Advertisement
Advertisement

Breaking News

বাহ্য স্টাইলে নিস্পৃহ, ১০০% পার্টিম্যান অন্তরে

হাওয়াই শার্ট আর চপ্পল পরে ধীর পদক্ষেপে মহাকরণের করিডর দিয়ে হাঁটতেন।

Nirupam Sen comrade by blood
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:December 25, 2018 9:49 am
  • Updated:December 25, 2018 9:50 am

সুতীর্থ চক্রবর্তী: সিঙ্গুর নিয়ে তখন উত্তাল বাংলা। মহাকরণে ‘শিল্পমন্ত্রী’ হিসাবে নিরুপম সেন নিয়মিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। সিঙ্গুরে টাটাদের রাজ্য সরকার অতিরিক্ত জমি ছাড়া আর কী সুযোগসুবিধা দিচ্ছে, সেটা সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি একদিন বলে দিলেন ‘এইসব ট্রেড সিক্রেট। সরকার ও টাটাদের মধ্যে কী গোপন চুক্তি হয়েছে তা বলা যাবে না।’ পরের দিনের সংবাদপত্রে নিরুপমবাবুর এই মন্তব্য প্রকাশিত হতেই বিরোধীদের কটাক্ষ তীব্র হল। কেন সাংবাদিকরা ‘ট্রেড সিক্রেট’ শব্দটি কাগজে লিখে দিলেন, তা নিয়ে গোসা করলেন নিরুপমবাবুও। সেই থেকে মহাকরণে তাঁর ঘরে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশও বন্ধ হয়ে গেল। মিডিয়ার কাছ থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিলেন নিরুপমবাবু।

যে ৩৪ বছর রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতায় ছিল তার একটি বড় সময় নিরুপমবাবু দল ও সরকারের প্রায় শীর্ষে থাকলেও সেভাবে প্রচারে আসতেন না। ২০০১ সালে তাঁকে সিপিএম বর্ধমান থেকে জিতিয়ে সরকারে এনেছিল মন্ত্রিসভায় দু’নম্বর ব্যক্তি করবে বলে। তখন দলের বোঝাপড়া এটাই ছিল যে, কোনও দিন সরকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর উত্তরাধিকারীর খোঁজ পড়লে সেই পদের জন্য বিবেচিত হবেন নিরুপমবাবু। দলে ও সরকারে তাঁর এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও নিরুপমবাবু বরাবর নিজেকে সংবাদমাধ্যমের আলো থেকে সরিয়ে রাখতেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে দল ও সরকারের প্রয়োজনে খোলস ছেড়ে কিছুটা বেরলেও মহাকরণের ওই ঘটনার পর আবার নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যান।

Advertisement

[‘সান্তার’ জোড়া উপহারে ফিরল শিশুর বাকশক্তি!]

Advertisement

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে রাজ্যের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। দলে তাঁর বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব পেত না। তাই রেজ্জাক মোল্লা মহাকরণে বসে রোজ সাংবাদিকদের কাছে তোপ দাগতেন বুদ্ধবাবু-নিরুপমবাবুদের প্রতি। নিরুপমবাবু মহাকরণে কখনও রেজ্জাক মোল্লার বক্তব্যের জবাব দিতেন না। কিন্তু আলিমুদ্দিনে গিয়ে বিমান বসুর কাছে ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। একবার সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে রেজ্জাক মোল্লার নিরুপমবাবুকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না।’ রেজ্জাক মোল্লার এই মন্তব্য শুনেই সাংবাদিকরা নিরুপমবাবুর কাছে প্রতিক্রিয়া নিতে ছোটেন। রেজ্জাক মোল্লা মহাকরণের লম্বা করিডরের যে প্রান্তে বসতেন, ঠিক তার উলটো প্রান্তে ছিল নিরুপমবাবুর ঘর। নিরুপমবাবু শুধু গম্ভীর মুখে শুনতেন রেজ্জাক মোল্লা কী বলেছেন। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দিতেন না। সেদিনও তাই হয়েছিল। পরের দিন রেজ্জাক মোল্লা মহাকরণে এসে বললেন, ‘আমি আর সিঙ্গুর নিয়ে কিছু বলব না।’ সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন– কী ঘটেছে? রেজ্জাক মোল্লা বললেন, ‘আপনাদের কাছে নিরুপমবাবু কোনও প্রতিক্রিয়া না দিলেও আলিমুদ্দিনে গিয়ে বিমানদার কাছে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিমানদা আমাকে মুখ খুলতে বারণ করেছেন।’ রেজ্জাক মোল্লার নীরবতা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু রেজ্জাক মোল্লার তোপের মুখে নিরুপমবাবু কখনও মেজাজ হারিয়ে সাংবাদিকদের সামনে ‘লুজ টক’ করতেন না। দীর্ঘ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে ওই একবারই ‘ট্রেড সিক্রেট’ মন্তব্য করে নিরুপমবাবু বিরোধীদের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে এইরকম ক্যাচ বুদ্ধবাবু অবশ্য হামেশাই দিয়েছেন।

