Advertisement
Advertisement
India

কী বিচিত্র এই দেশ!

এটাই কি গণতন্ত্রের সংকট নয়?

Seven decades after independence poor are still in the bog | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:August 13, 2022 2:20 pm
  • Updated:August 13, 2022 2:20 pm

৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লা থেকে কী-কী সুখবর ঘোষণা করবেন তা অজানা। নতুন কতজন ভারতীয় ‘বিলিওনেয়র’-কে আমরা পেলাম তা জানা গেলেও অজ্ঞাত থেকে যাবে এদেশে ‘দরিদ্র’-র সংখ্যা। এটাই কি গণতন্ত্রের সংকট নয়? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

 

Advertisement

৯৬৬ সালের ১৫ আগস্ট। সবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীনতা তখন ২০ বছরও পুরনো হয়নি। সেদিন, ইন্দিরা বলেছিলেন, স্বাধীনতার সময়কার প্রবীণ নেতৃত্ব দ্রুত সরে যাচ্ছে। উঠে আসছে এক নতুন প্রজন্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য আত্মত্যাগ তাদের কাছে অজানা। ইন্দিরা উদাত্ত আহ্বান জানান, এই প্রজন্ম যাতে আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নেয়। ইন্দিরার কাছে সেদিন নতুন মন্ত্র ছিল ‘সমাজতন্ত্র’। সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এদেশ থেকে দূর করার জন্য ইন্দিরা স্লোগান দেন ‘গরিবি হঠাও।’

Advertisement

মধ্যরাতে নেহরুর ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ তো ইতিহাস। কিন্তু পরের দিন ’৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রেডিও ভাষণে ফার্স্ট সার্ভেন্ট অফ দ্য ইন্ডিয়ান পিপল শোনালেন, এক নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন। নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীদের যেসব চিঠি লিখেছেন পাতার পর পাতা, তাতে বলেন, ভারত সত্যি-সত্যি স্বাধীন হবে সেদিন, যেদিন এদেশে দারিদ্র-অসাম্য-বেকারি থাকবে না। স্বাধীনতার পরে মানুষের স্বাধীনতা লাভের উৎসাহ-উদ্দীপনা এত বেশি ছিল যে, সে সময়ে লালকেল্লা থেকে ভাষণ দেওয়ার সময় এখনকার মতো কোনও প্রতিশ্রুতি বা প্রকল্প ঘোষণা করতে হত না।

[আরও পড়ুন: বকেয়া মিটবে না, সংঘাত বাড়বে, কোন পথে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক?]

ক্রমশ স্বাধীনতার আবেদন ম্লান হতে লাগল। এখন স্বাধীনতা ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধ। ‘আবেদন’ নেই, তাই সম্ভবত চড়া মেকআপের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এখন তো দেশে স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ চলছে। স্বাধীনতা উদ্‌যাপন এক মহা উৎসব। তবে, এই উৎসবের দিনে যদি আমি প্রশ্ন করি- এ স্বাধীনতা কার স্বাধীনতা? এ স্বাধীনতায় কাদের অগ্রাধিকার রাষ্ট্রের কাছে? তবে কি আমি জাতীয় পতাকার অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হব? বাক্‌স্বাধীনতাও তো স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ রূপ। সংবিধানে প্রদত্ত এই অধিকারে কি আমি প্রশ্ন করতে পারি, কেন এখনও কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষা, সামাজিক ক্ষেত্র, নারী ও শিশুকল্যাণে বরাদ্দ মাত্র ৪ শতাংশ? কারণ, দারিদ্র না-কমলে তো সমাজের আসল রোগ সারবে না।

নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লা থেকে কী-কী সুখবর ঘোষণা করবেন জানি না। তবে মনে হচ্ছে, এদেশে বড়লোকরা আরও কত বড়লোক হচ্ছে তার তালিকা দেখতে পাব। নতুন কতজন ভারতীয় ‘বিলিওনেয়র’-কে আমরা পেলাম তা জানা যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা জানি না, এদেশে এখন ঠিক কতজন গরিব মানুষ থাকেন?

‘পরিকল্পনা কমিশন’ আগে ভারতের জাতীয় সমীক্ষা সংস্থার মাধ্যমে দারিদ্র পরিমাপ করত। এখন তো পরিকল্পনা কমিশন-ই উঠে গিয়েছে। তার বদলে এসেছে ‘নীতি আয়োগ’। নীতি আয়োগ দারিদ্রের হিসাব-নিকাশ করে না। ২০১১ সালে শেষ পাওয়া হিসাব অনুসারে, ভারতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ২১.৯ শতাংশ দরিদ্র। এর অর্থ, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন দরিদ্র। এখন আমরা ২০২২ সালের ১৫ আগস্টের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। জানি না, এখন এদেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে ঠিক কতজন দরিদ্র। তাহলে এ কি গণতন্ত্রের সংকট? ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছিলেন, এ শুধু গণতন্ত্রের নয়, জাতীয় সত্তার সংকট।

