রাজদীপ সরদেশাই: ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদি-ই সেই রাজনীতিক, যিনি ভারতীয় রাজনীতিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। পরপর দু’বার সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে বজায় রাখলেন রাজনৈতিক প্রতাপ ও প্রভাব। এবার তাঁর ‘ধন্যবাদ’-বার্তা পাঠানোর সময়। যেসব বিষয় এবং যেসব মানুষ তাঁর এই জয়ের নেপথ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুঘটক হয়েছে, তা-ও আমরা এবার চকিতে দেখে নেব।
অমিত শাহ বিজেপির দেশব্যাপী সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বপ্নকে কোনও মূল্যে সফল করতে সর্বাপেক্ষা প্রচেষ্ট হয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনি আর কেউ নন, পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ স্বয়ং। একটা উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত পাঁচ বছরে অমিত শাহ ৯১ বার পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন। সেই রাজ্যে, যেখানে কিনা এক সময় বিজেপির কোনও আসনই ছিল না! স্বপ্ন দেখার এহেন দুঃসাহসের উৎসে যদি থাকে যুদ্ধ জয়ের কূটকৌশল, বিস্তর পুঁজি এবং বলিষ্ঠ দলীয় সংগঠন– তাহলে জয় কেনই বা অধরা থাকবে! মোদিকে পুনর্নির্বাচিত করার পিছনে তাই অমিত শাহ-র কৃতিত্বই সর্বাধিক। বিরোধী পক্ষের অনমনীয়তার উলটো বাগে দাঁড়িয়ে চতুর ও নমনীয় স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে বিহার-মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে নিজেদের জোট মেরামত করেছিলেন তিনিই। দলের প্রয়োজনে, সৌজন্যের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন ‘সাম-দান-দণ্ড-ভেদ’ শৈলীতে (যেমন বাংলাদেশি অভিবাসীদের বলেছিলেন ‘ঘুণপোকা’)। ‘ভুয়ো খবর’-এর বিস্তারের সময় নৈতিক মূল্যবোধের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন কূটনৈতিক অবস্থানেই। সহজ কথায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রবাহ থেকে চ্যুত হননি। এই অনড় মনোভাবই তো নির্বাচনে তাঁকে জেতাল।
কংগ্রেস ২০১৯-এর নির্বাচন ঠিক কবে নরেন্দ্র মোদির স্বাভাবিক জয় থেকে ঝোড়ো ‘সু-নমো’-র আকার নিল? শুনতে খানিক অবাক লাগতে পারে, কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি হল ডিসেম্বর ২০১৮-র সেই সন্ধে- বিধানসভা নির্বাচনে তিন হিন্দিপ্রধান রাজ্যে কংগ্রেস সরকার গঠন করল। প্রাগৈতিহাসিক এই দল তাদের জয়ে গা ভাসিয়ে ভাবল, মোদি-শাহ-আরএসএস মেশিনকে বিকল করার মন্ত্র বুঝি তারা পেয়ে গিয়েছে। যদি ঔদ্ধত্য না-ও হয়ে থাকে, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই নির্বাচনী ফলাফল এক ‘আত্মপ্রসন্নতা’-র ঘোর হয়ে তাদেরকে চেপে ধরেছিল। কংগ্রেস ভেবেছিল, এই ক্যারিশমাতেই সিদ্ধি আসবে। কিন্তু মজা হল, সেই ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্বের ছটাকে বিবর্ণ করতে পারেনি। কংগ্রেসের কাছে ২০১৯-ই ছিল সর্বাপেক্ষা দাগ কেটে যাওয়ার ঋতু। অবকাশ ছিল, সুকৌশলী গঠবন্ধনের মাধ্যমে ‘মোদি ফ্যাক্টর’-কে যতটা পারা যায় লঘু করার। তবে কোনওটাই তারা পারেনি। উলটে, ডিসেম্বরের পরাজয় যেন বিজেপির কাছে হয়ে উঠেছিল ‘ওয়েক আপ কল’। ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প। ‘কিষান সম্মান’-এর টাকা হাতে হাতে দেওয়া থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের জন্য সংরক্ষণ- এসব পদক্ষেপের সুবাদেই বিজেপি ফের যুদ্ধে ফেরে।
