Advertisement
Advertisement
Corona

সম্পাদকীয়: আমি, আপনি ও অ্যাপ

প্রযুক্তি-নির্ভরতার ফলে টিকাদান প্রক্রিয়া থেকে বহু মানুষ বাদ পড়বেন না তো?

The blend of technology in fighting corona pandemic | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 20, 2021 4:50 pm
  • Updated:May 20, 2021 4:50 pm

সুমন সেনগুপ্ত: এই মুহূর্তে যে আমরা একটা জাতীয় বিপর্যয়ে আছি, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে জীবনদায়ী ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনানো ছাড়া মানুষের হাতে আর কোনও গতি নেই। দেশের বেশিরভাগ মানুষের যখন প্রতিষেধকের প্রয়োজন, তখন জানা যাচ্ছে যে, তা বিদেশে রফতানি হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বহু মানুষ প্রথম টিকা নেওয়ার পরে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন, আদৌ ‘দ্বিতীয় টিকা’ পাবেন তো? যখন প্রয়োজন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে টিকা প্রক্রিয়াকরণের, তখন প্রধানমন্ত্রীর তরফে ঘোষণা করা হয় যে, রাজ্য সরকারগুলো নিজেদের প্রয়োজনমতো অন্যান্য দেশ থেকে টিকা কিনতে পারবে। অথচ, তা হওয়া উচিত ছিল কি? কেন্দ্রীয় সরকার প্রক্রিয়াকরণ করবে আর রাজ্য সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে এই প্রতিষেধক দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করবে।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘আত্মশাসন’ না মানাটা হবে আত্মহত্যা]

অদ্ভুত সময়ে আমরা বাস করছি! প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আমরা যেহেতু একে-অন্যকে ওষুধ, অক্সিজেন বা খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি, সরকারও ভেবে বসল যে, প্রযুক্তির সাহায্যেই যদি প্রতিষেধক দেওয়ার কাজটি করা যায়, তাহলে তো খারাপ হয় না। তাই প্রস্তাব করা হল যে, একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন লাগবে বাধ্যতামূলকভাবে, যাতে এই কাজটি সহজে সম্পন্ন করা যায় ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মানুষদের জন্য। সরকারের ধারণা, এই বয়সি বেশিরভাগ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রত্যেকে খুব সহজেই এটি করতে পারবেন। নামটাও খুব লক্ষণীয় ‘কো-উইন’। ‘কো’ অর্থাৎ একসঙ্গে, ‘উইন’ অর্থাৎ জেতা। কিন্তু, বিষয়টা যখন আনা হয়, তখন যে অনেক কিছু ভাবা হয়নি, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

Advertisement

প্রথম প্রশ্ন, এই মোবাইল অ্যাপটি কেন বাধ্যতামূলকভাবে নিতেই হবে? যখন প্রথম করোনা সংক্রমণ এই দেশে এসেছিল, তখন স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে আরও একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আনা হয়। ‘আরোগ্য সেতু’। বলা হয়েছিল, এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি নাকি ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ করে অনুসন্ধান করবে আশপাশে কোনও করোনা রোগাক্রান্ত মানুষ আছেন কি না। তারপর দেখা গেল, সেটাও কাজ করা বন্ধ করল। প্রথম থেকেই বহু মানুষ বলে আসছিলেন যে, এই ‘আরোগ্য সেতু’ আসলে মানুষকে নজরবন্দি করে রাখার জন্য সরকারের চাল। কে কোথায় যাচ্ছে, কার সংস্পর্শে আসছে, সেটা নজরে রাখাই আসল উদ্দেশ্য। সম্প্রতি, দিল্লি হাই কোর্টে উমর খালিদের জামিনের শুনানির সময়ে বিচারপতি বিনোদ যাদব তো বলেই বসলেন যে, জামিন পাওয়ার অন্যতম শর্ত হবে উমর খালিদকে তাঁর মোবাইলে ওই ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপ্লিকেশনটি নিতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে।

