সমষ্টির দায়িত্ব যখন বর্তায় তখন তাঁদের সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়। নাহলে তা একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। ঠিক তেমনই সমষ্টিরও অধিকার থাকে যোগ্য-অযোগ্য বিচার করার। তাঁদের সিদ্ধান্তকে ফেলে দেওয়া যায় না। তাই নেতার অবর্তমানে যদি কেউ নিজেকে গদিতে বসার দাবিদার বলে তবে তা বিচার করার অধিকার সমষ্টিরও থাকে। কিন্তু এসব কিছুর ধারেকাছ দিয়ে যাচ্ছে না দ্রাবিড়ভূমের সাম্প্রতিক রাজনীতি। আম্মার মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ছায়াসঙ্গী শশীকলার জেলযাত্রা পর্যন্ত যে নাটক দেখল তামিলনাড়ুর মানুষ, তা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। নির্যাস ঘাঁটলেন শুভময় মণ্ডল
ক্ষমতায় যে থাকে তাঁর ঘনিষ্ঠই গদিতে আসীন হয়। এমন ঘটনা সচরাচরই দেখা যায়। যতক্ষণ তোমার হাতে ক্ষমতা আছে, তুমিই ঠিক করবে উত্তরসূরির নাম। তাতে কেউ বাগড়া দিতে পারবে না। আবার সেই ক্ষমতাধরের অবর্তমানে সেই ঘনিষ্ঠই নিজেকে গদির দাবিদার বলে হইচই শুরু করবে। খুব চেনা চিত্রনাট্য। তাতে কে যোগ্য আর কে অযোগ্য তা ঠিক করার ঔদ্ধত্য কারও থাকে না। কিন্তু ক্ষমতা থেকে আসে দায়িত্বভার। সেবেলা! সমষ্টির দায়িত্ব যখন বর্তায় তখন তাঁদের সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়। নাহলে তা একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। ঠিক তেমনই সমষ্টিরও অধিকার থাকে যোগ্য-অযোগ্য বিচার করার। তাঁদের সিদ্ধান্তকে ফেলে দেওয়া যায় না। তাই নেতার অবর্তমানে যদি কেউ নিজেকে গদিতে বসার দাবিদার বলে তবে তা বিচার করার অধিকার সমষ্টিরও থাকে। কিন্তু এসব কিছুর ধারেকাছ দিয়ে যাচ্ছে না দ্রাবিড়ভূমের সাম্প্রতিক রাজনীতি। আম্মার মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ছায়াসঙ্গী শশীকলার জেলযাত্রা পর্যন্ত যে নাটক দেখল তামিলনাড়ুর মানুষ, তা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। শশীকলা থেকে পন্নিরসেলভম, সবাই নিজেকে গদির দাবিদার বলে হইচই জুড়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের মানুষ? তাঁরা তো বানের জলে ভেসে আসেননি। তাঁদের কি কোনও মতামত থাকতে নেই। শাসকদল তাঁদের কথা ভাবেনওনি। সব নাটকের যবনিকা পড়ল যখন বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল বিদ্যাসাগর রাও শশীকলারই ঘনিষ্ঠ ই কে পালানিস্বামীকে ডেকে সরকার গঠনের নির্দেশ দিলেন। এখানেও সেই ক্ষমতাধরের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফায়দা। সম্পত্তি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর শশীর ছলাকলার অবসান হয়। তড়িঘড়ি তখন আরেক আম্মা ঘনিষ্ঠ বিদ্রোহী ওট্টাকারা পন্নিরসেলভমকে দল থেকে বহিষ্কার করে শাসকদল এআইএডিএমকে। আর পরিষদীয় নেতা নির্বাচন করে এদাপাদি কে পালানিস্বামীকে। শশীর ঘনিষ্ঠ পালানিস্বামীকে পরিষদীয় নেতা করার নেপথ্যে কার দূরদৃষ্টি কাজ করছে তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। কয়েক বছর আগে যখন একইভাবে সম্পত্তি মামলায় আদালতের রায়ে জয়ললিতাকে মুখ্যমন্ত্রীর গদি ছেড়ে জেলে যেতে হয়েছিল, তখনও একইভাবে পন্নিরসেলভমকে কার্যনির্বাহী মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করে দিয়ে গিয়েছিলেন আম্মা। পুতুল মুখ্যমন্ত্রী বললে ভুল হবে না। তিনি জয়ার অবর্তমানে তাঁর পেল্লায় সাইজের ফ্রেমবন্দি ছবি গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আম্মার জুতোজোড়া মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার বসিয়ে পাশের চেয়ারে বসতেন। ঠিক রামায়ণের ভরতের মতো। দাদা রামের পাদুকাজোড়া সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্যপাট চালানোর মতো।
(৫০ টাকা রোজে জেলে মোমবাতি বানাবেন শশীকলা)
জয়ললিতার মতোই পরিণতি হল শশীকলারও। এমজিআরের মৃত্যুর পর দলের ব্যাটন ছিনিয়ে নেওয়া থেকে সম্পত্তি মামলায় জেল যাত্রা। সবেতেই দুজনের আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য দেখল দেশবাসী। কিন্তু জয়ার মতো জনপ্রিয়তা পেলেন না শশী। ছায়া ছায়াই হয়, রক্ত-মাংসের শরীর হতে পারে না। তেমনই ছায়াসঙ্গী হলেই যে তুমি তোমার আদর্শের সবগুণ পেয়ে যাবে সে কথা কোথাও লেখা নেই। শশীও ভেবেছিলেন, আম্মার মতোই জীবন হবে তাঁর। কিন্তু এমজিআরের মৃত্যুর পর জয়ললিতা ছাড়া দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো কেউই ছিলেন না। তাই দলকে ভরাডুবির হাত থেকে টেনে তুলে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন আম্মা। কিন্তু শশীকলা? চিন্নাম্মা নিজেই এসে দাবি জুড়লেন, আম্মার