Advertisement
Advertisement
Narendra Modi

কেন্দ্র-রাজ্য সুসম্পর্ক জরুরি

আমরা যদি মনে করি, কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ মিটে গিয়েছে, তাহলে ভুল করব।

The much 'not needed' Centre-State clash, explains Jayanta Ghoshal | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 5, 2021 3:56 pm
  • Updated:June 5, 2021 3:56 pm

এখন আমরা করোনা-আক্রান্ত, ত্রস্ত, বিধ্বস্ত সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। তার মধ্যে এসেছে ঘূর্ণিঝড়। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত দেখতে হচ্ছে। এইরকম একটা অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিবাদ, মোদি এবং মমতার বিবাদ কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

টলবিহারী বাজপেয়ী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ছত্তিশগড়ের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগী এসেছেন দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। কিন্তু বৈঠকের ঠিক আগে অজিত যোগী প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের রাজ্যমন্ত্রী বিজয় গোয়েলকে বললেন, ‘আমি একা নই, আমার সঙ্গে সাত-আটজন বিধায়কও এসেছেন। তাঁরাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন।’ বিজয় গোয়েল খুব খেপে গেলেন। বললেন, ‘এমনটা হয় না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনি দেখা করছেন। প্রোটোকল আছে, তাঁর কিছু নিরাপত্তাজনিত প্রশ্ন আছে। এসপিজি-র (স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ, যারা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দেখভাল করে) ক্লিয়ারেন্স লাগে।’ অজিত যোগী তখন বললেন, ‘বেশ তবে! দেখা করতে যদি না-ই দেন, তাহলে আমরা কেউই দেখা করব না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘরের সামনে ধরনায় বসে যাব, অনির্দিষ্টকালের জন্য।’

Advertisement

[আরও পড়ুন: কোণঠাসা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের জাগরণ চাইছে বিজেপি?]

যোগী এহেন আচরণে বিজয় গোয়েল আরও অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ হলেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব তখন শক্তি সিন্‌হা, তাঁকে নিয়ে বিজয় গোয়েল গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এ কেমন কথা! এটা কোন ধরনের শিষ্টাচার? এই কি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ঐতিহ্য? প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করা হচ্ছে! তখন বাজপেয়ী স্মিত হেসে ওঁদের বললেন, ‘আরে বাপু, ওঁদের আসতেই দাও না! কী আর সাংঘাতিক তফাত হবে, যদি আরও দশজন আসে। অত্যন্ত ছোট একটা বিষয়কে অহেতুক বড় করে তোলা ঠিক না।’ ওঁরা সবাই দেখা করলেন। কোনও রাজনৈতিক বিরোধিতার ইস্যু তৈরি হল না। আর এখন? এখন আমরা করোনা-আক্রান্ত, ত্রস্ত, বিধ্বস্ত সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। তার মধ্যে এসেছে ঘূর্ণিঝড়। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত দেখতে হচ্ছে। এইরকম একটা অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিবাদ, মোদি এবং মমতার বিবাদ কি কাঙ্ক্ষিত ছিল?

Advertisement

কলাইকুন্ডাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তুলকালাম হল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন বলির পাঁঠা। আলাপন একজন সৎ, একনিষ্ঠ আমলা- যিনি শুধু কৃতী ছাত্র নন, কৃতী সাংবাদিক-লেখকও বটে। দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর সম্পর্কে কেউ কখনও কোনও অভিযোগের তর্জনী তুলতে পারেনি। কোনও দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। এমনকী, অন্য অনেক আমলার তুলনায় তিনি ঠিক ‘স্তাবক’ বলেও পরিচিত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও আমরা প্রত্যেকে দেখলাম, তাঁকে নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে কী কাণ্ড হল!

আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘটনা হয়তো একদিন অতীত হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি, কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ মিটে গিয়েছে, তাহলে ভুল করব। বিজেপি বনাম তৃণমূলের যে রাজনৈতিক লড়াই তা নবান্নে এসে আছড়ে পড়ছে। প্রশাসনিকতা এবং রাজনীতি- এই দুটো ভিন্ন বিষয়। আমলাতন্ত্র প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রশাসনিক প্রধান, আবার পশ্চিমবঙ্গেরও প্রধানমন্ত্রী। কাজেই রাজ্যের এই করুণ পরিস্থিতিতে বারবার মনে হচ্ছে, মোদি এবং মমতার নির্বাচনী রাজনৈতিক বিরোধের হ্যাংওভার কেন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারছি না?