রাহুল গান্ধী প্রচারের সময় কংগ্রেস সভাপতি নিজের ভাবনায় অবিচল থাকতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিত্বেও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন দৃঢ়তা। তবে শেষ পর্যন্ত সবই জলে গেল কার্যত। রাফাল দুর্নীতি থেকে নোটবন্দি কিংবা জিএসটি- যখনই সুযোগ পেয়েছেন মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত-গোলযোগ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বটে, কিন্তু সেসবের বিপরীতে কোনও সুদিন বা সুসিদ্ধান্তের রূপরেখা দিতে পারেননি। ‘ন্যায়’ শব্দবন্ধ দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। বাস্তবে মানুষের কাছে তা রহস্যময়, আদর্শস্নিগ্ধ হয়েই রয়ে গেল। ধোপে টিকল না। এমনকী, একটা বিশাল সংখ্যার কংগ্রেসপন্থী মানুষও ‘ন্যায়’ সম্পর্কে অবহিত ছিল না। এই ব্যর্থতা যোগাযোগহীনতার, ধ্যান-ধারণাগত বোধহীনতার। সর্বোপরি, তিনি রয়ে গেলেন কূলভূষণ হয়ে, গান্ধী পরিবারের সম্পদ ও দায় হয়েই। জন্মসূত্রে তিনি কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করবেন, এ-ই দস্তুর, কিন্তু এই অবস্থান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘কামদার’ বনাম ‘নামদার’-এর ধুয়ো তুলতে আরও সুবিধে করে দিল। বিশেষত এই সময়, এই ‘তরুণ ভারত’-মস্তিষ্কের গুণগ্রাহী, সাম্রাজ্যবাদিতার নয়, সুবিধাবাদের নয়। তাদের সর্বতোভাবে আকৃষ্ট করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
আঞ্চলিক বিরোধী পক্ষ মমতা-মায়াবতী থেকে শুরু করে চন্দ্রবাবু নাইডু। এঁদের ‘অ্যান্টি-মোদিজম’ স্লোগানের আধিক্য শেষের দিকে বিশৃঙ্খল এক বিরোধিতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৭-এর মতো ‘মহা গঠবন্ধন’ কার্যকর হল না, তার অন্যতম কারণ- প্রচুর পরিমাণে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ভুল বোঝাবুঝি। তাদের স্বপ্ন এক: মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কিন্তু এই ফাঁক তাদের পরস্পরের থেকে দূরে নিয়ে গেল। দ্বিধায়-মাখা রণনীতি এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব নিয়ে কখনও যুদ্ধে নামা যায় না, বিরোধিতা তখন বিফলে যায়। যাঁরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব নিয়ে গলাবাজি করলেন, তাঁরাও সেই একই দোষে দুষ্ট হলেন নিজেদের কর্ম-কথার প্রক্ষেপণে; নিজেদের রাজ্যে সেই স্বৈরাচারিতাই তাঁরা করে গিয়েছেন। অতএব, একক মজবুত নায়কখচিত নেতার রসায়ন, ‘মহা মিলাওয়াট’-এর পাটিগণিতের হিসাব-নিকাশে ধরা পড়ল না।
মাসুদ আজহার এবং পাক—ভিত্তিক সন্ত্রাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ধারাবাহিকভাবে একজন নিশ্চিত ‘শত্রু’র খোঁজখবর করতে চেয়েছিল। ২০০২ সালে গুজরাতে জিতলেন ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ মুসলিম এবং মিয়া মুসারফকে লক্ষ্য করে, যেখানে কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল: গোধরা ট্রেন দুর্ঘটনা। ১৭ বছর পর পুলওয়ামা ও বালাকোট কাণ্ডের আগে তাঁর ফোকাসে এল জৈশ প্রধান এবং জিহাদ। পাকিস্তান-বিরোধী জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে তিনি দাবি করেছিলেন- ‘ঘর মে ঘুস কর মারা।’ এই ঘটনা ‘মজবুত’ নেতা হিসাবে তাঁকে দিয়েছে আরও জোরদার ভিত্তি, নির্বাচন হয়ে উঠেছে প্রেসিডেন্ট-সুলভ।
মিডিয়া বছরের গোড়ায় একটি টিভি নিউজ এজেন্সিকে প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যা দেখানো হয়েছিল প্রায় সমস্ত নিউজ চ্যানেলে। মাঝে অভিনেতা অক্ষয় কুমারকেও একটা সাক্ষাৎকার দেন, যা চরিত্রগতভাবে ‘অ-রাজনৈতিক’ হলেও নির্বাচন পরিকল্পনার অংশ ছিল। আর চূড়ান্ত ভোটগ্রহণ পর্বের আগের দিন তাঁর ‘আধ্যাত্মিক’ কেদারনাথ যাত্রা যেভাবে টিভিতে উঠে এল- এসবের জেরে বিরোধী পক্ষ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যেন। ২০১৯ সালের নির্বাচন ভারতের ‘সর্বাত্মক পরিকল্পিত নির্বাচন’। এখানে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল নরেন্দ্র মোদির ধুয়ো তোলার দিকেই। তা মানুষকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল এই ধারণার দিকে যে, এই ময়দানে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। একটি সমীক্ষা বলছে, এপ্রিলে জুড়ে খবর চ্যানেলগুলিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হয়েছিল ৭২২ ঘণ্টা, সেখানে রাহুল গান্ধীকে দেখানো হয়েছিল মাত্র ২৫২ ঘণ্টা। একটি