Advertisement
Advertisement
Israel-Hamas War

ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভিলেন ও শিকারের আখ্যান

ভুলে গেলে চলবে না, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

Israel-Hamas war and India's position in the situation | Sangbad Pratidin
Published by: Suparna Majumder
  • Posted:October 27, 2023 6:52 pm
  • Updated:October 27, 2023 6:52 pm

নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার জন্য ভারতের কাছে ইজরায়েলের (Israel) প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার কারণ রয়েছে বইকি, হামাসের ভয়াবহতার নিন্দা করতে তো হবে, কিন্তু কয়েক দশক ধরে প‌্যালেস্তিনীয় জনগণ যেভাবে অগণিত যন্ত্রণার মধ‌্য দিয়ে যাচ্ছে, তা উল্লেখ করতে ভুলে গেলেও চলবে না। কিন্তু দেশের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্নভাবে ইসলামোফোবিক ও মুসলিম-তোষণের আখ‌্যান হয়ে উঠেছে বিশ্ব-রাজনীতির নির্যাস। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই

নিজেদের লক্ষ‌্য কায়েম করতে কংগ্রেসের প্রবণতা মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে। তাদের সাম্প্রতিকতম বিবৃতি যেমন– ইজরায়েল-হামাস দ্বন্দ্ব নিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি-র (CWC) অনুবন্ধ, যেখানে প‌্যালেস্তিনীয় অধিকারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে হামাস সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ বাদ গিয়েছে। আর তাতেই কংগ্রেসের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল বিজেপি এবং এই প্রাচীন দলটিকে ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী’ বলে অভিযুক্ত করতে না করতেই, কংগ্রেস স্পষ্ট করতে বাধ্য হয়েছিল যে, দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরপরাধ ইজরায়েলি নাগরিকদের উপর হামাসের হামলার নিন্দাও তারা করছে। তা প্রাথমিক অনুবন্ধটি নাকি একটি ‘ক্ল‌ারিকাল’ ত্রুটি ছিল, মানে লিখতে গিয়ে ভুল– যা কংগ্রেস পার্টিকে স্পষ্টভাবে বিব্রত করেছে।

Advertisement

কিন্তু বিতর্কটি নির্বাচনের মরশুমে একটি কৌতূহলের উদ্রেক ঘটাচ্ছে: বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস কীভাবে রাজনৈতিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে? ইতিহাস সাক্ষী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি বেশিরভাগই এক সুরে কথা বলে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উত্থান এবং তাঁর পেশিবহুল জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেই চিরকালীন নিয়ম বদলে দিয়েছে। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রচারাভিযান কালে, নরেন্দ্র মোদি যখন বালাকোট বিমান হামলার প্রসঙ্গ তুলে আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘ঘর মে ঘুসকর মারা’ (একদম ঘরে ঢুকে খতম করে এসেছি), তখন তিনি তাঁর পুনর্নির্বাচন প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন পাক-ভিত্তিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবস্থান। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ২৬/১১ মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার পরে মনমোহন সিং সরকার যেভাবে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়াস রেখেছিলেন, তার বিপরীতে মোদি খাড়া করেছিলেন প্রত‌্যাঘাতের আখ‌্যান।

Advertisement

Modi

গত বছরের গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের সময় তো প্রধানমন্ত্রী আরও বেশি সরাসরি ছিলেন তাঁর এহেন বক্তব্যে। ভোটারদের তিনি কংগ্রেস এবং সমমনস্ক দলগুলির সম্পর্কে ‘সতর্ক’ থাকতে বলেছিলেন এই মর্মে যে, এই দলগুলির ভোটব্যাঙ্ক যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেজন‌্যই ‘বড় সন্ত্রাসী হামলা’-র বিষয়ে এরা কুলুপ এঁটেছে মুখে। ২০০৮ সালের বাটলা হাউস এনকাউন্টারের সময় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন সন্ত্রাসীদের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখে নাকি সোনিয়া গান্ধী কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন– এমন একটি অপ্রমাণিত মন্তব‌্য করেছিলেন কংগ্রেসেরই নেতা সলমন খুরশিদ।

