Advertisement
Advertisement

Breaking News

Samaresh Majumdar

প্রতি মিনিটে ৩-৪টি বই বিক্রি

কেবল বাংলা গদ্য লিখে এমন খ্যাতি এযুগে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

Samaresh Majumdar: End of an era as last Mohican from Bengal takes the final steps। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:May 9, 2023 1:42 pm
  • Updated:May 9, 2023 1:47 pm

এখন ‘তারকা-লেখক’ শব্দবন্ধ অক্সিমোরন এই বাংলায়। এমন ক্রান্তিকালে, বাংলার ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্‌স’, ‘তারকা-লেখক’ সমরেশ মজুমদার চলে গেলেন। আক্ষরিক অর্থে কালবেলা! লিখলেন ইন্দ্রনীল সান্যাল

সমরেশ মজুমদারকে সামনাসামনি প্রথম দেখি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িওয়ালি’ ছবিটি রিলিজ করার দিন, ‘নন্দন’-এ। দীর্ঘদেহী, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটি ফয়্যারে একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল গিয়ে কথা বলার, কিন্তু বলে উঠতে পারিনি। একটু পরে এক সুন্দরী মহিলা কবি এসে ওঁর সঙ্গে আড্ডা জমালেন। পরের দিন, স্মৃতি যদি ঠিক কাজ করে, ওঁর করা ‘বাড়িওয়ালি’-র সমালোচনা একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

Advertisement

ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০০ সালে। আর স্মৃতি ছেনে বুঝলাম, আমি সমরেশ মজুমদারকে প্রথম চিনতে শুরু করেছিলাম ‘উত্তরাধিকার’ পড়ে। আমি তখন নেহাতই ছোট। স্বর্গছেঁড়া আর জলপাইগুড়ি হয়ে কলকাতা শহর পর্যন্ত একাধিক স্থান জুড়ে, অনেকটা সময়সীমা নিয়ে, লেখা হয়েছিল অনিমেষের বড় হওয়ার এবং বেড়ে ওঠার গল্প। অনিমেষের জীবনের পরের দুই পর্ব ‘কালপুরুষ’ ও ‘কালবেলা’ এল তার কিছুকাল পরে। সেটা আটের দশক, বামফ্রন্ট বাংলার মসনদে। বাংলার জলহাওয়ায় বিপ্লব ম-ম করছে। মাধবীলতা আর অনিমেষের প্রেম নিয়ে বাঙালি পাঠিকা-পাঠকের আকুলতা ছিল দেখার মতো। আমাদের পাড়ায় দেওয়াল লিখন দেখেছি, ‘বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা’।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কসবার নার্সিংহোমে লিফট দুর্ঘটনায় মৃত্যু মহিলা চিকিৎসকের, সংকটজনক স্বামী]

সেই সময় আমি স্কুলে পড়ি। কিছুটা বোঝার বয়স হয়েছে, অনেকটাই হয়নি। কিন্তু যে-কয়েকজন লেখকের সব লেখা গপগপ করে গিলতাম, তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই সমরেশ মজুমদার। সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘সাতকাহন’ বা ‘গর্ভধারিণী’-র মতো উপন্যাস তো বটেই, দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয়-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত থ্রিলার ‘বুনো হাঁসের পালক’ পড়েছি শ্বাসরুদ্ধ করে। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের দিনগুলোয় ভোরবেলা দরজা খুলে অপেক্ষা করতাম কাগজকাকুর জন্য। রবিবারের ক্রোড়পত্র নিয়ে বাড়িতে কাড়াকাড়ি হত। এই ছিল আমাদের বাড়িতে সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে ক্রেজ!

আর পুজোসংখ্যার উপন্যাস? সেখানেও একই অবস্থা। ‘তিন নম্বরের সুধারাণী’ বা ‘তীর্থযাত্রী’-র মতো উপন্যাস পড়ে ফেলা যেত ঝড়ের গতিতে। সহজ-সরল গদ্যে তিনি মূল চরিত্রের যাত্রাপথের সঙ্গী করে নিতেন পাঠককে। নায়ক বা নায়িকার জীবনের ওঠাপড়ার গল্প সবাই চট করে আইডেন্টিফাই করতে পারতেন। মুগ্ধ না-হয়ে উপায় নেই। তাঁর উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র দেখে বিস্মিত হতে হয়! রেসের মাঠ থেকে লালবাতি পাড়া, কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন থেকে উত্তরবাংলার চা-বাগান, ফিজিওথেরাপিস্ট বা ব্যাংককের কেরিয়ারের জীবন– কী আসেনি তাঁর সীমাহীন ক্যানভাসে?

