Advertisement
Advertisement

শুধু গর্বিত! স্বপ্নার সাফল্যে লজ্জিত হবেন না?

স্বপ্ন দেখার দায় কি শুধু স্বপ্নাদেরই?

Only proud! why don't we be feel shamed on Swapna Barman's success

ফাইল ছবি

Published by: Subhamay Mandal
  • Posted:August 30, 2018 2:24 pm
  • Updated:August 30, 2018 2:24 pm

সরোজ দরবার: গলি থেকে রাজপথ! চমৎকার শিরোনাম হতে পারে। শিল্পসম্মত, রুচির ছোঁয়া আছে প্লাস পুরনো বাংলা সিনেমার অনুষঙ্গ। বেশ একটা শিকড়ের গন্ধ গন্ধ ব্যাপারটিও আছে। স্বপ্না বর্মনের সাফল্যে গর্বিত মুহূর্ত উদযাপনে তাই দারুণ মানানসই। বস্তুত এই সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি লেখায় ঘুরেফিরে এই উপমা এসেছেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা অন্যত্র, তা ইতিমধ্যে চোখেও পড়ল। সত্যিই তো এ আসলে প্রকারন্তরে রূপকথাই। সুতরাং যত সোনালি-রূপোলি বিশেষণ আছে, যত শব্দের কারিকুরি আছে-এই সময়েই তার বাঁধ খুলে যাওয়া আবশ্যক। আবেগের মৌচাক থেকে ঝরে পড়ুক গর্বের খাঁটি মধু। যে মেয়ে শরীরে অজস্র ব্যথা সয়ে, দাঁতের যন্ত্রণা চেপে দেশকে সোনা এনে দিল, তার জন্য হু-হু করে স্মৃতির পাতা উলটে চোখা বিশেষণের খোঁজ শুরু হবে নাইবা কেন! এবং হচ্ছেও। তাতে দোষের কিছু নেই। এমনিতেই গরিব একটা দেশ (খাতায়-কলমে উন্নয়ন নাকি চুঁইয়ে পড়ছে!) হাজারও সমস্যায় বিভ্রান্ত। প্রতিবেশী দেশ-টেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তেমন বলার মতো কিছু নয়। দেশের ভিতরও হাজারও সমস্যা। এই সন্ত্রাস, গোষ্ঠী-বিবাদ, এই মৌলবাদী, বিভাজন, ধর্ম হানাহানি-সব মিলিয়ে এ বড় সুখের সময় নয়। সত্যিই, মানুষ বড় কাঁদছে। এমন একটা দিশেহারা সময়ের মধ্যে বসবাস, যখন সূর্য উঠলেও ভাল কিছু হবে বলে বিশ্বাস হয় না। এদিকে সব ভুলে তথাকথিত শিল্প-সংস্কৃতির কিছু তেরে-কেটে-তাক ঢাক বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে। একদিকে অহংকারের চোখ ঝলসানো আলো, অন্যপিঠে বঞ্চনা আর নিপীড়নের রোজনামচা- এক অলৌকিক কয়েন ক্রমাগত টসের জন্য ঘুরে চলেছে আপামর মানুষের চোখের সামনে। হেড আর টেল মুখে বলাই সার, ঠোঁটের কোণে ঘামের নুন চেখে নেওয়া মানুষ জানে এবং বোঝে, এ জীবনে কোনও জয় তাদের করায়ত্ত নয়। ফলত রূপকথা আসলে রূপকথাই। ঠাকুমার ঝুলি সত্যিই তো আর দেখা যায় না!
এহেন ভ্যাপসা সময়ে স্বপ্না বর্মন আনেন স্বপ্নের হাওয়া। দেশটার নাম আর পাঁচজনে তো জানল। এক ওই নৈমিত্তিক বিরাট কোহলির রেকর্ড গড়া আর দু-একটা ক্ষেত্রে কয়েকজন ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন একক কৃতিত্ব ছাড়া আমাদের হাতে তো বিশেষ কিছু নেই। আমাদের অতীত আছে, নস্টালজিয়ার স্বর্ণ-সিন্দুক আছে, কিন্তু ক্রমাগত আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে যাচ্ছে বর্তমান। সেখানে স্বপ্না স্বয়ং এমন এক ঘটমান সময়, যা বাস্তব হলেও স্বপ্ন বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, যে রূপকথা এমন প্রতিবন্ধকতাকে জিতিয়ে দেয়, সে রূপকথা যত সত্যিই হোক না কেন, তাকে রূপকথা বলেই ডাকি।

[এবার একটা ঠিকঠাক জুতো দরকার, ইতিহাস গড়ে প্রতিক্রিয়া স্বপ্নার]