আজ সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হল- মোদি এবং মমতার একটি একান্ত বৈঠক। সেই বৈঠকে কোনও ইগোর প্রশ্ন থাকবে না। মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান দিচ্ছেন- এটাই কাম্য। ভোটের সময় কে-কী বলেছেন, সেগুলো যদি মনে রাখতে হয় তবে দেশ চালানো যায় না। রবীন্দ্রনাথ ‘চারিত্রপূজা’-য় বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর আমাদিগকে দয়া করিয়াই বিস্মরণশক্তি দিয়াছেন।’ ভোটের ফলাফল বেরনোর আগে পর্যন্ত যে-রাজনীতি হয়েছে, সে রাজনীতি ভুলে আমাদের এগতে হবে। চাণক্যর বিখ্যাত শ্লোক- শক্তু ক্ষমা শ্লাঘনীয়। শক্তিমান পুরুষের ক্ষমাগুণ প্রশংসার যোগ্য। অপমান, রাগ ও ক্ষতিসহনের অপর নাম ‘ক্ষমা’। শক্তিমানের ক্ষমা প্রশংসার্হ, দুর্বলের ক্ষমা দুর্বলতার পরিচায়ক হতে পারে। ত্যাগী মহাপুরুষদের ক্ষমা-ই তো বল। ক্ষমাগুণে তাঁরা প্রত্যেককে বশীভূত করতে পারেন। আর ক্ষমাশীল যিনি, চাণক্য বলেছেন, তিনি সকল কার্যসাধনে সমর্থ হন। কারণ ক্ষমাশক্তি মানুষকে বিবাদ থেকে বিরত করে। অন্যের ক্ষতিসাধনে পরাঙ্মুখ করে। ধর্মে ক্ষমাশীলতা অপরিহার্য।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজও ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জনপ্রিয়তা এই করোনার সময় প্রায় শতকরা কুড়ি-পঁচিশ ভাগ কমেছে। আমেরিকার সংস্থা এবং ভারতীয় বেশ কয়েকটি সংস্থার সমীক্ষা থেকে এই একই রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে, এবং এটি সর্বজনগ্রাহ্য, সকলের দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু একথাও ঠিক যে, এই মুহূর্তে সর্বভারতীয় স্তরে মোদির কোনও রাজনৈতিক বিকল্পও নেই। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কী অবস্থা, সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। রাহুল গান্ধী রাজনীতিতে আছেন না নেই, তিনি দলের সভাপতি না সভাপতি নন- আজও সেটা স্পষ্ট নয়। এবং গান্ধী পরিবার এখনও তা স্পষ্ট করতে খুব উদ্যত বলেও মনে হচ্ছে না। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের ঐক্য হবে কি না, তা এখন বড় জিজ্ঞাসাচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। ভারতের রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত কোয়ালিশন সরকারের অতীত রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়। মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার কোয়ালিশন হওয়া সত্ত্বেও অবশ্য ১০ বছর চলেছে। কিন্তু সেই দশ বছরে শরিক দলের সমর্থন প্রত্যাহার, নীতি-পঙ্গুতা, নানা ধরনের দুর্নীতি কীভাবে গ্রাস করেছিল তৎকালীন সরকারকে- তাও আমরা দেখেছি। এবং সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদি নামক এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজশক্তির উত্থান হল এদেশে।

তাই যাঁরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ২১৩ আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) জিতে গিয়েছেন বলেই তিনি এখনই হইহই করে দিল্লিতে এসে সর্বভারতীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদিকে সরাতে তৎপর হয়ে উঠবেন, আমার মনে হয়, তাঁরা মমতার প্রতি অবিচার করছেন। মমতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এতটা কম নয়। এ-ব্যাপারে বিজেপির একটা রাজনৈতিক প্যানিক লক্ষ করা যাচ্ছে। বিজেপি মমতার এই সর্বভারতীয় রাজনীতিকে আটকানোর জন্য যেন আরও বেশি করে মমতা-ভূত দেখতে শুরু করেছে! মমতার কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-মোকাবিলা। রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠছে, সেই অভিযোগগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত করা। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আরও সমন্বিত করা। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু তার আগে তিনি দিল্লিতে এসে দাপাদাপি করতেন না। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর সফলতা তাঁকে গুজরাতের মাটিতে আরও জোরদার করে এবং সেই শক্তির বলেই তিনি দিল্লিতে উপনীত হতে পারেন ২০১৪ সালে।

আর-একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) সঙ্গে ছিল বিজেপির মতো একটা শক্তপোক্ত দল। তৃণমূল যদি প্রত্যেকটা আসনও পায়, তাহলেও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ৪২টি আসনের নেত্রী। সুতরাং, কোয়ালিশনের ভবিষ্যৎ আমরা এখনও জানি না। মমতাও অনেক বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গকে। তিনি সাংবাদিক বৈঠকে সেদিন বলেছেন, তাঁর প্রথম এবং শেষ অগ্রাধিকার বাংলা, বাংলার জন্য তিনি সবকিছু করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীর পা-ও ধরতে পারেন। মমতা যখন একথা বলছেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর ঔদার্য একান্ত কাম্য। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অবক্ষয় হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের। একথা ঠিক যে দু’পক্ষেরই কিছু লোক আছে, যারা চায় না এই সংঘর্ষ-বিরতি বা বোঝাপড়াটা হোক। কিন্তু এখন রাজ্যের উন্নয়নের জন্য এই বোঝাপড়াটা জরুরি।