ব‌্যস, মন্তব‌্যটিকে আরও টেনে-হিঁচড়ে লম্বা করে ব্যবহার করল বিজেপি– কংগ্রেস সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে সংখ্যালঘুর তোষণেই মত্ত এবং দোষী। এই মর্মে, ইউপিএ সরকারের শাসনকালে, বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৯-এর মধ্যে, কংগ্রেসকে রক্ষণাত্মক দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য হাই-প্রোফাইল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডর একটি সিরিজ তুলে ধরা হয়েছিল।
অদ্ভুতভাবে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার আমলেই সন্ত্রাসবাদী এবং বিঘ্নকারী কার্যকলাপ আইন (TADA)-র মতো বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণীত হয়েছিল এবং আরও কঠোর বিধান-সহ বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (UAPA) সংশোধিত হয়েছিল। এই কঠোর আইনের আওতায় শুধু সন্ত্রাসের অভিযুক্তই নয়, এমনকী কৃষক, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ‘সন্ত্রাস সম্পর্কে উদাসীন’ অভিযোগের তকমাটি দুর্ভাগ‌্যবশত কংগ্রেসের গায়েই লেগে গিয়েছে।

কংগ্রেস নেতারা যখন বিভ্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের উরি-পরবর্তী সার্জিকাল স্ট্রাইককে ‘খুন কি দালালি’ (রক্ত নিয়ে দালালি) হিসাবে প্রশ্ন করা বেছে নিয়েছিলেন, বা বালাকোট অপারেশন নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, তখন জাতীয় নিরাপত্তার নামে পালটা বিরোধিতার চাপেই পড়তে হয়েছিল এই দলকে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসিকতাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, এমন অভিযোগের ফাঁদেও পড়েছিল দলটি।

[আরও পড়ুন: অভিভাবক হারালাম, ভাল থাকুন অমলদা]

কিন্তু সন্ত্রাস কেন্দ্রিক এই রাজনীতি তখনই কুৎসিত আকার নেয়, যখন বিশ্বব্যাপী ইসলামি সন্ত্রাসী সংস্থা এবং দেশের সহ-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যোগসূত্র আঁকতে বিভিন্নরকম উত্যক্তকারী আখ‌্যানের আশ্রয় নেওয়া হয়। ভারতীয় মুসলিমরা প‌্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু কেন তাদের ইজরায়েলে হামাসের জঘন্য হামলার জন্য বা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর বা জইশ সন্ত্রাসী আফগান তালিবান সন্ত্রাসবাদী দলগুলির ঘৃণ্য আন্তঃসীমান্ত কার্যকলাপের জন্য সম্মিলিত অপরাধ বহন করতে বলা হবে!

terrorist
প্রতীকী ছবি।

২০২১-এ যখন তালিবানরা আফগানিস্তানে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে, তখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কীভাবে এই ঘটনার নিরিখে বক্তব‌্য রেখেছিলেন মনে পড়ে? বলেছিলেন– তালিবানরা যদি কখনও ভারতের দিকে অগ্রসর হয়, তবে ‘বিমান হামলা’ প্রস্তুত আছে এবং দেশের মধ্যে ‘তালিবান’ মানসিকতা যারা পোষণ করে, তাদেরকেও একই সতর্কবার্তা আমি দিতে চাই! কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে তাদের ক্ষেত্রেও। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যদি সংখ্যালঘুদের প্রতি তোষণের অভিযোগ ওঠে, তাহলে বিজেপির ক্ষেত্রে এই অভিযোগ জায়েজ হবে যে, সন্ত্রাস নিয়ে রাজনীতি করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে একত্রিত করার জন্য তারা দোষী। এটাই ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে সম্পূর্ণ মেরুকরণের চরিত্র, যা, ধর্মকে বিভাজন এবং শাসনের জন্য ব্যবহার করে। যার ফলে, অন্য দেশের সন্ত্রাসী হামলা ঘরোয়া রাজনীতির অঙ্গ হয়ে পড়ে।

এছাড়াও, মোবাইল ফোনে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইনস্ট‌্যান্ট মেসেজিং সরঞ্জামগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ভয়াবহভাবে রিয়েল-টাইম আখ‌্যানের তরজা বেড়েছে, যা কৌশলে গণ বিভাজনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বিষাক্ত গণ বিভাজনের অন‌্যতম একটি অস্ত্র হল, ‘প্রত্যেক মুসলিম সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু প্রত্যেক সন্ত্রাসীই একজন মুসলিম।’ এই আখ‌্যানটি বারবার এবং ইচ্ছাকৃতভাবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটি সমগ্র সম্প্রদায় নিয়ে ভয় ও কুসংস্কার ছড়ানোর জন্য। বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী ইন্টারনেট যোদ্ধারা সন্ত্রাসী হামলার সময় সমস্ত মুসলিমকে শয়তান রূপে ঠাওরাতে এবং ‘সন্ত্রাস মানেই ইসলাম’ নামক একটি বিভেদমূলক আখ্যান তৈরি করতে উসকানিমূলক সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট ব্যবহার করে।

