সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: যা হওয়ার ছিল, সেটাই হল। ‘আম আদমি পার্টি’র হাতেই আরও পাঁচ বছরের জন্য দিল্লি শাসনের ভার রাজধানীর মানুষ তুলে দিলেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেই (Arvind Kejriwal) তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী রূপে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন। বিশ্বাস করেছেন। ভরসা করেছেন। কিন্তু মাঝখান থেকে দিল্লির জলটা খুবই ঘোলাটে হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর সঙ্গে ‘সবকা বিশ্বাস’ সংযোজন করেছিলেন। দিল্লি নির্বাচনী প্রচার সেই প্রতিশ্রুতিকে শুধু পরিহাসই করেনি, অবিশ্বাসের পাশাপাশি ঘৃণা ও দ্বেষের একটা পুরু চাদরও বিছিয়ে দিল। এটা না হলেই ভাল হত।
অদূর ভবিষ্যতে এই চাদর হটবে কি না, বলা কঠিন। ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা ‘অবিশ্বাসের ঘাটতি’ বেড়েই চলেছে। ভারতের মতো এত বৈপরীত্যে ভরা দেশের পক্ষে এটা স্বস্তিদায়ক ও মঙ্গলজনক হতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি যখন নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন, তখন কিন্তু ঘৃণা ও দ্বেষের এই ভয়াবহ চেহারা ছিল না। বিজেপি জানত, দিল্লি কঠিন ঠাঁই। কিন্তু বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী কেজরিওয়ালদের হাতে তুলে দেওয়া, আর যাই হোক, অমিত শাহর অভিধানে নেই! তিনি প্রতিটি লড়াই জান-প্রাণ দিয়ে লড়েন। জেতার জন্য লড়েন। জয়ের জন্য লড়াকু মনোভাব সবসময় বজায় রাখতে চান। খেলা শেষ হওয়ার আগে হারেন না। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড হাতছাড়া হওয়ার পর দিল্লির ভোটের তাৎপর্য ও গুরুত্ব রাষ্ট্রীয় স্তরে কতখানি, অমিত শাহর তা জানা। শেষ একপক্ষ কালে দলে সেই লড়াকু মনোভাব তাই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
[আরও পড়ুন: ‘কংগ্রেসে অনেকেই হিংসে করে আমাকে’, স্ত্রী এমিলিকে চিঠিতে লিখেছিলেন নেতাজি]
ভোটের হপ্তাদুয়েক আগে বিজেপির নির্বাচনী ন্যারেটিভ এই কারণেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। ঝিমিয়ে থাকা দল চনমনে হয়ে ওঠে। কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতির পালটা হিসাবে তিনি টেনে আনেন শাহিনবাগ, দেশপ্রেম, হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ২১ বছর তাঁরা ক্ষমতার বাইরে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পরীক্ষিত কেজরিওয়ালের উলটোদিকে তাঁদের কোনও গ্রহণযোগ্য মুখও নেই। ভরসা নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
বিজেপি যে এই চেনা ছকে এভাবে কারা-নাকারা বাজিয়ে নেমে পড়বে, কেজরিওয়ালদের তা জানা ছিল না। ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’ প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শমতো কেজরিওয়াল বছরখানেক আগেই কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতের নীতি ছেড়ে দেন। নজর দেন বিজলি-পানি, সড়ক-শিক্ষা-স্বাস্থ্য, নারীসম্মানের উপর। কিন্তু মাঝপথে ন্যারেটিভ বদলে যাওয়ায় তাঁরা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েন। বিজেপির মতো ন্যারেটিভ বদলের ক্ষমতা তাঁদের নেই। বিজেপি যতই ‘যুদ্ধং দেহী’ হয়েছে, কেজরিওয়াল তাই ততই আঁকড়ে ধরেছেন নাগরিক পরিষেবা। ‘টেররিস্ট’ তকমা ঝেড়ে ফেলতেও আগ্রাসী হননি। বরং, ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটারদের বলেছেন, ‘আমি নিজেকে আপনাদের সন্তান মনে করি। আপনাদের সুখ-দুঃখে পাশে থেকেছি। আমাকে টেররিস্ট মনে হলে আপনাদের ভোট দিতে হবে না।’