টিভি চ্যানেল আবার প্রত্যেকটা ভোটের দিন প্রধানমন্ত্রীর একটানা সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে গিয়েছে; সেখানে খবর আর প্রোপাগান্ডার যে বিভেদরেখা– তা মুছে গিয়েছিল। ফেসবুক থেকে শুরু করে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ– সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরের বাস্তুতন্ত্র এই মিথে জেগে রয়েছিল যেন মোদিজি-ই সুপারম্যান। ফলে অন্যান্য আঞ্চলিক সমস্যা প্রাধান্য পায়নি। বরং পোক্ত হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর হিরোইক ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতিই ক্যামেরার লেন্স সম্মোহিত, সমালোচনার কোনও জায়গা নেই।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কমিশন যেভাবে দেশের শাসক দলের আচরণে ‘কোড অফ কন্ডাক্ট’ বারবার লঙ্ঘিত হতে দেখেও চুপ করে রইল, তার প্রতিফলন ঘটে এই সিদ্ধান্তেই যে, প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় চূড়ান্ত! স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতার ধারণা সেখানে নূ্যব্জ। উদাহরণস্বরূপ, কেন নির্বাচন কমিশন ‘নমো টিভি’-কে সম্প্রচার চালাতে দিল? কারণ, এই চ্যানেলে তো সরকারের বিজ্ঞাপন ছাড়া আর অন্য কিছু হচ্ছিল না। তদন্ত দরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কেদারনাথ যাত্রাও রাজনৈতিক নৈতিকতার বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল। কোনও নেতারই কি ভোটের আগের দিনে ভোটারদের প্রভাবিত করতে ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করা উচিত?
‘নিঃশব্দ’ ভোটার ভারতের রহস্যময় ভোটাররা বরাবর সোচ্চার ও স্পষ্ট থেকেছে তাদের আওয়াজে। বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে প্রচারাভিযানের সময় আমরা শুনেছি তাদের প্রমত্ত ‘মোদি, মোদি’ ধ্বনি- সেই চিৎকার ছিল প্রায় রুটিনমাফিক; তাদের উচ্চারণে ছিল দীক্ষাদানের গুড়গুড় মেঘ, তারা হয়ে উঠেছিল পেশিবহুল জাতীয়তাবাদ ও বিভেদের ধর্মে দীক্ষিত পলিটিক্যাল ‘আর্মি’। কিন্তু গেরুয়া-ভরসা এবং হিন্দুত্বে প্রলুব্ধ মধ্যবিত্ত মানুষদের বাইরেও আছে প্রচুর ‘ফ্লোটিং ভোটার’- এদের বলা চলে ‘নিঃশব্দ’ ভোটাদাতা- তাঁরা প্রান্তেবাসী মানুষজন। যাঁদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, প্রাথমিক চাহিদাগুলি নিশ্চিতভাবে মিটবে, তৈরি হবে সুসংহত এক সরকার। জিডিপি যতই নামুক, দেশের অর্থনীতি যতই শ্লথ হোক না কেন, বেকারত্ব যতই হোক না তীব্র, কৃষিভিত্তিক আয় যতই মুখ থুবড়ে পড়ুক; এই দেশে শৌচাগার, এলপিজি এবং কম খরচে বাসস্থান নির্মাণই ক্ষমতায়নের সংকেত। কিংবা, পাকিস্তানকে আক্রমণ ‘দেশভক্তি’-র পতাকায় যে দেশে হাওয়া লাগে, সেখানে পুনরায় এই সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী। এঁদের নিয়েই সেই ‘নবীন’ ভারত, যেখানে জাত-শ্রেণি-গ্রাম-মফস্সল-লিঙ্গ-ধর্ম নির্বিশেষে (দক্ষিণ এবং সংখ্যালঘু ছাড়া) মানুষের অদম্য উচ্চাশা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এমন বৃহৎ জয় এনে দিয়েছে।
পুনশ্চ আমাদের প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো সেলফি তুলতে ভালবাসেন। তাই তিনি নিজেকে এবং তাঁর ‘কোর টিম’—কে একখানা অভ্যর্থনা বার্তা পাঠাতেই পারেন। বালাকোট থেকে বারাণসী হয়ে কেদারনাথ– ‘টিম মোদি’ তাদের ব্র্যান্ড নির্মাণে এককণাও সুযোগ হাতছাড়া করেনি। তাঁর তিলে তিলে গড়ে তোলা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ বিরোধী পক্ষকে পঙ্গু করে দিতে আজ সফল। রাজনীতির বাজারিকরণ, সমূহ যোগাযোগ সাধন এবং নিরলস প্রচারাভিযান প্রমাণ করে দেয়, এবার তাঁর নিশ্চিন্তে শ্বাস নেওয়ার পালা। একপ্লেট আম খেতে খেতে উদযাপন করতেই পারেন নিজের এই বিপুল জয়।
[মোদির জয়ের দিন জঙ্গি দমনেও সাফল্য, নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত জাকির মুসা]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.