‘বুম’, একটি ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, বেশ কিছু ভারতীয় টুইটারে প‌্যালেস্তিনীয়দের মৌলিকভাবে অমানবিক হিসাবে দেখাতে সমবেতভাবে ইসলামোফোবিক ভ্রান্ত তথ‌্য প্রচার চালাচ্ছে: এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে একটি জাল ভিডিও, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, কয়েক ডজন তরুণীকে ‘যৌনদাসী’ হিসাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে এক ‘প‌্যালেস্তিনীয়’ যোদ্ধা।

পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে, এই ইন্টারনেট বাহিনী হয়তো প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে এমন বিভ্রান্তিকর তথ‌্য নিয়ে পার পেয়ে যাবে, কারণ সেখানকার আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ব্যাপক ঐকমত‌্য রয়েছে এদেশে। কিন্তু ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ অনেক বেশি জটিল। ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে, ‘মুক্ত প্যালেস্তাইন’-এর দাবি-সরবতা থেকে ভারত নিজেকে যথেষ্ট বিরত রাখলেও, সাম্প্রতিক কালে ভারত-ইজরায়েল সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গভীরতা ভারতকে এক কূটনৈতিক সংকীর্ণ অবস্থানে ঠেলে এনে দাঁড় করিয়েছে।

Israel

নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার জন্য ভারতের কাছে ইজরায়েলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার কারণ রয়েছে বইকি, কিন্তু একই সঙ্গে আরব বিশ্বে তার নতুন বন্ধুদের দিকে কোনও একতরফা মন্তব্যের তির ছুড়ে বিরোধিতা করবে কোন উপায়ে? সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব এমিরেট্‌সের মতো ব্যবসা-বান্ধব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলি মধ্যপ্রাচ্যে মোদি সরকারের সফল পৌঁছের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাহলে, ভারত কীভাবে প‌্যালেস্তিনীয় মুসলিমদের ‘ভিলেন’ ঠাওরে এবং ইজরায়েলি ইহুদিদের ‘যুদ্ধের শিকার’ তকমা দিয়ে গতানুগতিক বচন তৈরি করবে? ভুলে গেলে তো চলবে না, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই ভয়ংকর
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকৃত রাজনীতি দাবি করছে উচ্চ-ডেসিবেলের বক্তৃতার অলংকার নয়, বরং আরও শান্ত স্বচ্ছ বয়ান।

যে-কারণে, ভারতীয় রাজনীতিকদের উচিত এই বিভাজনের ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে, ভোটের মুনাফার লোভে এখান-সেখানে ঢিল না ছুড়ে আরও সতর্কবাচনে আসা, আরও সংযমী হওয়া। হামাসের ভয়াবহতার নিন্দা করতে তো হবে, কিন্তু কয়েক দশক ধরে প‌্যালেস্তিনীয় জনগণ যেভাবে অগণিত যন্ত্রণার মধ‌্য দিয়ে যাচ্ছে, তা উল্লেখ করতে ভুলে গেলেও চলবে না। ঘৃণা এবং সহিংসতা, প্রতিশোধ এবং সম্মিলিত শাস্তির এই চক্রে কোনও জয় বা পরাজয় নেই, শেষমেশ পড়ে থাকে কেবল হাজার হাজার লাশ।

পুনশ্চ স্পষ্টতই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির রেজোলিউশনের ‘খুচরো ভুল’-এর কারণে দলের মধ্যে অস্বস্তির একশেষ। এসবের মাঝে একজন তরুণ কংগ্রেস নেতা ইজরায়েল এবং প‌্যালেস্তাইন নিয়ে দলের বয়ানের এহেন দ্বিধা সম্পর্কে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন– ‘আমাদের কিছু নেতা এমন একটা সময়কালে বড় হয়েছিলেন, যখন ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা করতেন ইয়াসের আরাফাত; যদিও সেই সময় ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পূর্ণত কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এই নেতারা অতীতের নস্টালজিয়ায় বসবাস করেন এবং বর্তমান বাস্তবতায় তাঁদের মন টেকে না!’ মোক্ষম স্বীকারোক্তি। কথা হল, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি দাবি করছে, যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি যে কোনওরকম পক্ষপাতিত্বের প্রত্যাখ্যান।

[আরও পড়ুন: গাজার টান, সুর বদলাতে বাধ্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