Advertisement
Advertisement
Pitch row

পিচের একক প্রদর্শনী

একটা বাঘা দল কেন এতটা ত্রস্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল?

The pitch row: Rajdeep Sardesai takes dig at men in blue। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 10, 2023 5:11 pm
  • Updated:March 10, 2023 5:11 pm

‘গন্তব‌্যই শেষ কথা, রাস্তা নয়’– এই মন্ত্রটি বিপজ্জনক। তা নীতিহীনতা প্রকাশ করে। যেভাবে অতি-অনুকূল পিচ তৈরি করে ভারতকে দু’টি টেস্ট জিততে হল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, তা প্রমাণ করে, ভারতীয় দল কতখানি রেজাল্ট-মুখী ছিল। অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিতকে জীবন থেকে সরিয়ে রাখার দৃষ্টিকোণ মনের উদারতার কথা বলে না। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই

খেলোয়াড়, অধিনায়ক এবং ধারাভাষ্যকার রূপে গত ৫০ বছরে ভারতীয় ক্রিকেটে সুনীল গাভাসকরের (Sunil Gavaskar) চেয়ে বেশি ভরসা-জাগানো কণ্ঠস্বর আর নেই। কিংবদন্তি এই ক্রিকেটার ভারতীয় পিচের বিতর্কিত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। যখন তিনদিনে পরপর তিনটি টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়েছে, তখন সেই কণ্ঠস্বর বলছে: ‘ভারতের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ঝঁাপ দেওয়ার জন্য অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। যদি এই দলের শক্তিশালী বোলিং অ‌্যাটাক থাকত, তাহলে হয়তো তারা অন্য কিছু করতে পারত, কিন্তু এই দলের শক্তি দলের স্পিনাররা। আমি মনে করি, এই পিচগুলি তৈরি করা হচ্ছে এটা মাথায় রেখেই।’ অর্থাৎ, গাভাসকর এমন একটি মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, যা জীবনেরও মন্ত্র, ক্রিকেটেরও– যেখানে পন্থা আসলে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা ফলাফল।

Advertisement

গাভাসকরের এই মন্তব‌্যকে ক্রিকেটের মাঠে ফেলা যাক। ভারতীয় ক্রিকেট অান্তর্জাতিক স্তরে দুরন্ত, তারা বিশ্বজয়ীও। এই দলের খেলোয়াড়রা বন্দিত পৃথিবীর তাবড় তাবড় খেলোয়াড়কে মাঠে পরাস্ত করার জন‌্য। এবং, তঁারা ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজয়ের ধারাবাহিকতায়। এই দলটাই দুটো পরপর ম‌্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছিল, যা কয়েক বছর অাগেও ছিল অবিশ্বাস‌্য। গত এক দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেটার– বিরাট কোহলি (Virat Kohli) এই দলকে উজ্জীবিত করেছিলেন। ব‌্যাটিং লাইন অাপ-এ ছিলেন ইতিপূর্বের চ‌্যাম্পিয়নরা, সঙ্গতে উঠতি প্রতিভারা, এমনকী, বোলিংয়েও বৈচিত্রের অভাব ছিল না– তা সে স্পিনার হোক বা পেসার। এবং উপর্যুপরি দলটির কোচ বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা একজন। এরকম একটা বাঘা দল কেন এতটা ত্রস্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল যে, পূর্ব-পরিকল্পিত পিচের প্রয়োজন পড়ল ঘরের মাঠে জেতার জন‌্য?

Advertisement

[আরও পড়ুন: মাওয়ের নজির ছুঁয়ে ইতিহাস, তৃতীয়বার চিনের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত জিনপিং]