ঘনিষ্ঠ তিনি। তাই তাঁকেই দলের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রবাদ আছে, যে কোনও সিদ্ধান্ত বিবেচনার মাধ্যমে নেওয়া উচিত, চাপ দিয়ে নয়। দলীয় নেতৃত্বের মগজধোলাই করে আম্মার পদে বসেন শশী। আর তাই কাল হল তাঁর। বুঝতেই পারেননি কখন অজান্তে প্রচুর শত্রু তৈরি হয়ে গিয়েছে দলের মধ্যেই। আর তাই পন্নিরকে ছেঁটে ফেলাই তাঁর সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যদি পন্নিরকে সঙ্গে নিয়ে দলের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতেন তাহলে এত সমস্যাই থাকত না। দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া নিয়ে শশীর প্রতি কোনও গন্ডগোলই বাধেনি পন্নিরের। বাদ সাধল যখন পন্নিরকে বাইপাস করে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার ছক কষলেন শশী। ব্যস, তাতেই খেপে গেলেন পন্নির। কেন বাপু? দলের সর্বময় কর্তৃী হয়েও আশা মিটল না, এবার মুখ্যমন্ত্রীর গদিও চাই? শশী পারতেন পন্নিরকে মুখ্যমন্ত্রী রেখে নেপথ্যে তামিলনাড়ুর সরকার চালাতে। ভুলিয়ে ভালিয়ে বন্যপশুকেও বাগে আনা যায়। পন্নির তো মানুষ মাত্র। কিন্তু ওই যে, ক্ষমতায় ভাগীদার রাখা চলবে না। যদি কোনওদিন বিদ্রোহ করে বসেন পন্নির। সেই ভয়েই তাঁকে ছেঁটে ফেলতে চাইলেন শশী। বিদ্রোহ করে বসলেন পন্নির। তার মাঝে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে শাপে বর হল পন্নিরের। তাঁর হয়তো গদি, দল সব গেল। কিন্তু জয়ও হল। শশীকে বসতে দেওয়া হয়নি গদিতে। এ আর কম কিসে।
এবার আসা যাক তামিলনাড়ুর কথায়। এমন একটি শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং শিল্পে উন্নত রাজ্যে এমন অচলায়তন কেন হবে৷ কেন এ পি জে আবদুল কালাম, চন্দ্রশেখরণ, বিশ্বনাথন আনন্দ, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, এ আর রহমানের রাজ্যে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, প্রশাসনে অপরীক্ষিত, গৃহবধূ শশীকলার ইচ্ছার উপর সব কিছু নির্ভর করবে? তার উপর তাঁর বিরুদ্ধে আবার কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ জেলও ঘুরে এসেছেন৷ সোজা কথায়, গণতন্ত্রের ফাঁক গলেই এই ঘটনা ঘটছে৷ বিধায়করা যদি তাঁর পাশে থাকেন, তবে মুখ্যমন্ত্রীর গদি কে আটকায়? আবার এই বিধায়কদের অধিকাংশকে নাকি তিনিই মনোনয়ন দিয়েছিলেন৷ ফলে দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা৷ এই অবস্থার জন্য রাজনৈতিক মহল অবশ্য দায়ী করছে ‘আম্মা’ জয়ললিতাকেই৷ কারণ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই পরবর্তী নেতা বা নেত্রী ঠিক করে রাখেননি৷ এক ব্যক্তি, এক দল নীতিতে এটাই বড় সমস্যা৷ অন্য কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা করা যায় না৷ কারণ করলেই তাঁর গদি উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই আম্মা জয়ললিতাও কাউকে তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে রাখেননি৷ আর তাঁর মৃত্যুর পর দল যে ভাঙবেই, তা নিয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই৷ কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়৷ আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বহু অপকর্ম করে চলেছে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ৷ সাধারণ মানুষের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না৷ আর তাই প্রস্তাব উঠেছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের৷ কেউ কেউ বলছেন, সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের ব্যবস্থা হোক, মার্কিন প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনের মতো৷ কেউ আবার বলছেন, পুরো ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন৷ কিন্তু তাতেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? কারণ দেশের রাজনীতিতে ঢুকেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি৷ নতুন ব্যবস্থা হলেই যে ‘সত্যযুগ’ ফিরে আসবে, তার কোনও গ্যারাণ্টি নেই৷ নোট পরিবর্তন হয়েছিল জাল রুখতে৷ এখন নতুন নোটও জাল৷ তাই ব্যবস্থার পরিবর্তনে কতটা সুফল মিলবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে৷ নীতি বা আদর্শহীন রাজনীতিই সমস্যার মূল৷ তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রেও তাই দেখা যাচ্ছে৷ এখানে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা আর অর্থ৷ তামিলনাড়ুতে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে৷ আগামিদিনে নয়া মুখ্যমন্ত্রী পালানিস্বামী রাজ্য রাজনীতিতে কী খেল দেখান সেই দুস্বপ্নেই রয়েছেন দ্রাবিড়ভূমের মানুষ।