Advertisement
Advertisement

Breaking News

‘সীমাবদ্ধ ছুটি’র ফাঁদে ইতিহাস সংকুচিত

ত্রিপুরায় ডানপন্থী উত্থান যেমন সত্য, তেমনই সত্য তার আগের দীর্ঘ বামপন্থী শাসন।

May Day row in Tripura
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 10, 2018 10:48 am
  • Updated:November 10, 2018 10:48 am

শুভময় মৈত্র: সরকারি অফিসে যারা কাজ করে, তারা ‘হলিডে’ আর ‘রেস্ট্রিকটেড হলিডে’-র মধ্যে পার্থক্যটা খুব ভাল করে বোঝে।

সরকারি অফিসে ‘হলিডে’ মানে নির্ঝঞ্ঝাট ছুটির দিন। এদিন অফিস পুরোদস্তুর বন্ধ থাকে। এবং এই ছুটি প্রত্যেকের জন্য। আর ‘রেস্ট্রিকটেড হলিডে’ মানে অফিস বন্ধ থাকছে না, কাজ চলছে, কিন্তু কর্মীরা নিজেদের পছন্দমতো ছুটি নিতে পারবে, বা কেউ চাইলে অফিসে আসবে। ত্রিপুরায় এখন ‘রেস্ট্রিকটেড হলিডে’ ১২টি। একজন সরকারি কর্মচারী খুশিমতো এই ১২ দিনের মধ্যে যে কোনও ৪ দিন ছুটি নিতে পারে। ত্রিপুরায় যখন সিপিএম ক্ষমতায় এসেছিল, সেই ১৯৭৮ সালে, তখন থেকে মে দিবস ছিল সেখানে ‘সরকারি ছুটির দিন’। আজ সেই ছুটির ৪০ বছর পূর্তিতে, সদ্য ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার এই নিশ্চিত ছুটিকে বদলে দিয়েছে ‘সীমাবদ্ধ ছুটি’-র দিনে। ‘রেস্ট্রিকটেড’ শব্দের একটি বাংলা প্রতিশব্দ ‘সীমাবদ্ধ’। তাই বললাম ‘সীমাবদ্ধ ছুটি’-র দিন। ত্রিপুরায় আগামী ২০১৯ সালের মে দিবস ‘সীমাবদ্ধ ছুটি’-র দায়রায়। বাম-ডানের ধস্তাধস্তিতে ইতিহাস ভুলে মে দিবস কখনও ছুটির দিন, কখনও কাজের!

Advertisement

[‘নোটবন্দি’র দ্বিবার্ষিকী ও ফিরে দেখা]

Advertisement

রাজনীতিতে জনসমর্থন পেয়ে শুধু জিতলেই তো চলে না, তার সঙ্গে জেতার জোরও দেখাতে হয়। ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরায় নৃপেন চক্রবর্তী মে দিবসকে ‘ছুটির দিন’ ঘোষণা করার সময় কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসে মে দিবসের গুরুত্ব বাড়েনি মোটেও। আর এবার, দক্ষিণপন্থী চিন্তাবিদরা ভাবলেন না যে, শুধু ত্রিপুরায় সিপিএম হারলেই দুনিয়া থেকে ‘বামপন্থা’ শব্দটা মুছে দেওয়া যায় না। মে মাসের প্রথম দিনটি বিশ্ব ইতিহাসে এতটা ঠুন‌কো নয় যে কেউ সেটাকে ত্রিপুরার সীমারেখায় ঘিরে ফেলবেন।

মে দিবসে মানুষ ছুটি নেবে না কি কাজ করবে, সে বিচার মানুষের। ইতিহাসের ব্যাখ্যাও থাকে বিভিন্নরকম। সময়ের সঙ্গে তা বদলায়। গতকালের বানানো লেনিন মূর্তি কাস্তে-হাতুড়ি হাতে ভাঙতে ছোটে আগামীর মানুষজন। কিন্তু লেনিন যে জন্মেছিলেন, সেটা অবশ্যই ইতিহাসে সত্য। ঠিক তেমনই মে দিবসের যতটুকু সম্বন্ধে ইতিহাস মোটামুটি নিশ্চিত, তার বর্ণনা পেশ করার একটা প্রয়োজনীয়তা থেকেই যায়।