প্রকাশ কারাতের ঘনিষ্ঠ নিরুপমবাবু ছিলেন একেবারে ১০০ শতাংশ পার্টিম্যান। দলের বাইরে তাঁর কোনও অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হত না। সিপিএম তাঁকে বুদ্ধবাবুর ‘উত্তরাধিকারী’ হিসাবে একসময় দেখলেও তিনি ‘জননেতা’ ছিলেন– এ কথা কোনও দিনই বলা যাবে না। সুবক্তা ছিলেন। তাই বক্তা হিসাবে রাজ্যর সব প্রান্তে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের কাছে তাঁর চাহিদা ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর সমসাময়িক সুভাষ চক্রবর্তী বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়দের যে-পরিচিতি কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তা তাঁর মোটেই ছিল না। ২০০১ সালে শিল্পমন্ত্রী হওয়ার পর প্রচারের আলোর বৃত্তে প্রথম আসেন। আলিমুদ্দিনে ক্ষমতার বৃত্তে তাঁর যে প্রভাব ছিল সেটা বাইরে কোনওভাবেই প্রকাশ পেত না। এটা নিরুপমবাবুর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। মহাকরণেও তাঁকে দেখে কখনও মনে হত না তিনি মন্ত্রিসভার দু’নম্বর ব্যক্তি। ক্ষমতায় থেকেও তাঁর ক্ষমতার প্রতি অদ্ভুত এক নিস্পৃহতা ছিল– এটাই ছিল তাঁর বাহ্য স্টাইল। হাওয়াই শার্ট আর চপ্পল পরে ধীর পদক্ষেপে মহাকরণের করিডর দিয়ে হাঁটতেন। কেউ একটা গুরুগম্ভীর প্রশ্ন করলে এমন মুচকি হাসতেন যে, মনে হত কোনও কিছুই গায়ে মাখেন না। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা শোনা যেত, শিল্পমন্ত্রী হিসাবে বণিকসভার সঙ্গে যতটা দহরম-মহরম করা উচিত, ততটা তিনি করেন না। মহাকরণে শিল্পপতিরা এলে বুদ্ধবাবুর ঘরে যেতেন। মুকেশ আম্বানি বাম আমলে যখন মহাকরণে এসেছিলেন, তখন বুদ্ধবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে খোঁজ করেছিলেন, পর্যটনমন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় কোথায় বসেন? নিরুপমবাবুর ঠিক পাশের ঘরেই বসতেন শিল্পসচিব সব্যসাচী সেন। বুদ্ধবাবুর শিল্পায়ন পর্বে সব্যসাচী সেনের ঘরেই তৎপরতা বেশি থাকত।

২০০৯ সালের পর যখন সিপিএম একের পর এক ভোটে হেরে যাচ্ছে তখন একদিন নিরুপমবাবু প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে হতাশ হয়ে বলছিলেন, ‘ঘুমিয়ে থাকলেই ভাল থাকা যায়। কাজ করতে গিয়েই ডুবতে হল।’ ৩৪ বছরের বাম শাসনের নির্যাসটা যেন সেদিন তিনি বলে দিয়েছিলেন। দলের বাইরে কথা কম বলতেন। যা বলতেন পার্টি লাইনেই বলতেন। আবার তাঁর কোনও কথাই অবাস্তব লাগত না। নিস্পৃহভাবে সত্যটা কখনও কখনও এইভাবে অবলীলায় বলে দেওয়াটাও ছিল তাঁর এক অনন্য ক্ষমতা।

[মকুবের পূর্ণিমা, তবু আশায় বাঁচে চাষা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