদম নতুন বা নামডাকবিহীন লেখকের বই লেখকের টাকাতেই প্রকাশ করে। এসব বই যখন গ্রন্থাগারগুলি কিনতে বাধ‌্য হয়, তখন প্রধান সমস‌্যা দেখা দেয়- তাদের সদস‌্য-পাঠকরা এসব বই পড়তেই চায় না, তুলনায় খ‌্যাতিমান লেখকের লেখা বই-ই পড়তে চায় তারা। এদিকে, সেগুলি কিনতে-কিনতে যখন তারা কোনও প্রথম সারির প্রকাশকের স্টলে পৌঁছয়, তখন তাদের হাতে আর পর্যাপ্ত টাকা থাকে না, যা দিয়ে তারা কোনও খ‌্যাতিমান বা প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই কিনবে। বর্তমানে সমস্ত জিনিসের মূল‌্য ক্রমবর্ধমান, সেক্ষেত্রে বইপত্রের মূল‌্যও যে বাড়বে, সন্দেহ নেই। আর, বড় প্রকাশকদের বইয়ের মূল‌্য চিরকাল ছোট প্রকাশকদের বইয়ের চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বেশি। ‘রিটেল’ বা খুচরো বিক্রির ক্ষেত্রেও প্রকাশকদের যে সমস‌্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা হল– এখনও অধিকাংশ জেলার পাঠকই স্টলে এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রবীণ বা প্রয়াত কিংবদন্তি লেখক-লেখিকার বই-ই খোঁজ করে বা কেনে। এসব প্রবীণ লেখক ছাড়াও বর্তমানে নবীন বা গত ১০-১৫ বছর লিখে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন লেখকের সংখ‌্যাও কিন্তু কম নয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীতে এসব লেখকের গল্প-উপন‌্যাসের অাধিক‌্য দেখা যায়, এবং পাঠক-মহলে জনপ্রিয়ও হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে এটা স্বীকার করতেই হচ্ছে, সোশ‌্যাল মিডিয়ার বাইরের একটা বড় অংশের পাঠকের কাছে এসব লেখক-লেখিকার মধ্যে দু’-চারজন ছাড়া বাকিরা সেভাবে পৌঁছতে পারেননি। কলকাতা বইমেলায় এঁদের বই বেশ সন্তোষজনক পরিমাণে বিক্রি হয়। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলা বা পরিষ্কারভাবে বললে, কলকাতার নিকটবর্তী জেলাগুলো ছাড়া, পাঠক এখনও প্রবীণ লেখক-লেখিকার বই-ই বেশি কেনে। হয়তো এজন‌্য পত্রপত্রিকাগুলোর মালিকপক্ষ খানিকটা দায়ী। কারণ, কলকাতার দূরবর্তী জেলাগুলোয় এখনও বড় হাউসগুলোর পূজাবার্ষিকী-ই মূলত পৌঁছয়। নতুন বার্ষিকী, সোশ‌্যাল মিডিয়ায় যা বহুল প্রশংসিত, তা সাধারণত কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া বা কলকাতা নিকটস্থ এলাকায় পাওয়া যায়। ইদানীং অবশ‌্য অনলাইনে কিছু দূরবর্তী জেলায় যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, জেলার একটা বড় অংশের পাঠক এখনও অফলাইনে বই কিনতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।

ছোট প্রকাশকরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জেলা বইমেলায় ব‌্যবসার দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ, যথেষ্ট পরিমাণে বিক্রি নেই, রিটেল সেল প্রায় নেই, গ্রন্থাগারগুলিও এতগুলো স্টল ‘কভার’ করে বই কিনতে গিয়ে কোনও স্টলে ১০০/ ২০০/ ৫০০ টাকার বই কিনতে বাধ‌্য হয়। ধরুন, একজন প্রকাশক ৭ দিনের মেলায় ২০টি গ্রন্থাগারকে ২০০-৫০০ করে বই বিক্রি করল। তাহলে তার বই বিক্রির টাকা দাঁড়াল ৪,০০০-১০,০০০। আর রিটেল সেল যদি গড়ে প্রতিদিন ২,০০০ করেও হয়, তাহলে ১৪,০০০-১৫,০০০। তাহলে মোট বিক্রি ২০,০০০-এর মধ্যে। অন্যদিকে তাকে স্টল ভাড়া কমপক্ষে দিতে হবে ৩,৫০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল আলাদা। নিজেদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, বই পরিবহণের খরচ- এসব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে হয়তো এর চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী হবে? সেই প্রকাশক তার পরের বছর সেই জায়গায় বা জেলার মেলায় অংশ নিতে আর উৎসাহী হবে কি?