১৮৮৪ সালের শেষদিক থেকে ঝড় ওঠে শ্রমিক অসন্তোষের। তার দু’বছর পর ১৮৮৬-র পয়লা মে আমেরিকায় শুরু হয় দেশজোড়া আন্দোলন। অবশেষে চার তারিখের বৃষ্টিভেজা বিকেল। মিছিল করে এসে কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার মানুষ (মিছিল নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক নেই, তবে মতবিরোধ আছে মানুষের সংখ্যা নিয়ে) যোগ দেয় বিকেলের সেই সভায়। সভা চলেছিল অনেকক্ষণ। সম্ভবত শেষ বক্তা ব্রিটিশ সমাজবাদী নেতা স্যামুয়েল ফিল্ডেন। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দশটা পার করেছে। পুলিশবাহিনী এসে সভা শেষ করতে আদেশ করে সেই সময়, আর তখনই ঝামেলার শুরু। পুলিশ আগে গুলি চালিয়েছিল, না কি বিক্ষোভকারীরা প্রথমে ছুড়েছিল বোমা- সেই তর্কের দীর্ঘ অক্ষররাশি পাতা ভরিয়েছে ইতিহাসের। শোনা যায় ‘হে মার্কেট’-এর সেই বিক্ষোভে মারা গিয়েছিল অন্তত চারজন প্রতিবাদী এবং সাতজন পুলিশকর্মী। বলতে নেই, এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনার নিরিখে নিহতের সংখ্যাটা বেশ কম! আমাদের দেশের ধর্মীয় উৎসবে কিংবা রেল স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে যখন-তখন এর থেকে বেশি মানুষ মারা যায়। কিন্তু দেশটা তো আমেরিকা! বাইরে থেকে তাদের যত খুশি ‘যুদ্ধবাজ ধনতান্ত্রিক দেশ’ বলা হোক না কেন, নিজেদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে তারা যথেষ্টই সচেতন, সে ডানপন্থী ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকুন কিংবা মধ্যপন্থী ওবামা। সেই কারণেই শ্রমিকদের লড়াই বৃথা যায়নি। এই আন্দোলনকে মনে রেখে ১৯০৪ সালে আমস্টারডামের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঠিক হয় ‘পয়লা মে’ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে। তো, কোনও কিছু ঠিক হলেই সেটাকে ‘ছুটির দিন’ বলে মানতে হবে, এমন মাথার দিব্যি বিজেপিকে কেউ দেয়নি। সেই তত্ত্বেই ত্রিপুরায় মে দিবসের ছুটির সীমাবদ্ধতা।

কিন্তু মূল বিষয় তো আর বছরে আর একটা ছুটির দিন নয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বছর ১৯১৯। সেই বছরেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল: শ্রমিকদের অধিকার। দাবি করা হয়েছিল, সপ্তাহে পাঁচটা কাজের দিনের আর প্রতিদিন কাজ হবে ঠিক আটঘণ্টা। সভ্যতা তারপর এগিয়েছে প্রায় ১০০ বছর। কিন্তু পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে শ্রমিকরা অধিকার পায়নি আজও। শোষণের মাধ্যমে কর্মদক্ষতার তত্ত্ব লাগু আছে বহু বছর ধরে। আমাদের দেশেও সে কথা সত্যি। তুলনায় আমেরিকা এবং ইউরোপের এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার অনেক বেশি সুরক্ষিত, পন্থা সেখানে ডান হোক কিংবা বাম।

[ফল ঘোলাটে, উগ্রপন্থা লঘু]

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মে দিবসের ছুটি নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নিলেন, তার থেকে অনেক বেশি জরুরি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই ছোট্ট রাজ্যে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কতটা কী কাজ করছেন। সবে রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি, ফলে এখনও সময় হয়নি বিশদভাবে তাঁর অবদান বিশ্লেষণের। তবে কাজের থেকে কথার পাল্লা যে ভারী- তার কিছু প্রমাণ ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে মিলছে। ত্রিপুরার মতো রাজ্যে পরিপূর্ণ ক্ষমতা দখলের রাজনীতির এটা একপ্রকার রণকৌশল হতেই পারে। ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত উপনির্বাচনের বিরোধীশূন্য ফলাফল সেই বার্তাই দিচ্ছে।

সবশেষে আবার সেই চর্বিতচর্বণ। ত্রিপুরায় ডানপন্থী উত্থান যেমন সত্য, তেমনই সত্য তার আগের দীর্ঘ বামপন্থী শাসন। বাম আমলে কিছু কাজ হয়েছিল ত্রিপুরায়। আবার অনেক কিছু প্রয়োজনীয় কাজ হয়ওনি। মানুষ হয়তো তাই বদল চেয়েছে আরও বেশি উন্নয়নের আশায়। কিন্তু তাতে ত্রিপুরার খাতা থেকে বামপন্থীদের দীর্ঘ রাজ্যশাসনের ইতিহাস মুছে যাবে না। মনে রাখতে হবে, আজকের বিজেপি সমর্থক গতকাল ছিল বামেদের ভোটার। ফলে আগামিকাল আবার সেটা বদলাতে পারে। ভবিষ্যৎ যেহেতু অজানা, তাই বর্তমানের কর্ম ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ করতে পারে।

অতীত বদলানো যায় না। কেবল নিজের এলাকায় গায়ের জোরে বদলানো যায় অতীতের ব্যাখ্যা। মে দিবস লেখা হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ত্রিপুরায় ‘ছুটি’ হল কি হল না, তাতে বিশ্বজোড়া মে দিবসের ইতিহাস মোছার কোনও সম্ভাবনা নেই। ত্রিপুরায় ১৯৭৮-তে পাওয়া শর্তহীন ছুটি ২০১৯-এ যে শর্তাধীন হল– এর বৃহত্তর তাৎপর্য কী তার বিচারের ভার ইতিহাসের উপরই ন্যস্ত থাক বরং।

 

লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
(মতামত নিজস্ব)
[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