স্বাধীনতার দিবসেও যেসব স্বপ্নপূরণের নতুন নতুন জলছবি দেখানো হয় তাতে কি আমরা সত্যি-সত্যিই রাজনেতাদের বিশ্বাস করি? বিসমিল্লায় যেসব গলদ আছে তা শোধরাবে কে? ‘উন্নয়ন-উন্নয়ন’ বলে সবাই চিৎকার করছে কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি উৎপাদন, তার সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। জমির ঊর্ধ্বতম সীমা নির্ধারণ নিয়ে নেহরু তো অনেক চিঠি লিখেছিলেন। নাগপুর কংগ্রেসে প্রস্তাবও পাস হয়। কিন্তু এদেশে রাজ্যে-রাজে্য যারা সারের জন্য ভরতুকি আদায় করল, কৃষিকর দিল না, ঊর্ধ্বসীমা অবজ্ঞা করল, তারাই আজ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, বিহারের মতো রাজ্যে লক্ষ-লক্ষ একর জমি ভোগ করছে।
এদেশে বহুদিন ধরে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের উপর শাসন-শোষণ চালিয়েছে। দারিদ্রের সঙ্গে জাতপাতের সমস্যাও জড়িয়ে গিয়েছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তার অবসান অবশ্যই কাম্য। কিন্তু তার সমাধান কি তাদের ভোটব্যাংকে পরিণত করা? প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার পথে কি মানবসভ্যতা এগয়?

ভারতে বেশ কয়েক বছর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকার ছিল না। ফলে এসেছিল ‘কোয়ালিশন যুগ’। আমরা ভেবেছিলাম, কংগ্রেস সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবক্ষয়ই আসল অস্থিরতার মূল। গণতন্ত্রর জন্য চাই স্থায়ী সরকার। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি এককভাবে বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাতে মনে হয়েছিল, এবার সরকার নীতিপঙ্গুতায় ভুগবে না। স্ববিরোধী নানা ছোট-ছোট আঞ্চলিক দলের ক্ষমতা আস্বাদনের জোট গঠনের অনৈতিক আপস থাকবে না। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা কীভাবে গণতন্ত্রকে আরও ধূলিসাৎ করে দিতে পারে, গত দশ বছরে তাও তো দেখলাম আমরা। চমস্কি বলেছিলেন,
welfare state for the wealthy. পাঁচ বছর বাদে সাধারণ নির্বাচন। ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য তো থাকবেই, তারাই তো আজও ভোটের রসদদার। সরকারের জন্যই এখন মানুষ। মানুষের জন্য সরকার নয়।

নেহরু একবার কৃষ্ণ মেননকে লিখেছিলেন, কংগ্রেসের কোনও ‘বিকল্প’ নেই বলে তা দিন-দিন তা বাসি হয়ে যাচ্ছে। এখন বিজেপি সম্পর্কেও তাই মনে হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে ধ্বংস হচ্ছে বহুত্ববাদের দর্শন। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের এক বিশেষ আলেখ্য সংখ্যাগুরুবাদী জাতীয়তাবাদীদের সমাজ গড়ে তুলছে। বিকল্প নেই, তাই মানতে হবে এ অচলায়তন। ইন্দিরা গান্ধীর ‘জরুরি অবস্থা’-য় সংবিধানের বহু মৌল অধিকার রদ করে দেওয়া হয়েছিল, বিরোধী নেতা-কর্মীদের হাজারে হাজারে জেলে পোরা হয়েছিল, আদালতে যাওয়ার উপায় ছিল না। কোনওরকম প্রকাশ্য বিরোধিতার সুযোগ ছিল না। এখন শাসক ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আপাতভাবে সংবিধানের মধ্যে থেকেও টাকার লোভ দেখিয়ে, তদন্তের নামে দীর্ঘদিন বিনা বিচারে আটকে রেখে, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ব্যবহার করে বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করা হচ্ছে। এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি!

আর এই গণতন্ত্রকে বলা হচ্ছে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’। ভোট পদ্ধতি র মাধ্যমে মানুষ এক স্বৈরতন্ত্রীকে নির্বাচিত করছে। সেই স্বৈরতন্ত্রী জনকল্যাণের কথা বলছে। উত্তর-সত্য যুগে সে ‘পপুলিস্ট’ নায়ক। ‘পপুলিজম’ বা জনদরদী ভাবমূর্তির রাজনীতি কিন্তু ভারতেও নতুন নয়। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী হন। নেহরুর নেতৃত্বে সে সরকারে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ দু’পক্ষই শামিল হয়।

লিয়াকত আলি ছিলেন বড় ভূস্বামী। দিল্লি এবং মিরাটে ছিল তাঁর বিশাল সম্পত্তি। কিন্তু নিজে ধনী হয়েও সাংঘাতিক জনদরদি এক বাজেট পেশ করেন। শিল্পপতিদের উপর চাপিয়ে দেন প্রভূত কর। নেহরু-জিন্না-প্যাটেল সবাই তা মেনে নেন। সমালোচনার ঝড় ওঠে, কংগ্রেসের সঙ্গে শিল্পপতিদের ভাল সম্পর্ক বলেই নাকি লিয়াকত এমন বাজেট পেশ করেছেন। আজও এই কল্পতরু হওয়ার রাজনীতি এদেশে চলছে। অতএব নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র আর আর্থিক বৈষম্যের বৃদ্ধি। বড়লোকের ঢাক আজও, ৭৫ বছর পরেও তৈরি হয় গরিব লোকের চামড়ায়। পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির জীবে প্রেমের ও বজ্র নির্ঘোষ নিশ্চয়ই আবার শুনব। আর-একবার লালকেল্লা থেকে।

[আরও পড়ুন: নতুন ভারতে কোনও স্থান নেই দ্বিতীয় পছন্দ বা বিকল্পের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