ফলস্বরূপ, একটা বড় অংশের পাঠক, যারা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া বা কলকাতা বইমেলা যেতে পারে না, তারা বঞ্চিত হবে, কারণ তাদের ভরসা জেলার মেলাগুলো। এরপর আছে স্থান নির্বাচন। নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলা ছাড়া অধিকাংশ জেলাতেই জেলা বইমেলা জেলার সদর শহর ছাড়াও মহকুমা বা গ্রামীণ এলাকায় বছর বছর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হয়। জেলা প্রশাসনের যুক্তি হল, এতে বইমেলার প্রসার ঘটবে। বেশ, ভাল যুক্তি। কিন্তু, এটা করতে গিয়ে বইয়ের বিক্রি আরও কমে যায়, কারণ, প্রথম কথা সদর শহরে যাতায়াতের যোগাযোগ ব‌্যবস্থা যতটা সহজ, বাইরের এলাকাগুলোয় কিন্তু যোগাযোগ ব‌্যবস্থা অপ্রতুল। যার ফলে জেলার একটা বড় অংশের গ্রন্থাগার/ পাঠক/ ক্রেতা সেখানে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। তাছাড়া, এসব গ্রামীণ এলাকায় জনসংখ‌্যাও বেশ কম। তার মধ্যে আরও কম শতাংশের মানুষ বইমেলায় আসে। এরপর তো কিছু সাধারণ বহুচর্চিত অভিযোগ আছেই। যেমন- বইয়ের স্টলের চেয়ে ফুড স্টলে ভিড় বেশি; সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দর্শক বেশি, কিন্তু বুক স্টলে ক্রেতা নেই ইত‌্যাদি। এছাড়া, আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল, অনেক জেলা বইমেলার আয়োজকরাই ঠিকভাবে বইমেলার প্রচার করে না। সরকারি টাকা আসছে, খরচ করতে হবে, অতএব যে হোক করে একটা বইমেলা করে দেওয়া। এই মনোভাবের জন‌্য অনেক পাঠক জানতেই পারে না যে, জেলায় সরকারি উদ্যোগে বইমেলা হচ্ছে। ব‌্যতিক্রম অবশ‌্যই আছে, কিন্তু তা খুব সামান‌্য।

তাই সরকারের কাছে আবেদন, কিছু সদর্থক পদক্ষেপ করা হোক, গ্রন্থাগারগুলোকে বই কেনার বরাদ্দ অর্থ আরও বাড়ানো হোক, বইমেলা শুরুর অন্তত একমাস আগে থেকে ব‌্যাপকভাবে প্রচার করা হোক। সোশ‌্যাল মিডিয়াকে ব‌্যবহার করা যেতে পারে, যেহেতু এটা এই মুহূর্তে অত‌্যন্ত শক্তিশালী মাধ‌্যম। এতদ্‌ভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, ব‌্যানার, পোস্টার ইত‌্যাদির মাধ‌্যমে প্রচার সব জেলায় বাধ‌্যতামূলক করা হোক। আর, বইমেলার উদ্বোধন করানো হোক একজন সাহিত‌্য জগতের মানুষকে দিয়ে। অধিকাংশ জেলায় দেখা যায়, এই কাজটি স্থানীয় কোনও হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা, বিধায়ক, সাংসদকে দিয়ে করানো হয়। এবং যার
ফলে অনুষ্ঠান মঞ্চে রাজনৈতিক দলের বড়-মেজ-ছোট নেতাদের দাপাদাপি খুব দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে।

নেট-অধ্যুষিত যুগে মুদ্রিত বই পড়া বা কেনায় যে ভাটার টান দেখা যাচ্ছে, এর থেকে পাঠককে বইমুখী করে তুলতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ- দু’ভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, তবেই হাসি ফুটবে ছোট প্রকাশক বা ক্ষুদ্র বই-বিক্রেতার মুখে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]

[আরও পড়ুন: অরুণাচলে গালওয়ান মডেলের পুনরাবৃত্তি, নতুন নাট্যমঞ্চ তৈরি করে কী বার্তা চিনের?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