এই স্তম্ভেই গত সপ্তাহে লিখেছি, অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এটা বর্বর এবং অসভ্যদের সরকার। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন না। দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনও সাক্ষাৎকার হয়ওনি। এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এনডিএ-শরিক এবং রেলমন্ত্রী। তিনি পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-বিরোধী রাজনৈতিক অভিযানে ব্যস্ত। সেই সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জ্যোতি বসুর সিদ্ধান্ত বদল করাতে মস্ত বড় ভূমিকা নেন, দিল্লিতে লালকৃষ্ণ আদবানির কাছে জ্যোতি বসুকে নিয়ে আসেন।

আমার এখনও সেই দিনটা মনে পড়ে, আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জ্যোতিবাবু বুদ্ধবাবুকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বুদ্ধ উপ-মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। সুতরাং, উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বুদ্ধ নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন আপনার সঙ্গে।’ এবং এরপর আদবানি অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। বাজপেয়ীর সঙ্গে জ্যোতিবাবু বৈঠক করেন। এর আগেও তাঁদেরর বৈঠক হয়েছিল। যখন ভি. পি. সিং প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বাম এবং বিজেপি, দু’পক্ষই বাইরে থেকে ভি. পি. সিংকে সমর্থন দিয়েছে। আমি লালকৃষ্ণ আদবানির কাছেই গল্প শুনেছিলাম, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বাজপেয়ী এবং আদবানির একটি বৈঠকও হয়েছিল, যে-বৈঠককে গোপন রাখতে অনুরোধ করেছিলেন জ্যোতিবাবু। তার কারণ, কমিউনিস্টরা বিজেপির সঙ্গে বৈঠক করছে- তাতে ভুল বার্তা যেতে পারে রাজ্যে। সেই কারণেই বাজপেয়ী-আদবানির বাড়িতে জ্যোতিবাবু আসতে রাজি হননি। শিল্পপতি এবং বাংলার এককালীন রাজ্যপাল বীরেন শাহ জ্যোতিবাবুর বন্ধু ছিলেন, তিনি এই বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। একটি পাঁচতারা হোটেলের সুইটে এই বৈঠকটি হয়েছিল। আদবানি এই কথা তাঁর আত্মজীবনীতেও লিখেছেন। তিনি বারবার বলতেন, ‘আমাদের দিক থেকে কিন্তু কোনও রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা নেই। আমাদের মতাদর্শগত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু কারও সঙ্গে দেখা করব না, বা করলে গোপনে করব- এমন রেওয়াজ কিন্তু আমাদের পার্টিতে নেই।’ একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সেই সমস্যা ছিল। বুদ্ধবাবু তার সমাধান করে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্পর্কের মধ্যে একটা যোগাযোগের সেতু তৈরি করেছিলেন। মনে পড়ে, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল নিয়ে একটা বিবাদ তৈরি হয়েছিল কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে। বুদ্ধবাবুই তা আদবানিকে বলেন এবং আদবানি নর্থ ব্লকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘরে তৎকালীন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী রাম নায়েককে ডেকে পাঠান। বুদ্ধবাবু সেই বৈঠকে থাকেন এবং আদবানির মধ্যস্থতায় সেই বিবাদভঞ্জন হয়। সেই বৈঠকের পর পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের অফিসার এবং রাজ্য সরকারের অফিসাররাও বৈঠকে যোগদান করেন। এক মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছিল।

আজ এতদিন পর এই ঘটনাগুলো মনে পড়ছে, তার একটাই কারণ- পশ্চিমবঙ্গের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে, বাংলার ভূমিপুত্র হিসাবে, আমার মনে হচ্ছে, বাংলার ভবিষ্যৎ কেন্দ্র-রাজ্যের সুষ্ঠু সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংঘাত হবে না বা রাজনৈতিক লড়াই হবে না। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকুক। ভবানীপুর-সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন আসছে, সেখানে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস একে-অপরকে হারানোর চেষ্টা করুক। কিন্তু প্রশাসনকে পঙ্গু করে, কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিবাদকে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে রাজনীতির ফায়দা তোলা কিন্তু কাম্য নয়। তিন থেকে ৭৭টি আসনে পেঁৗছেছে বিজেপি, তা কম কথা নয়। কিন্তু সেই বিজেপিকে তো সক্রিয় অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি না! যা দেখতে পাচ্ছি, তা এনফোর্সমেন্ট বা সিবিআই, অথবা রাজ্যপাল, অথবা নর্থ ব্লক বা সাউথ ব্লক।