উত্তরটা গাভাসকরই দিয়েছেন। কারণ, জুন মাসে বিশ্ব টেস্ট চ‌্যাম্পিয়নশিপের জন‌্য অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জেতাটা অাবশি‌্যক ছিল। মনে রাখতে হবে, এটা এমন একটা দল, যা শত উচ্চাশার রামধনু তৈরি করেও ২০১৩ সাল থেকে একটাও ‘অাইসিসি’ ট্রফি জিততে পারেনি। এবং বহু ম‌্যাচে, জেতার মূহূর্ত তৈরি করেও অবশেষে তরী ডুবেছে। ‘বোর্ড কাউন্সিল অফ ক্রিকেট’ অারও একবার জেতার সম্ভাবনা হাতছাড়া করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। দলের শীর্ষ-কর্তারা ও পরিচালকমণ্ডলীও এখন গণ-পরিসরে আতশ কাচের তলায় চলে এসেছে। তিনদিনের অাগেই টেস্ট ম‌্যাচ শেষ হয়ে যাওয়া এই আবহে এমন কোনও ব‌্যাপার নয়, কারণ উদ্দেশ‌্য তো বিশ্ব টেস্ট চ‌্যাম্পিয়নশিপ জেতা। ফলে পিচ প্রস্তুতকারীদের একরকম জোরই করা হয়– পিচে ধুলো থাকবে, বল ঘুরবে প্রথম ওভার থেকেই। যে-কারণে অাইসিসি ম‌্যাচ রেফারি ইন্দোরের পিচকে ‘পুওর’ রেটিং দিয়েছেন।

‘গন্তব‌্যই শেষ কথা বলবে, জয়ের রাস্তা নয়’– এই মন্ত্রটি বিপজ্জনক, কারণ তা এমন একটি অনৈতিক মানসিকতা প্রকাশ করে, যেখানে দু’টি দলের মধে‌্য প্রথম থেকেই একদল এগিয়ে রয়েছে পিচের দৌলতে। এমনকী, এই পিচ ব্যাট ও বলের মধ্যেও সমান প্রতিযোগিতা তৈরি করে না। এক্ষেত্রে একমাত্র চিন্তার বিষয় হয়ে দঁাড়ায়, জয় নিশ্চিত করার জন্য কত দ্রুততায় কুড়িটি উইকেট নেওয়া যায়। যেখানে জয় নিশ্চিত করাটাই একমাত্র উদ্দেশ‌্য, সেখানে ম‌্যাচটি তিনদিনের হল, না কি পঁাচদিনের– কী আসে-যায়!

[আরও পড়ুন: উপাসনা চলাকালীন জার্মানির গির্জায় ঢুকে তাণ্ডব বন্দুকবাজের, মৃত অন্তত ৭, আহত বহু]

একই ধরনের অনৈতিক যুক্তি প্রায়শই নির্বাচনের সময় উচ্চারিত হয়: ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’– ফলপ্রকাশের দিনে অতিপরিচিত এই ব‌াক‌্য। জেতার জন‌্য কী কী উপায় নেওয়া হল, তা ঘৃণ‌াভাষ‌ণ হোক, কি টাকার ক্ষমতা, বা প্রতিষ্ঠানের অপব‌্যবহার– তা বিবেচিত হয় না। বিজয়ীকে মহিমান্বিত করার দাপটে হারিয়ে যায় নৈতিক পরিসর। ক্রিকেট কিন্তু রাজনীতির মতো এত সহজে মিথ‌্যাচারে বাস করে না। কিন্তু ‘পূর্ব-পরিকল্পিত’ পিচ ক্রিকেটকে নামিয়ে অানে ভার্চুয়াল লটারি খেলার পরিসরে। খেলা, যা কিনা সূক্ষ্ম মানবিক মূল‌্যবোধের পরিচয় দেয়, তা হারিয়ে যায় যেনতেন প্রকারেণ জিতে যাওয়ার নীতিহীন কোলাহলে।

পিচ বিতর্কের আর-একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল, প্রশ্ন বা অভিযোগটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, এই যেমন: ইংল্যান্ডের ঘাসভরা পিচে বা অস্ট্রেলিয়ায় উচ্ছল বাউন্সি উইকেটে খেলার সময় ভারতীয় দলকে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তার বেলা? হ্যঁা, বিদেশে মাঠের অবস্থা প্রায়শই ভারতীয় দলগুলির কাছে অচেনা হতে পারে এবং ঘরের মাঠে খেলার সুবিধা বিশ্বজুড়ে সমস্ত দলই ভোগ করে। কিন্তু তা বলে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা গ্রহণের জন‌্য ইচ্ছাকৃতভাবে পিচ প্রস্তুত করা কি কোনওভাবে সমর্থনযোগ‌্য? যদিও খেলার নিয়মানুসারে, ‘পূর্বনির্ধারিত’ পিচ প্রস্তুত করা হয়তো সরাসরি প্রতারণা নয়, তবু খেলার
স্পিরিট-কে এখানে ধূলিস‌াৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে নিজেদের শর্তমতো খেলে।

