সুতীর্থ চক্রবর্তী: পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল নিঃসন্দেহে লোকসভা ভোটের আগে সবচেয়ে স্বস্তি দিল দেশের আঞ্চলিক দলগুলিকে। কর্ণাটক বিধানসভার ফলে যে প্রবণতাটি দেখা গিয়েছিল, সেটিই বজায় রইল পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলে। ভারত ‘কোয়ালিশন রাজনীতি’-র যুগ থেকে সরে আসছে বলে রাজনীতিতে যে একটি নতুন ধারণা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলের পর তা আর জোর দিয়ে বলা সঠিক হবে না।
আমেরিকার মতো আমরা একটি দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৌঁছাব বলে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁদেরও আপাতত সেসব মুলতবি রাখতে হবে। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির কঠোর বাস্তব হল, মানুষের সমর্থনের ঝোঁক ফের আঞ্চলিক দলগুলির প্রতি। যেখানে বিশ্বাসযোগ্য আঞ্চলিক দলের অস্তিত্ব নেই, সেখানে জনগণ সর্বভারতীয় দলের প্রতি আস্থা দেখাচ্ছে। কিন্তু যেখানে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানে মানুষের সমর্থনের প্রবণতা তাদের দিকেই।
[তবে কি অবলুপ্তির পথে আন্দামানের প্রাচীন সেন্টিনেলিজরা?]
পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলে সুস্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সর্বভারতীয় দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক দলের প্রতি। তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী। ফলে এই দুই রাজ্যে তারা অনায়াসেই ভোটে জিতেছে। দু’ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক দলের জয় বড় ব্যবধানে। অর্থাৎ এই দুই রাজ্যের মানুষ ইতিবাচক দৃষ্টিতে আঞ্চলিক দলের প্রতি নির্ণায়ক ভোট দিয়েছে। পক্ষান্তরে, গো-বলয়ের তিন রাজ্যে মানুষের সমর্থন কিন্তু নির্ণায়ক নয়। এমনকী, ছত্তিশগড়ের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে বিজেপির লড়াই হয়েছে, সেখানে কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছে। অথচ ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। অর্থাৎ ছত্তিশগড়ে যদি কোনও শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য আঞ্চলিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকত তাহলে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন এইভাবে বর্ষিত নাও হতে পারত। ভোটের সামান্য আগে অজিত যোগী কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তিশগড়’ করেন। তাঁরা পাঁচটি আসনে জিতেছেন। এর মধ্যে চারটিতেই তাঁরা হারিয়েছেন বিজেপিকে। এমনকী মারওয়াহি কেন্দ্রে যোগী নিজেও জিতেছেন বিজেপিকে হারিয়ে। যোগীর জোট সঙ্গী ছিল ‘বহুজন সমাজবাদী পার্টি’। তারা দু’টি আসনে জিতেছে। তার মধ্যে একটিতে তারা হারিয়েছে বিজেপিকে। এছাড়া আরও দু’টি আসনে তারা বিজেপির কাছে অল্প ভোটে হেরে দ্বিতীয় হয়েছে। কম সময়ের মধ্যে যোগীর দল আঞ্চলিক দল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তবুও দেখা যাচ্ছে যেখানে তারা শক্তিশালী, সেখানে কিন্তু মানুষ বিজেপির বিকল্প হিসাবে কংগ্রেসের বদলে তাদেরই সমর্থন দিয়েছে। এসব আসনেই কংগ্রেস তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে।
মধ্যপ্রদেশের ভোটের ফলাফলে আঞ্চলিক শক্তির পক্ষে আরও জোরালো সমর্থন মেলে। এই রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও বিজেপির ভোট কংগ্রেসের চেয়ে ৪৭ হাজার বেশি। কংগ্রেসের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বিজেপির হেরে যাওয়ার পিছনে কারণই হল, যে-কয়েকটি জায়গায় আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, সেখানে কংগ্রেস তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে চলে গিয়েছে। যে ৭টি কেন্দ্রে বিএসপি ও অন্যান্যরা জিতেছে সেই ৭টি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ৬টিতেই দ্বিতীয় স্থানে আছে বিজেপি। অর্থাৎ এসব জায়গায় মানুষ বিজেপির ‘বিকল্প’ হিসাবে আঞ্চলিক শক্তিকে খুঁজে পেয়েছে। যখন তারা বিজেপির বিকল্প হিসাবে কোনও আঞ্চলিক শক্তিকে খুঁজে পাচ্ছে, তখন কিন্তু তারা কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে না। রাজস্থানের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি। সেই কারণে, রাজস্থানে ৫ বছর বাদে ক্ষমতায় ফেরা কংগ্রেস আর বিজেপির ভোট-শতাংশ প্রায় সমান সমান। এবং রাজস্থানে দুই বড় দলের বাইরে অন্যান্যরা জিতেছে ২৭টি আসনে। যদিও রাজস্থানের ক্ষেত্রে বাস্তব হল, নয়ের দশক থেকে এই রাজ্যে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল হয়েছে। এবারও