বিজেপির এক নেতা আমাকে বলেছিলেন, বাজপেয়ীর সরকার জোট সরকার ছিল, তাই বাজপেয়ীকে মমতার বাড়িতে যেতে হয়েছিল। মমতার মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। নরেন্দ্র মোদির সেই বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি কোয়ালিশনের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি বিজেপির একচ্ছত্র মহানায়ক। এই কথার প্রসঙ্গে সেই বন্ধু বিজেপি নেতাকে বললাম, হয়তো বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, কিন্তু দেশটা এখনও কোয়ালিশনে আছে। ভারত ১৫০ কোটি মানুষের দেশ, ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’। এই কোয়ালিশনকে বোধহয় প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত। কৌটিল্য তো রাজাকে ‘রাজর্ষি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা শুধু কৌটিল্যের ‘সাম-দান-দণ্ড-ভেদ’-এর কথা বলি। আমরা শুধু ভাবি, যেনতেন প্রকারে কীভাবে ক্ষমতার রাজনীতি করা যায়। ম্যাকিয়াভেলি আর কৌটিল্যকে একসঙ্গে বসাই পাশাপাশি। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি আর কৌটিল্য তো এক নন। কৌটিল্য তথা চাণক্যের নীতিশাস্ত্র আছে। ‘রাজর্ষি’-কে অনেক নীতিশাস্ত্র মেনে চলতে হয়। ‘সাম-দান-দণ্ড-ভেদ’- এই চার উপায়ের মাধ্যমে রাজা অর্থ লাভ করেন। কিন্তু রাজার কর্তব্যকর্মে গণতন্ত্র সবচেয়ে বড় কথা।

কলাইকুন্ডার ঘটনার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ টুইট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেন। বলেন যে, তিনি সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। দেখা গেল, রাজনাথ সিং, নীতীন গড়করির মতো মন্ত্রী, যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল রাখেন, তাঁরাও মমতা-বিরুদ্ধে টুইট করলেন। সাংবাদিক জীবনের প্রায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, কেন্দ্র থেকে দেশ-শাসনের জন্য একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে সমবেতভাবে টুইট অভিযান বোধহয় ভুল রণকৌশল। মন্ত্রিসভায় অন্তত কয়েকজন মন্ত্রী থাকা উচিত, যাঁরা রাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখবেন। এটাই আমাদের সাবেক রাজনীতি শাস্ত্রের গোড়ার কথা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতেন, নরসিমা রাও তখন প্রধানমন্ত্রী। তখন জ্যোতিবাবু কিন্তু নরসিমা রাও ও তাঁর একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন, সেই মন্ত্রীদের মধ্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় তো ছিলেনই। এমনকী, রাজীব গান্ধীর সময়েও বুটা সিংয়ের বাড়িতে জ্যোতিবাবু নিয়মিত যেতেন। দার্জিলিংয়ের সুভাষ ঘিসিংয়ের সমস্যা মেটাতে জ্যোতিবাবু বুটা সিংয়ের সহায়তা নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করেছিলেন। আবার নরসিমা রাওয়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস. পি. চৌহান সল্টলেকে জ্যোতিবাবুর বাড়িতে গিয়েও দেখা করেছিলেন। সেইসময় রাজ্যে বিরোধী দল কংগ্রেস। তারা তুমুল সমালোচনা করেছিল। কেন এস. পি. চৌহান জ্যোতিবাবুর বাড়িতে যাচ্ছেন? তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জ্যোতিবাবুর বাড়িটি মুখ্যমন্ত্রীর ভবন, সেটি একটি অফিস। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসা সরকারি ব্যাপার, কেন্দ্র-রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর সঙ্গে কংগ্রেস বনাম সিপিএমের রাজনীতিকে যুক্ত করা ঠিক নয়।

তাই আমরা যখন করোনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এক সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছি, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন উন্নয়নের জন্য অনেক বেশি জরুরি। সে-কারণে উচিত কাজ হবে, যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর সচিবালয়ের কাউকে নিযুক্ত করেন, যিনি রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবেন। আবার মুখ্যমন্ত্রী অথবা মুখ্যসচিব যে কোনও একজন তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রশাসনিক সম্পর্করক্ষার দায়িত্ব দিন। এটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ- দু’রকমভাবেই হতে পারে। যদি রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করা বা রাজ্যপালের শাসন জারি করা-ই কেন্দ্রের লক্ষ্য হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি এটা কোনও পরিকল্পিত চিত্রনাট্য না হয়, তাহলে এই দুর্যোগের সময় দু’পক্ষেরই উচিত রাজনীতির তাপমাত্রা কমিয়ে আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলা। সেটাই জনস্বার্থের পক্ষপাতী।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: তিনি জননেত্রী, নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