Advertisement

যদি গুগল করা যায় ‘ভারত’ শব্দটি লিখে, তাহলে যতটা ভারতের চেহারা দেখতে পাওয়া যায়, ততটাই ভারত গুগলের বাইরে পড়ে থাকে। ভারতবাসী মনে করতেই পারেন যে, ইন্টারনেট তাঁদের অধিকার। অথচ, এই ভারতেই সবচেয়ে বেশিদিন ইন্টারনেট বন্ধ থেকেছে, তা নিয়ে কিন্তু ভারতবাসী খুব বেশি সোচ্চার হননি। ভারতের ইন্টারনেটের স্পিড বা গতি বেশিরভাগ জায়গাতেই ধীর এবং পরিবর্তনশীল, অথচ ভারতবাসীর স্মার্টফোন কেনার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী, হয়তো বা বিশ্বে প্রথম। ভারতে এখনও মহিলাদের মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২১ শতাংশ মাত্র, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণ। সামাজিক কারণেই মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ ভারত, যেখানে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বসবাস করেন, তার এক-চতুর্থাংশের কাছে ইন্টারনেট আছে। শুধু তাই নয়, কো-উইনের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী এটাও জানা গিয়েছে যে, ৪৫-ঊর্ধ্ব যে টিকাকরণ হয়েছে তার ১৪.৪ কোটির মধ্যে কো-উইনের মধ্যে দিয়ে হয়েছে মাত্র ২.৫০ কোটি।

এমনিতেই আমাদের মতো দেশে যেখানে শিক্ষার হার কম, সেখানে ইংরেজিতে বানানো একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে খুব কিছু সুবিধা হবে? না কি এর মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু মানুষকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে? যদিও শোনা যাচ্ছে যে, হিন্দি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আনা হবে, কিন্তু তাহলেও কি সমস্যার সমাধান হবে? যেখানে ইন্টারনেটের সুবিধাই এখনও দেশের শেষ মানুষটির কাছে পৌঁছয়নি, সেখানে কেন এই পদ্ধতি নেওয়া হল? তাহলে কি ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, শহরের মানুষদের প্রতিষেধক দেওয়া হবে, আর গ্রামের মানুষেরা বিনা চিকিৎসায় প্রতিষেধকের অভাবে মারা যাবেন? দেশের নানা প্রান্ত থেকে অভিযোগ আসছে যে, বিভিন্ন রাজ্য সরকার করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির আধার নম্বর দেখতে চাইছে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য। এমন অভিযোগ আসছে যে, কোনও একজন ব্যক্তি নিজে নিয়েছেন ‘কোভিশিল্ড’ অথচ কো-উইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে তাঁর যে শংসাপত্র এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে তিনি ‘কোভ্যাক্সিন’ নিয়েছেন। তাহলে দ্বিতীয়বার নেওয়ার সময়ে তিনি কোনটি নেবেন? জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষদের অন্যতম কর্তাব্যক্তি আর. এস. শর্মা সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, আগামী দিনে মুখ চেনার পদ্ধতি দিয়ে সমস্ত প্রতিষেধক দেওয়া হবে। এই বক্তব্যে চারিদিকে শোরগোল পড়ে যাওয়ার পরে বলা হয় যে মুখের ছবি দিয়ে মিলিয়ে দেখা হবে। এই সমস্ত পদ্ধতি আসলে তথ্য জোগাড় করা ছাড়া কিছু নয়।

প্রযুক্তি দিয়ে সমস্ত কিছুর প্রতিকার যদি করা যেত, তাহলে প্রথম বিশ্বের সমস্ত দেশ প্রযুক্তিই ব্যবহার করত। যখন প্রয়োজন ভারতের সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে প্রতিষেধক দেওয়া, তখন আমাদের দেশের সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করে মানুষের তথ্য নেওয়ায় বেশি উৎসাহী। কারণ, আগামীতে এই তথ্য যদি কেউ কিনে নেয়, তাহলে যে কোনও মানুষের চিকিৎসা-সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যের অধিকারী হবে। যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলেছে যে সবজি বিক্রেতা, অটোচালক থেকে রিকশাচালক প্রত্যেককে দ্রুততার সঙ্গে টিকা দেওয়া হবে, তখন এই ধরনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কি সেখানেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না? যখন প্রয়োজন সমস্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিষেধকের ব্যবস্থা নেওয়া, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের এইরকম প্রযুক্তি-নির্ভরতার ফলে বহু মানুষ বাদ পড়বেন না তো? অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে, তিনি নিজে বা তাঁর পরিবারের প্রত্যেকে এই ‘কো-উইন’ দিয়ে নিজেরা প্রতিষেধক নিয়ে বেঁচে যাবেন, কিন্তু এই অতিমারী এমন মারণক্ষমতাশালী যাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রতিষেধক না পেলে কিছু মানুষ নিজেদের সুবিধা এবং অর্থের কারণে প্রতিষেধক নিলেও কোনও লাভ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রতিষেধক পেতে হবে। আর তা সরকারকেই দিতে হবে, বিনামূল্যে। এটাই সময়ের দাবি।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: পিকে কি বিহারের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী?]

(মতামত নিজস্ব)
লেখক বাস্তুকার
[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