[আরও পড়ুন: ‘বিশ্বাস ছিল, রিঙ্কু ঠিক জিতিয়েই ফিরবে’, রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের পর জানালেন রাসেল]

মিলেনিয়ালরা হয়তো জানবেও না যে, টেলিভিশনে বাংলা ধারাবাহিকের যাঁরা হোতা, তাঁদের মধ্যে ‘সোনেক্স’-এর জোছন দস্তিদার এবং সমরেশ মজুমদার দুই স্তম্ভ। ‘তেরো পার্বণ’, ‘মুক্তবন্ধ’, ‘কলকাতা কলকাতা’– কত না ধারাবাহিকের কাহিনিকার তিনি। আমার মনে আছে, ‘তেরো পার্বণ’-এর একটি এপিসোডে উনি ‘লেখক সমরেশ মজুমদার’ হিসাবে অভিনয়ও করেছিলেন ছোট্ট একটি সিনে। একটি চরিত্রকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। লেখকরা যে ম্যাজিশিয়ান– সেই থেকে আমি জানি।

সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ প্রাক্‌-কোভিড জমানার এক পয়লা বৈশাখে, প্রকাশকের ঘরে। তখনই তিনি অল্পবিস্তর অসুস্থ। প্রকাশক আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন। তিনি কিছু বলেননি। আমিও টুক করে সরে যাই। ‘বড় পাপ হে’ বা ‘জন্মবৃত্তান্ত’ নামের বাঘা সব ছোটগল্পের লেখকের সঙ্গে কথা বলার সাহস হয়নি।

গত বইমেলায় সেই প্রকাশক বলেছিলেন তাঁদের স্টলে বসতে। কারণ সেই প্রকাশনী থেকে আমার একটি বই বেরিয়েছে। মোটাসোটা উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। আমি যখন পৌঁছই, তখন সেখানে সমরেশ মজুমদার ছাড়া অন্য কোনও লেখক ছিলেন না। আমি তানা-না-না করে কেটে পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু প্রকাশকের জোরাজুরিতে বসতে হল। এবং আমি প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা বসে থেকে দেখলাম বাংলা ভাষা এখনও লেখকের কীরকম কদর করে। প্রতি মিনিটে ওঁর তিন থেকে চারটি বই বিক্রি হচ্ছিল। কখনও তারও বেশি। উনি অক্লান্ত সই বিলিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার বন্ধুস্থানীয় এক চিকিৎসক দম্পতি ওঁর বই কিনে আমাকে বলল ছবি তুলে দিতে। আমার লেখক-সত্তা তখন তলানিতে। টুকটাক সই দেওয়ার ফাঁকে টিপিকাল ফ্যানের মতো মোবাইলে ওঁদের ছবি তুলে দিলাম।

এখন ‘তারকা লেখক’ শব্দবন্ধ অক্সিমোরন হয়ে গিয়েছে, অন্তত এই বাংলায়। এখন ইউটিউবার আর রিল-মেকাররা ‘স্টার’, মেগা সিরিয়ালের নায়িকা বা খলনায়িকারা ‘মেগা তারকা’। অডিও ভিজুয়াল মিডিয়া অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে প্রিন্ট মিডিয়াকে। টেক্সট বুক ছাড়া অন্য বই পড়ার প্রয়োজন ফুরচ্ছে হু হু করে। এমন এক ক্রান্তিকালে, বাংলার ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্‌স’, তারকা-লেখক সমরেশ মজুমদার চলে গেলেন।

পঁচিশে বৈশাখের সকালে একে বাংলা সাহিত্যের কালবেলা ছাড়া আর কীই-বা বলতে পারি?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