সতি‌্য বলতে, ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ‘হোয়াটাবাউট্রি’, অর্থাৎ, এক আখ‌্যান দিয়ে অন‌্য আখ‌্যানের মোকাবিলার সঙ্গে অাশ্চর্যরকম সাদৃশ‌্য রয়েছে রাজনীতিকদের কৃতকর্মের অজুহাত দেওয়ার। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, প্রতে‌্যকবার কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি বিরোধী নেতৃত্ব থেকে একটি দৃষ্টান্ত তুলে অানে, এবং বলে যে, সেই বিরোধী যখন ক্ষমতায় ছিল, সে একই প্রক্রিয়ায় এমন কাজই করেছিল। যখন সক্রিয়ভাবে ঘোড়া কেনাবেচা করে সরকার ফেলে দেওয়া হয়, তখন আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, এই প্রথাটি বিগত কয়েক দশক ধরেই ভারতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান। এখন যখন ক্ষমতার অপব‌্যবহার করে সরকার, তখন কতবার অামাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় ১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধীর ‘জরুরি অবস্থা’-র সময়টা? ১৯৮৪ ও দেশভাগের সময়টা মনে করিয়ে দেওয়া হয়, যখনই দেশের কোনও কোনায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি হয়। ‘হোয়াটাবাউট্রি’ হল দুর্বল এবং অাপসকারীদের একমাত্র প্রতিরক্ষা কবচ, যাদের লুকনোর কিছু নেই, তাদের ‘হোয়াটাবাউট্রি’-র অাড়াল নিতে হয় না।

তাই, ক্রিকেট হোক সরকার– যেখানে যঁারা শীর্ষস্থানে রয়েছেন, তঁাদের অতি দ্রুতই নিজেদের বদল করতে হবে। ক্রিকেট মাঠে এটা আরও বেশি উপলব্ধি করা উচিত যে, খেলার আসল আকর্ষণ শুধু জয় বা পরাজয়ের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং কীভাবে খেলা হচ্ছে, সেটাই মূল অানন্দ হয়ে ওঠে। আসলে, ক্রীড়াপ্রেমীরাই খেলার চূড়ান্ত অংশীদার। তাদের তো আর অনুপযুক্ত উইকেট প্রস্তুত করার মতো পরিবর্তন করা যায় না। একইভাবে, যঁাদের দেশের গণতান্ত্রিক নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তঁাদের অবশ্যই বিরোধী দলকে আঘাত করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার না করার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বরং সবার জন্য সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

শেষে বলা যায়, ইন্দোরের টেস্ট ম্যাচে ভারত আসলে এক ভয়াবহ পিচে অস্ট্রেলীয়দের কাছে হেরেছে– এটাই সম্ভবত একমাত্র কাব্যিক বিচার হতে পারত। কারণ, ঘরের মাঠে যখন নিজের অপরাজেয়তা সম্পর্কে আপনি এতটাই নিশ্চিত হন, সেক্ষেত্রে কখনও কখনও ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত মোড়ের জন‌্য প্রস্তুত থাকেন না। এটা মাঠ এবং মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে জীবনের একটি পাঠ, কখনও কিছুকে নিশ্চিত হিসাবে নেওয়া উচিত নয়।

পুনশ্চ: যখন ইন্দোর ম্যাচ প্রায় আড়াই দিনেরও কমে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন একটি ক্রিকেট ওয়েবসাইট এক ভ্রাম‌্যমাণ ভারতীয় দলের জার্সি বিক্রেতার মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেই বিক্রেতা পঁাচদিনের বেশি বিক্রি করার জন্য জার্সি কিনেছিলেন, এখন তঁাকে মাত্র দু’দিনের মধ্যে দোকান গুটিয়ে নিতে হচ্ছে। তঁার যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে? যে কোনও মূল্যে জিততে গেলে এই সূক্ষ্ম অনুভবগুলোকে হারিয়ে ফেলতে হয়!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