রাজস্থানে যে সরকার বদল হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত অনেক দিন আগে থেকেই ছিল। এই রাজ্যের সব ক’টি উপনির্বাচনে বিজেপির বড় ব্যবধানে পরাজয় ঘটেছিল। তাছাড়া, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলির ভোটেও বিজেপির ধারাবাহিক পরাজয় ঘটেছিল। অথচ বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিজেপিকে মানুষ হারিয়ে দিলেও কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়। যেখানে মানুষ আঞ্চলিক দল বা অন্যান্য ছোট দলকে শক্তিশালী হিসাবে দেখেছে সেখানে তাদেরকে ভোট দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মতো রাজস্থানেও কংগ্রেস ম্যাজিক ফিগারের থেকে দু’টি আসন কম জিতেছে। এই কারণে, বিজেপির থেকে বেশি সংখ্যক আসন জিতলেও কংগ্রেস মোট ভোটপ্রাপ্তির হিসাবে এগোতে পারেনি।
অর্থাৎ পাঁচ রাজ্যের ভোটের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাচ্ছে, মানুষের আস্থা ঝুঁকে রয়েছে আঞ্চলিক দলগুলির প্রতি। সর্বভারতীয় দলগুলির প্রতি মানুষের এইভাবে আস্থা কমে যাওয়া আটের দশক থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছোট ছোট সামাজিক আন্দোলন, নানা ধরনের বৈষম্যের কারণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, তা ভাষা পাচ্ছে আঞ্চলিক দলের মধ্যে দিয়ে। নয়ের দশকে এসে আমরা বলেছিলাম, ভারতের রাজনীতি কোয়ালিশন যুগে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পাঁচ বছর আগে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লিতে ফেরত আসার পর আবার একটা ধারণা ফিরে আসছিল যে, মানুষের আঞ্চলিক দলগুলির প্রতি সমর্থন ধীরে ধীরে ধাক্কা খাচ্ছে। একমাত্রিক একটা ব্যবস্থার দিকে হয়তো আমরা ফের ঝুঁকে পড়ছি। মানুষ আবার সর্বভারতীয় দলগুলির দিকে মুখ ফেরাচ্ছে–এমন একটা তত্ত্ব বাজারে ছাড়ার চেষ্টাও হচ্ছিল। সেই ধারণা প্রথমে কর্ণাটকের বিধানসভা ভোটে এবং পরে এই পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলে বিশালভাবে ধাক্কা খেল। কর্ণাটকে সমস্ত ওপিনিয়ন পোলে বলা হয়েছিল, কংগ্রেসকে হারিয়ে সেখানে এবার বিজেপি ক্ষমতায় ফিরবে। ভোটের ফলের পর দেখা গেল, কংগ্রেস হারলেও বিজেপি কিন্তু এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসতে পারল না। কারণ, কংগ্রেসের ‘বিকল্প’ হিসাবে যেখানে মানুষ আঞ্চলিক শক্তি জেডিএস-কে পেল, সেখানে তাদেরকেই সমর্থন দিল। কর্ণাটকের মহীশূর অঞ্চলে দেবেগৌড়ার দল জেডিএস-এর ঐতিহাসিকভাবে শক্তি রয়েছে। মহীশূর অঞ্চলে দেখা গেল, মানুষের বিপুল সমর্থন জেডিএস-এর প্রতি। সেখানে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপি পাত্তা পেল না। মহীশূর অঞ্চলে ধাক্কা খাওয়ায় বিজেপি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এল না। উপরন্তু কংগ্রেসের চেয়ে আসন বেশি পেলেও মোট ভোটপ্রাপ্তির বিচারে পিছিয়ে গেল।
[অস্ত্রের বেসাতিতে ঢাকল সাংবাদিকের মরণযন্ত্রণা]
বিধানসভা ভোটের ফলের এই প্রবণতা বজায় থাকলে লোকসভা ভোটে এবার আঞ্চলিক দলগুলির জোর বাড়বে। কয়েক দিন আগে তেলেঙ্গানার শাসক দল টিআরএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কে. চন্দ্রশেখর রাওয়ের পুত্র সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, লোকসভা ভোটে যদি তাঁরা রাজ্য থেকে ১৬টি আসন জিততে পারেন, তাহলে দিল্লিতে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। ব্যাখ্যা হিসাবে তিনি বলেন, কংগ্রেস খুব ভাল করলেও লোকসভা ভোটে ৮০-৯০টির বেশি আসনে জিততে পারবে না। গো-বলয়ের তিন রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলের নিরিখে বিজেপি এখানেই গতবারের জেতা ৪৪টি লোকসভা আসন হারাতে পারে। এই প্রবণতা ধরলে বিজেপি ১৮০-১৯০টি আসন লোকসভায় পেতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলের ব্লকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। এইরকম মূল্যায়নের ভিত্তিতেই কে. সি. আর-পুত্র দাবি করেছেন, ১৬টি আসন নিয়েও তাঁরা ভোটের পর নির্ধারক শক্তি হতে পারবেন। তেলেঙ্গানায় ১৭টি লোকসভা অাসন। হায়দরাবাদ আসনটি সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দখলে রয়েছে। ফলে, টিআরএস ধরে নিচ্ছে তারা ১৬টি লোকসভা আসন জিততে পারে। কোনও কোনও আঞ্চলিক দলের নেতৃত্বের ধারণা, পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল দেখে বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস খুব ভাল করলেও ১২৫-এর বেশি কিছুতেই যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বিজেপি ১৪০-১৫০-এ আটকে গেলে কোয়ালিশন যুগে ফেরা ছাড়া কোনও গতি নেই।