কেজরিওয়ালের জানা ছিল, দিল্লির মুসলমান তাঁদেরই ভোট দেবেন। মুসলমানদের কাছে ‘বিকল্প’ নেই। হিন্দুদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তিনি তাই নাগরিক পরিষেবার বাইরে নরম হিন্দুত্বকে অল্প-বিস্তর ব্যবহার করেছেন। প্রকাশ্যে ‘হনুমান চালিশা’ পাঠ করেছেন। পরে তা টুইট করে বলেছেন, হনুমান চালিশা পাঠ তাঁকে দৃঢ়তা দেয়। প্রতি বছর দুই লাখ করে পাঁচ বছরে দশ লাখ সিনিয়র সিটিজেনকে সরকারি আনুকূল্যে তীর্থভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্কুল সিলেবাসে দেশপ্রেম পাঠ্য করবেন বলেছেন। এমনকী, গণনা শেষে জনতাকে জয় উৎসর্গ করে ‘হনুমানজি’র নাম নিলেন। বললেন, ‘আজ মঙ্গলবার। হনুমানজি আশীর্বাদ করেছেন।’ ‘ভারতমাতা কি জয়’-এর পাশাপাশি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিও দিয়েছেন। মঙ্গলবার ছিল তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন। জনতাকে সে কথা মনে করিয়ে দিতেও ভুললেন না। সংক্ষিপ্ত এই সময়ের মধ্যে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি হিন্দু এবং অতি সাধারণ এক ‘আম আদমি’।
[আরও পড়ুন: ‘দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করব’, হার স্বীকার করে মন্তব্য নাড্ডার]
মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের পর দিল্লি দূর অস্ত থাকায় বিজেপি কিছুটা অস্বস্তিতে অবশ্যই থাকবে। কিন্তু এর অর্থ অমিত শাহর প্রতিপত্তি কমা নয়। রাষ্ট্রীয় স্তরে মোদি-মাহাত্ম্য কমারও কোনও কারণ নেই। দিল্লি যে কারণে কেজরিওয়ালকে বেছে নিয়েছে, সেই একই কারণে নরেন্দ্র মোদি এখনও লোকসভা ভোটে অন্যদের ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে।
দিল্লিতে কংগ্রেস আরও দরিদ্র হল। পাঁচ বছর আগেও তারা কোনও আসন জেতেনি, এবারও না। গতবার তারা ভোট পেয়েছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। এবার তা অর্ধেক কমেছে। এই নিম্নগামিতার একটি কারণ অবশ্য রাজনৈতিক কৌশল। ভোট বিভাজন তারা চায়নি। তাদের প্রচারও ছিল প্রাণহীন।
৩৬ বছর আগে, সাংবাদিকতা করতে দিল্লি এসে কীভাবে যেন থিতু হয়ে যাই! সেই সময়, আট ও নয়ের দশকে কংগ্রেস ও বিজেপিকে দেখতাম দিল্লিকে ‘পূর্ণাঙ্গ’ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করতে। নতুন শতকের শুরুতে ক্রমেই সেই দাবি স্তিমিত হয়ে যায়। শীলা দীক্ষিত বুঝে যান, কেন্দ্রে তাঁদের দল ওই মর্যাদায় আগ্রহী নয়। দেশের ক্ষমতায় এসে বিজেপিও বুঝেছে, ‘ক্যাপিটাল স্টেট’ দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া কেন উচিত নয়। ইতিমধ্যে ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি দখল করে। কংগ্রেস ও বিজেপির ছেড়ে দেওয়া দাবি কেজরিওয়াল আঁকড়েও ধরেন। কিন্তু এবার, এই ভোটে, তাঁরাও ওই দাবিতে গলা ফাটাননি। তাঁরাও বুঝেছেন, দিল্লিকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য কেউই হতে দেবে না।
যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘নির্দেশ’ মানতে দিল্লি পুলিশ ‘বাধ্য’ নয়, জমির মালিক কেন্দ্রীয় সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা নেই নিজের সচিব পছন্দ করার, সেই রাজ্যে ৭০ সদস্যের এক বিধানসভা, মুখ্যমন্ত্রী ও ছ’জন মন্ত্রী রাখার কী প্রয়োজন? এই প্রশ্ন ‘সৌম্যদর্শন’-এ আমি আগেই তুলেছি। দিল্লির তিন পুরসভা ও তাদের মেয়ররাই নাগরিক পরিষেবা দিতে যথেষ্ট। মাথার উপর থাকছেন উপরাজ্যপাল। কী প্রয়োজন বিধানসভার অস্তিত্বের? বিপুল অর্থ অপচয়ের? এবং এত তিক্ততার? অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হ্যাটট্রিকের মুহূর্তে এই মৌলিক প্রশ্নটাই ফের বড় হয়ে উঠছে।
(মতামত নিজস্ব)