Advertisement

সুতরাং আসুক বিশেষণ। আবেগের রামধনু আকাশ ছুঁয়ে ফেলুক। আর আমরা ক্রমাগত আয়নার বিপরীত দিকে তাকিয়ে আত্মসুখে মগ্ন হই। এই যে জলপাইগুড়ির স্বপ্না, বাইশ বছরের স্বপ্ন দেখা স্বপ্না, তাঁর নাম কি আমি দু-দিন আগে জানতাম? জানতাম না, কারণ জানার ইচ্ছেই ছিল না, চেষ্টাও করিনি। গণমাধ্যম আমার মুখের সামনে তুলে ধরে দেখিয়েছে, ফিটনেস কীভাবে বদলে দিয়েছে কোহলিকে। কীভাবে ঝরেছে তাঁর মুখের মেদ ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেনি দু-পায়ে বারো আঙুলের যন্ত্রণা বুকে চেপে কীভাবে দিন কাটিয়েছেন স্বপ্না। কীভাবে পুরস্কারের পয়সায় সংসার চালিয়েছেন। কীভাবে স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিজেকেই ছুড়ে দিয়েছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আজ সাফল্য বলছে, সর্বস্ব উজাড় করেই ভবিষ্যতের প্রতি নিজেকে নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। কিন্তু আমরা কি তাঁর খুব খোঁজ রেখেছি? হয়তো গত এক বছরে তাঁর নাম উঠে এসেছে, কেউ কেউ একেবারে জানেন না তা-ও নয়। কিন্তু বিরাটরা যেভাবে নৈমিত্তিকতায় মিশে গিয়েছেন, স্বপ্নাকে আমরা সেভাবে আপন করে নিতে পারিনি। আজ যখন স্বপ্ন, রূপকথা, গলি থেকে রাজপথ ইত্যাদি কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছি, আসলে নিজেদের থেকেই আমরা মুখ লোকাচ্ছি। এই যে আমাদের ধনুকভাঙা পণ যে, বছরের পর বছর স্বপ্নাদের প্রতি আমরা কোনও নজর দেব না, এই যে হিমা দাসদের প্রতিবার প্রমাণ করে দেখাতে হচ্ছে তাঁরাও আছেন এবং তাঁরা অন্য অনেকের থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলে উঠছেন- এই অপরাধই আসলে বাস্তব থেকে আমাদের পালাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। ফলত এত বিশেষণের রংমশাল আসলে একরকমের এলিট ছলনা, যা স্বীকৃতির অছিলায় প্রতিবার অস্বীকার করে ওই যন্ত্রণাকে। ওই দু-পায়ে বারো আঙুলের কষ্ট, ওই না-খেয়ে থাকার দাউদাউকে আমরা কখনও স্বীকার করব না বলেই এই স্তুতির বাক্য ছোটে। প্রতিবার একই রকম। কিন্তু কোনওবার এর অন্যথা হয় না। প্রতিবার এই একই ‘যন্ত্রণা থেকে সাফল্যের রূপকথা’র স্টোরিরা আমাদের দেখিয়ে দেয়, যেন এক ক্রনিক দুর্ভিক্ষের অসুখ, অবহেলা-লাঞ্চনাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। বলা ভাল, ভাল ভাল কিছু কথা বলে দূরে সরিয়ে রেখেছি।

Advertisement

[‘জ্যাভলিনের পরই নিশ্চিত হয়ে যাই, সোনা পাচ্ছে স্বপ্না’]

‘পথের পাঁচালী’ পড়তে গিয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য খুঁজে পেয়েছিলেন গূঢ় অসুখকে-‘পথের পাঁচালী’ আমার কাছে নিয়ন্ত্রিত দুর্ভিক্ষের এক কাহিনী ,যে দুর্ভিক্ষ খুব ধীরে ধীরে, বছরে পর বছর ধরে চলে। চলতেই থাকে। এক এক করে সে শিকারও বেছে নেয়- আপাতদৃষ্টিতে সে সব মৃত্যু অসুখজনিত বলে মনে হয়, কিন্তু তারও পিছনে রয়েছে ক্ষুধা ও ক্ষুধাজনিত অপুষ্টি। খেয়াল করলে দেখব, এও লক্ষণ স্বপ্নাদের পাঁচালিতেও প্রকট। গর্বের পাশাপাশি তাই এ আমাদের লজ্জারও সময় বটে। কারণ হিমা, স্বপ্নাদের যন্ত্রণার গল্প জানাচ্ছে, এই নিয়ন্ত্রিত দুর্ভিক্ষকে আমরাই লালন করে চলেছি, সীমাহীন উদাসীনতায়। তার শিকার নিশ্চিত আছে-যারা হিমা বা স্বপ্না হতে পারেনি। এ বঙ্গে সে নমুনা নিশ্চিত বিরল নয়। কত স্বপ্নের অপমৃত্যুই তো হয়! আপাতদৃষ্টিতে যা অপমৃত্যু তা আসলে সুপরিকল্পিত হত্যাই। প্রতিবার বাহবা দেওয়ার অছিলায় আমরা এড়িয়ে যাই সে দায়ভার।

[দাঁতের যন্ত্রণা চেপেই সোনার দৌড় স্বপ্নার, আনন্দে আত্মহারা জলপাইগুড়ি]

না, এই গর্বকে খাটো করছি না। গর্বিত আমরা সকলেই। আর প্রশংসা না করার মতো মানসিক কার্পণ্য আর দুর্মতি যেন আমাদের কখনও না হয়। তবু খটকা জাগে, কেবলই প্রশংসা! কোনওদিন ওঁদের দিকে সাফল্যে জ্বলে ওঠার আগে ফিরে তাকানোর সৎসাহস আমাদের কি থাকবে না? স্বপ্ন দেখার দায় কি শুধু স্বপ্নাদেরই!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